|| ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ||
অন্য কারো সমালোচনা তা সে নিজ সংসারের, প্রতিবেশীর, প্রশাসন, সরকার কিংবা দূরের ও কাছের ভূরাজনীতির ভায়রাভাইদেরই হোক, করার আগে আত্মসমালোচনার উদ্যোগ, দায়-দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। বর্তমানের কর্তব্যকর্ম সাধনা বর্তমানে বসেই করতে হবে। বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে যে সময়ের যে কাজ সে সময়ে সে কাজ শুরু ও শেষ করতে হবে। বর্তমানকে সমৃদ্ধশালী, গুণগত মানসম্পন্ন ও অধিকতর উপযোগী করতে অতীতের ব্যর্থতা ও সাফল্যকে শিক্ষা ও প্রেরণা হিসেবে সচেতন অনুসরণে আনতে হবে। অতীতের গৌরবকে সর্বকালীন ও সর্বজনীনকরণের ভার সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হয়, বর্তমানে অতীতকে অতিমাত্রায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে, অতীতের গুরুত্ব যেমন হ্রাস পায় তেমনি বর্তমানে ভালো কিছু করার সময় ও সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এটি মানবজাতির ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে এবং সবসময় সীমালঙ্ঘন বা মাত্রা অতিক্রমণই বুমেরাং হয়ে ফিরেছে। ফিরোজ শাহ তুঘলক দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর করতে গিয়ে বাড়াবাড়িতে আম-ছালা দুটোই খুইয়েছিলেন। ভাববাদী সমাজে সমতার পরিবর্তে বৈষম্যের বাড়াবাড়িতে সংহতির সংসারে ভাঙন হয়ে ওঠে অনিবার্য। সীমালঙ্ঘনের সমস্যায়, মাত্রাতিক্রমণের প্রবণতায়, প্রগলভতার প্রতারণায় বহু সভ্যতার ভরাডুবিতে ভুগেছে মানুষ। মহামারীতে সম্বিৎ ফিরেছে, আবার ফেরেনি। যতদিন যতটা ফেরেনি মহামারীও পাছ ছাড়েনি। এটি প্রকৃতির নিয়ম। প্রগলভতা, প্রতারণা, প্রসঙ্গ পাল্টানো ও অন্যের ওপর দোষ চাপানো দ্বারা বর্তমানের অনাচার ও সমূহ সর্বনাশকে আড়াল করা যায় না, এটি প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ এবং অপেক্ষার পালা সাঙ্গ হলে বিচারে (হধঃঁৎধষ লঁংঃরপব) বা প্রতিশোধে নামে প্রকৃতি নিজেই।
উপলব্ধির বিষয় হলো মানুষ বাঁচে আশায়, পরিবার-প্রতিবেশী-সমাজ ও দেশ বাঁচে ভালোবাসায়। আমরা কত আশা করি এটা-ওটা কত কিছু করব। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আছে, ইচ্ছার তালিকা, প্রত্যাশার তালিকা বড় হয়েই চলেছে, কিন্তু আল্লাহ জানেন আমরা কতদিন আছি। এমনও মনে হয় ভালোই তো আছি, অন্যদের কিছু হলেও আপাতত আমার বা আমাদের কিছু হবে না। ধন্য আশা কুহকিনী আমাদের ভুলিয়ে রাখে, প্রবহমান সময়ের সাথে নদীর স্রোতও গতিহারা হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে প্রত্যেকেই সময়ের হাতে বন্দী, প্রত্যেকেই যার যার জগতে, এখতিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ নিজের ও পরের জন্য। সুতরাং যখন যিনি যেটি ভালো মনে করেন এখনই বা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা করবেন। এ সুযোগ আর নাও আসতে পারে। ‘শুভষ্য শীঘ্রম’। রাবণ তার সহচরকে বললেন, ‘আমি স্বর্গের সিঁড়ি বানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার সময় শেষ। সে জন্য আমি তোমাকে একটি উপদেশ দেবো, যদি তুমি কোনো ভালো কাজ করতে চাও ঝঃধৎঃ হড়,ি ফড়হ’ঃ ধিরঃ ভড়ৎ ঃড়সড়ৎৎড়.ি লেভ টলস্টয় তার গোটা জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাসে বলেছিলেন, বর্তমানই সেরা সময় (ঘড়ি রং ঃযব নবংঃ ঃরসব).
প্রত্যেক ব্যক্তি সমাজ ও দেশে নিজ নিজ মূল্যবোধ চিন্তাচেতনার বলয়ে থেকেই তার অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। অপরের আনন্দ সর্বনাশের উদাহরণ টেনে নিজের বা নিজেদের বেপথে চলার যুক্তি দাঁড় করানো আত্মপ্রবঞ্চনার শামিল। করোনা মোকাবেলায় নিজে বা নিজেরা যদি যথাসচেতন ও কার্যকর পদক্ষেপে না থাকা হতো, অন্যেরা এসে আমাকে থামাতে বা নামাতে সাহায্য করবে সেই ভরসায় বসে থাকা হলে, অন্যের মুখাপেক্ষী থাকা মানে নিজের বল ক্ষয় করা, নিজের সামর্থ্য ও আশা আকাক্সক্ষাকে জলাঞ্জলি দেয়া; সে কথা বোঝার জন্যও যদি অন্যকে ত্রাতা ভাবি তাহলে প্রতিপক্ষ সে সুবাদে আমার কাটা খালে কুমির হিসেবে আসবেই। নিজেদের মধ্যেকার বিভেদের দেয়াল নিজেদের ভাঙতে, বিভেদ, বৈষম্য ও পারস্পরিক অনাস্থার জায়গায় জঞ্জাল জমানোর পরিবর্তে সেগুলো অপসারণ অপনোদনে যতœবান হওয়ারও এখনই সময়। স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ সঙ্কুচিত হলে নিজের অকর্মন্যতা কিংবা আত্মসংহারের উপলব্ধিটাও ভোঁতা হয়ে যায়।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, দেশ সমাজ সংসারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা-প্রয়োগের প্রধানতম পূর্বশর্ত হলো ব্যক্তিজীবনে শুদ্ধাচার। ব্যষ্টি থেকেই সমষ্টি। সঠিক জীবনদৃষ্টি প্রয়োগ করে মেধা ও প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকশিত ব্যক্তিই ‘স্ব-উদ্যোগ, স্ব-পরিকল্পনা ও স্ব-অর্থায়ন দ্বারা সৃষ্টির সেবায় সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করে অশান্তিকে প্রশান্তিতে, রোগকে সুস্থতায়, ব্যর্থতাকে সাফল্যে, অভাবকে প্রাচুর্যে রূপান্তরিত করতে পারে। ‘ধর্মের ফলিত রূপ হচ্ছে শুদ্ধাচার আর অধর্মের ফলিত রূপ হচ্ছে দুরাচার। …ধার্মিক যেমন দুরাচারী হতে পারে না, তেমনি দুরাচারীও কখনো ধার্মিক বলে গণ্য হতে পারে না।’
ব্যষ্টি ও সমষ্টির জীবনে শুদ্ধাচার বা সদাচার চর্চার তাৎপর্যময় আবশ্যকতার কথা তাবৎ ঐশী গ্রন্থে, ধর্ম প্রবর্তক, প্রচারকের বাণীতে, সক্রেটিস (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০-৩৯৯), প্লেটো (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩৭-৩৪৭), এরিস্টটল (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২) এমনকি কৌটিল্যের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭৫-২৮৩) অর্থশাস্ত্রেও ছিল। সেই সদাচার শুদ্ধাচারের চর্চা অবলম্বন অনুসরণ যুগে যুগে নানান প্রেক্ষাপটে হ্রাস বৃদ্ধি ঘটেছে। সদাচার সুশাসন লোপ পেলে ব্যক্তি সমাজ সংসার নিপতিত হয়েছে নানান অরাজক পরিস্থিতিতে। মানবসমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সূচনা-বিকাশ-বিবর্তনও ঘটেছে শুদ্ধাচারের প্রতি আকিঞ্চন আকাক্সক্ষা ও দায়বদ্ধতা থেকে। শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থে, সহযোগিতা-সহমর্মিতার স্বার্থে, ন্যায়নীতি নির্ভরতার স্বার্থে ও তাগিদে সুশাসনকে অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করা হয়েছে।
সর্ববিধ বিবেচনায় নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, রাজপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরও বেপরোয়া আচরণ, বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারের মতো অর্থনীতির সমূহ সর্বনাশ সাধন, সেবাধর্মী সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির প্রতিকার না পাওয়ার মতো বিষয়গুলো দিন দিনই সাধারণ মানুষকে যাতে আরো উদ্বিগ্ন করে না তোলে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কার্যকলাপ জবাবদিহির বাইরে চলে যাওয়ার মতো ঘটনার প্রতিকার পেতে রাষ্ট্রে একজন সাংবিধানিক ন্যায়পালের অবশ্যকতা উঠে আসছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ন্যায়পাল সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে আনবে জবাবদিহির আওতায়। একজন ন্যায়পাল থাকলে সরকারকে মুখোমুখি হতে হবে না অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতিরও। চানক্য পণ্ডিতের মতো অনেকে এটিও বলছেন, ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান সরকারের প্রশাসনকে করতে পারে শক্তিশালী। কেননা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারণে সরকারের প্রতি আস্থা হারাতে পারে সাধারণ মানুষ-রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি এই আস্থাহীনতাই জন্ম দেয় সামাজিক অনাচার ও রাজনৈতিক সহিংসতার।
ঔপনিবেশিক শাসন প্রশাসনযন্ত্রের যাবতীয় অন্যায় অনিয়ম ও শোষণ বঞ্চনা রহিত করে সুশাসন, সদাচারী সমাজ বিনির্মাণের আকাক্সক্ষা থেকেই ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য মানুষের রক্তত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। ২০২৪-এ গণজাগরণ সেই নিরিখে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য ন্যায়পাল নিঃসন্দেহে অনিবার্য বিষয়। বাংলাদেশের সংবিধানের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হলো, ন্যায়পালের বিধান।
প্রশাসনের অনিয়ম অব্যবস্থা দূর করতে সংবিধানে ন্যায়পালের বিষয়টির উদ্ভব হয়। ন্যায়পালের সহযোগিতায় সরকার শুদ্ধাচারের অনুশীলনে এগিয়ে যেতে পারবে। একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে উঠতে অব্যবস্থা, অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করার জন্য জাতীয়পর্যায়ে সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। এটি তখনই সৃষ্টি হতে পারে যখন এই প্রয়াসে সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ শামিল হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন। সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোনো মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের যেকোনো কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা যেরূপ দায়িত্ব প্রদান করিবেন, সেইরূপ ক্ষমতা বা দায়িত্ব পালন করিবেন।’ এ থেকে বোঝা যায়, ন্যায়পালের মূল কাজ হলো- নাগরিক অধিকারকে প্রশাসনের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে রক্ষা করা। এ ছাড়া সবপর্যায়ের অধিকারিক কর্মকর্তারা দেশের আইন ও সংবিধান সঠিকভাবে মেনে চলছেন কি না এবং তাদের কাজে নাগরিক অধিকার বিনষ্ট হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে লক্ষ রাখা।
বাংলাদেশে ২০০৫ সালে ‘কর ন্যায়পাল আইন’ গৃহীত হয়। কর ন্যায়পাল বিল পাসের প্রস্তাব করে সংসদে সে সময় বলা হয়েছিল, কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষ কর নিয়ে বিদ্যমান ভীতি থেকে রেহাই পাবে। মানুষ আরো কর দিতে উৎসাহিত হবে। কর আদায়ে হয়রানি রোধেও কর ন্যায়পাল ভূমিকা রাখতে পারবে বলে ওই সময় পাস হওয়া আইনে বলা হয়। মাত্র ছয় বছর পর সংসদে কর ন্যায়পাল (রহিতকরণ) বিল, ২০১১ পাসের মধ্য দিয়ে কর ন্যায়পাল পদ ও তার যাবতীয় কাজ রহিত করা হয়। ‘বর্তমানে সরকার কর আদায়ে মানুষকে নানাভাবে উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেয়ায় এ ধরনের ব্যয়সাধ্য প্রতিষ্ঠানের আর কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষকে বোঝানো গেছে, প্রত্যেকেরই কর দেয়া উচিত।’ বলা হয়েছিল ২০১০, ২০১১ সালে দুই লাখ করদাতা বেড়েছে। তাই কর ন্যায়পাল বাতিল করা দরকার। সে সময় এটিও বলা হয়েছিল, কর, ভ্যাট ও শুল্ক-সম্পর্কিত আইনের সাথে ন্যায়পাল আইনটি সাংঘর্ষিক হওয়ায় মন্ত্রিসভা সেটি রহিতকরণের প্রস্তাব অনুমোদন করে। সে মর্মে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশসহ বিলটি সংসদে উত্থাপন করলে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।’ প্রয়োজনের তাগিদেই কর ন্যায়পাল পদ তৈরি হয়েছিল আবার ‘প্রয়োজন নেই’ মনে করেই এটি বিলুপ্ত করা হয়। ‘প্রয়োজন’ ‘অপ্রয়োজনের’ হিসাব-নিকাশটি যুক্তিযুক্ততার নিরিখে দেখতে গেলে প্রণিধানযোগ্য হয়ে উঠবে যে, দেশে কর রাজস্ব প্রদান ও আহরণের সংস্কৃতিকে বলবান ও বেগবান করতে, ছোট-বড় দুর্নীতিমুক্ত সদাচারী ও সুশাসিত পরিবেশ প্রেক্ষাপট নির্মাণের বিকল্প নেই। অন্যের সমালোচনা করার আগে আত্মসমালোচনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য এখানেই।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান