শিরোনাম :
Logo অর্থনীতি নিয়ে রোডম্যাপ না থাকায় হতবাক হয়েছি Logo গাজায় অনাহার যুদ্ধাপরাধের শামিল: জাতিসংঘ কর্মকর্তা Logo প্রবাসীদের রেমিট্যান্সেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে: প্রধান উপদেষ্টা Logo ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায় ৫৩ রাজনৈতিক দল Logo জাপান সফর শেষে ঢাকা ফিরছেন প্রধান উপদেষ্টা Logo চুয়াডাঙ্গায় যুবলীগ নেতার বাড়িতে বিস্ফোরণে গুরুতর আহত কিশোর, যা জানা গেল Logo গবেষণায় নেচার ইনডেক্সে সেরা দশে স্থান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় Logo পারিবারিক কলহের জের ধরে বড় ভাইয়ের হাতে ছোট ভাই খুন Logo রাবি স্টুডেন্ট রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফাহির, সম্পাদক তাসিন Logo রাতে ঢাকাসহ যেসব জেলায় ৮০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের আশঙ্কা

‘পাকিস্তানপন্থা’ : একটি ধারালো অস্ত্র

  • সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০২:৫১:৩৮ অপরাহ্ণ, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫
  • ৭১৩ বার পড়া হয়েছে

|| জসিম উদ্দিন ||

কুষ্টিয়ার এক পুলিশ সুপার নাগরিকদের বলেছিলেন, ‘পেয়ারা পাকিস্তানে চলে যাও’। ওই পুলিশ কর্মকর্তা একদল মানুষকে শত্রু গণ্য করছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রের নিয়ম অনুযায়ী তিনি তাদের কোনোভাবে শাস্তিযোগ্য করতে পারছিলেন না। আওয়ামী প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং নিজের উদ্দেশ্য হাসিলে তাকে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সে জন্য তিনি ‘পাকিস্তান’ শব্দটি কলঙ্ক তিলক হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে জুড়ে দেন ।

দেশের মানুষকে দমিয়ে রাখতে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের একটি বয়ান ছিল ‘পাকিস্তানপন্থা’। এ বয়ানের বিশেষত্ব ছিল এটি প্রয়োগ করা হতো আলেম ওলামা ইসলামী দল ও মাদরাসাসংশ্লিষ্টদের একটি সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ওপর। পাকিস্তান রাষ্ট্রকে বাংলাদেশে ধর্মীয় গোঁড়ামি, পশ্চাৎপদতা ও জঙ্গিবাদের প্রতীক হিসেবে তারা দেখাতে চাইত। অতএব, যে কাউকে এ তকমা এঁটে দেয়া হলে তার রেহাই ছিল না। তার সম্পদ সম্মান লুণ্ঠন জায়েজ হয়ে যেত; তার জীবন হত্যাযোগ্য হয়ে যেত।

ঘটনাটি ২০২০ সালের। কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার ছিলেন এস এম তানভীর আরাফাত। তিনি স্থানীয় এক আওয়ামী সংগঠনের আয়োজিত অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ বক্তা ছিলেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পক্ষে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। যারা শেখ মুজিবকে জাতির পিতা মানেন না, তাদের জন্য তিনটি বিকল্প দেন। ১. তাদের হাত ভেঙে দেয়া হবে, জেল খাটতে হবে ২. বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না এবং ৩. বাংলাদেশ যদি পছন্দ না হয়, তাহলে ‘ইউ আর ওয়েলকাম টু গো ইউর পেয়ারে পাকিস্তান’। তিনি ওই ভাষণে আরো কিছু অত্যন্ত আপত্তিকর কথা বলেন। তার মতে, মেধাহীনদের মাদরাসায় পড়ানো হয়। তারা বিনা পয়সায় পড়ে, ‘আমাদের’ টাকায় চলে। বঙ্গবন্ধুকে কেন জাতির পিতা বলছেন না, এর কারণ হচ্ছে আপনারা রাজাকার আলবদর আলসামসের পৌত্র ও সন্তান। মৌলবাদীদের এ দেশে দরকার নেই। তানভীরের এ বক্তব্য আসলে আওয়ামী লীগের বয়ান ‘পাকিস্তানপন্থা’র সারকথা। একটি সুনির্দিষ্ট বর্গের বিরুদ্ধে এটি ব্যবহার হয় তাদের অধিকারহীন করতে।

জাতির মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টিকারী বয়ান আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল অসাধু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে দিয়ে; যাদের অনেকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে তা অনায়াসে করেছে। সেতুবন্ধন হিসেবে তাদের কাজটি সহজ করে দিয়েছে বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজ। এ দুই গ্রুপের ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে পাবেন এরা বাম ঘরানার লোক। কেউ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কেউ সাংবাদিক সেজে বসে আছেন। মূলত তারা আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যতিব্যস্ত।

শেখ হাসিনা ঘৃণা উৎপাদনকারী যেভাবে যা বলে; তা আপনি তৃণমূলে আওয়ামী লীগের সমর্থকের মুখেও শুনবেন। প্রপাগান্ডা তৈরিতে আওয়ামী চক্র বড় সফলতা দেখিয়েছে। ফ্যাসিবাদের আমলে সরকারের আমলারাও একই বয়ান নিয়ে হাজির হয়েছেন। দুর্ভাগ্য দেশের কোনো সেক্টর বাদ ছিল না যেখানে এর ব্যবহারকারী অসাধু চক্র ছিল অনুপস্থিত। সরকারি অফিসে যারা এ বয়ানের ফেরিওয়ালা ছিলেন তারা যতটা না আওয়ামী সমর্থক ছিলেন তার চেয়ে বেশি নানা সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নিতে এবং তাদের যত অবৈধ কর্ম আছে তা জায়েজ করতে এই বয়ান ব্যবহার করেছেন।

আওয়ামী পান্ডা পুলিশ সুপার এস এম তানভীর কুষ্টিয়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তিনি যাকে খুশি ধরে শাস্তি দিতে পারতেন। একবার এক নির্বাচনী কর্মকর্তাকে তুলে নিয়ে এসে আটকে রাখেন। তার কাছ থেকে কয়েকটি কাগজে সাইন নিয়ে নেন। এরপর তার আত্মীয়স্বজনদের অসহায় করে ফেলেন। ওই নির্বাচনী কর্মকর্তা প্রভাবশালী ছিলেন বলে খবরটি বাইরে জানাজানি হয়। আরো কত মানুষ তার দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন; এর কোনো ইয়ত্তা নেই। সে সময় এক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রকাশ্যে মারধরের পরিবেশ তৈরি করেন তিনি। তাকে লাঞ্ছিত অপমানিত করেন; যাকে খুশি অপদস্ত করছিলেন তিনি, তাকে থামাতে কেউ পারছিলেন না। কারণ তিনি ইতোমধ্যে আওয়ামী বয়ান ‘পাকিস্তানপন্থা’ ফেরি করে শক্তিশালী এক মানবে পরিণত হন। সৌভাগ্য ম্যাজিস্ট্রেট উচ্চ আদালতে তার বিরুদ্ধে প্রতিকার পান। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, তানভীরের সাথে যদি কলঙ্কিত বিচারপতি মানিকের সম্পর্ক থাকত তাহলে সে সময় ওই ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিকার পেতেন কি না, তা নিয়ে সংশয়-সন্দেহ থেকেই যায়। যা হোক, উচ্চ আদালতের এক বিচারক আদেশ দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে তানভীরের হাত থেকে উদ্ধার করেন।

ফ্যাসিস্ট আমলে সমগ্র বাংলাদেশ তানভীরের মতো শত শত পুলিশের কাছে পণবন্দী হয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় সুবিদাভোগী ও আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে পুলিশ পুরো দেশ ভাগ ভাগ করে মাফিয়া সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। কক্সবাজার অঞ্চলে এ ধরনের বড় মাফিয়া দেখতে পাই ওসি প্রদীপকে। তাকে থামানোর কোনো কর্তৃপক্ষ ছিল না বাংলাদেশে। তার মাফিয়া চক্র এতটা শক্তিশালী ছিল স্থানীয় ডিসি এসপি এবং সংসদ সদস্যরা তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। এই ক্ষমতার উৎস ছিল আওয়ামী বয়ান। যেগুলো তিনি থানায় দেয়ালে সেটে রেখেছিলেন। তবে সীমাহীন ক্ষমতা চর্চায় তার সহযোগী হয়েছে ভারত কানেকশন। খুন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা চালিয়ে ভীতি সৃষ্টি করে মূলত তারা দেশকে লুটপাট করছিলেন। ফ্যাসিস্টরা পালিয়ে যাওয়ার পর তানভীরের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তিনি গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে। স্থানীয় এক বিএনপি কর্মীকে বিচারবহির্ভূত হত্যার মামলায় আটক হয়েছেন তিনি। ওই বিএনপি কর্মীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। ভুক্তভোগী পরিবার ওই সময় মামলা করার সুযোগ পায়নি। শেখ হাসিনা পালানোর পর কেবল তার বিরুদ্ধে মামলা করা গেছে।

পুলিশ কর্মকর্তা তানভীর শুধু বিএনপির একজন কর্মীকে মেরে একটি অপরাধ করেছেন তা নয়। তার মতো যারা আছেন তারা শত শত অপরাধ করেছেন। ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে তানভীরকে দেখা গেছে, অর্ধনগ্ন হয়ে মদপান করছেন। নারী সঙ্গীও রয়েছে। ফ্যাসিবাদের সময়ে এসব পুলিশ কমকর্তা বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের সাথে জড়িত ছিলেন। এসবের মূলে ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ অর্জন ও সেগুলো পাচার। চাঁদাবাজি মাদক পাচার ভূমি দখল এমন সব অপকর্ম তাদের জন্য খুব সাধারণ ঘটনা ছিল। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে তানভীরের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরিও করা যায়নি। বিচার তো দূরের কথা; বরং শেখ হাসিনা সরকার পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছে তাকে। এই হচ্ছে ‘পাকিস্তানপন্থা’ বয়ানের জোর। তানভীরের মতো অসাধু অসংখ্য ব্যক্তি এর ব্যবহার করে পুরো দেশ নরক বানিয়ে ফেলেছিলেন।

পাকিস্তান পন্থার নতুন লাঠিয়াল

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা মাফিয়াদের উৎখাত করেছেন। মাফিয়া প্রধান ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা পালিয়ে গেছেন। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এদের সেই বয়ান আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে। অন্তর্বর্তী সরকারের এক ছাত্র উপদেষ্টা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফের ‘পাকিস্তানপন্থা’ দেখছেন। ১১ মে এক স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘৭১-এর প্রশ্নে মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে।’ যদিও তিনি দ্রুততার সাথে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। ওই স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। তবে কিছু সুযোগসন্ধানী তার স্ট্যাটাসকে তাদের সুযোগ হাসিলে ব্যবহার করেছেন।

‘পকিস্তানপন্থা’ বলে আওয়ামী সম্প্রদায় যে বয়ান চালু করে তার মধ্যে কোনো সারবত্তা কখনো ছিল না। একাত্তরের পর সময় যত গড়িয়েছে পাকিস্তান বাস্তবতা হারিয়েছে বাংলাদেশে। বন্ধুত্ব দূরে থাক, দেশটির সাথে আমরা যে শত্রুতা করব তারও সুযোগ নেই। তারা শতচেষ্টা করলেও আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমাদের চেয়ে দুই হাজার কিলোমিটার দূরে তাদের অবস্থান। মাঝখানে বিশাল দেশ ভারত। স্থলপথে পাকিস্তান পৌঁছাতে হলে তিন হাজার ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। রেলপথে সে দেশে যাওয়া আসায় আমাদের কোনো সুযোগ নেই। সাগরপথে দূরত্ব আরো বেশি। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক স্বল্প।

ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় পাকিস্তানের আমাদের কাছে কিছু পাওয়ার নেই। তার পরও আওয়ামী লীগ সবসময় পাকিস্তান নিয়ে একটা জুজুর ভয় তৈরি করে রেখেছে। এটি দিয়ে মূলত ইসলামী রাজনীতিকে দমন করেছে, তাদের পাকিস্তানি ভাবধারার বলে তকমা দিয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হয় তারাও পাকিস্তানের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেন না। বিগত কয়েক দশকে এমনটি দেখা যায়নি বাংলাদেশের ইসলামী দলের রাজনৈতিক নেতারা দলে দলে পাকিস্তান ভ্রমণ করেছেন।

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত যে বয়ান এটাও পাকিস্তানকে জড়িয়ে করা হয়। এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে এড়িয়ে যাওয়া হয় অপরাধী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কথা। যুদ্ধাপরাধের সব দায়ও ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। সশস্ত্র যুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ কিভাবে একটি বেসামরিক গোষ্ঠীর ওপর হতে পারে। এর মধ্যে এর দায়ে অভিযুক্ত করে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বকে বিচারিক হত্যা করা হয়েছে। সামরিক দায়দায়িত্ব তাদের ওপর চাপিয়ে এ অবিচার করা হয়েছে। এ অবস্থায় ‘যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে’। এমন কথা বলা অন্যায় ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

আওয়ামী বয়ানের ফেরিওয়ালারা তার স্ট্যাটাসের পক্ষে একযোগে আওয়াজ তুলেছেন। এদের মধ্যে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা, ‘মাহফুজ আলমরা নায়ক, জামায়াত চিরকাল ভিলেন’- শিরোনামে আর্টিকেল লিখে ফেলেছেন। সরকারের শীর্ষ পদে থেকে এমন অপরিণামদর্শী স্ট্যাটাসের পরও তা নিয়ে জামায়াত প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। দলটির শীর্ষ নেতারা বরং তাদের নেতাকর্মীদের ধৈর্যধারণের পরামর্শ দিয়েছেন। এ দিকে উপদেষ্টা মাহফুজ তার ভুল বুঝতে পেরে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কিন্তু মোর্তোজা তার ঘৃণাসৃষ্টিকারী পাকিস্তানপন্থার বয়ান সরাননি, দুঃখ প্রকাশ করেননি।

এ দিকে মাহফুজ ২২ মে আরেক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘আগেকার যেকোনো বক্তব্য ও শব্দচয়ন, যা বিভাজনমূলক ছিল- সেগুলোর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সরকারে আর এক দিনও থাকলে অভ্যুত্থানের সব শক্তির প্রতি সম্মান ও সংবেদনশীলতা রেখে কাজ করতে চাই। পুরাতন বন্দোবস্তের বিভেদকামী স্লোগান ও তকমাবাজি, যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে হত্যাযোগ্য করে তোলে, সেগুলো পরিহার করলেই আশা করি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে। বাংলাদেশের শত্রুরা ঐক্যবদ্ধ ও আগ্রাসী। সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে। দেশপ্রেমিক জনগণ যারা জুলাই অভ্যুত্থানে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, তাদের সামনে দীর্ঘ পরীক্ষা। এ পরীক্ষা ঐক্যের ও ধৈর্যের। এ পরীক্ষা উতরে যেতেই হবে।’

অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে আওয়ামী বয়ান ‘পাকিস্তানপন্থা’ কতটা ভয়াবহ মাহফুজ সেটা যে সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছেন এ স্ট্যাটাসে তা স্পষ্ট। সুযোগসন্ধানী গোলাম মোর্তোজারা ঘাপটি মেরে বসে আছেন আবার কিভাবে ভিন্ন পোশাকে আওয়ামী রাজত্ব ফিরিয়ে আনা যায়। সুযোগ পেলে তারা বিপ্লবী শক্তিগুলোর মধ্যে ফাটল ধরানোর কাজটি করবেন। একজন সচিব মর্যাদায় প্রেস মিনিস্টার বানানোর জন্য কিভাবে তাকে বিবেচনা করা হয়েছে বোঝা মুশকিল। তিনি ডেইলি স্টারে কাজ করেছেন এটিই কী তার একমাত্র যোগ্যতা। এর আগে স্টার গ্রুপের সাপ্তাহিক ২০০০-এ কাজ করার সময় দাউদ হায়দারের লেখা ছেপে বিতর্কিত হন তিনি। পত্রিকার ওই সংখ্যাটি সরকার বাজেয়াপ্ত করে।

একইভাবে লন্ডনে প্রেস মিনিস্টার পদে বসিয়ে দেয়া হয়েছে বিবিসির আকবর হোসেনকে। তিনিও ডেইলি স্টারের সাবেক কর্মী। পাকিস্তানপন্থা নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়ার পর তিনিও মাহফুজের স্তুতি করে স্ট্যাটাস দেন। ফ্যাসিবাদের পুরো সময় তিনি বিবিসিতে কাজ করেছেন। এ সময় দেশে চলা গুম খুন নিয়ে বিবিসিতে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যাবেন না। হিন্দুত্ববাদ আর হাসিনাকে নিয়ে মাতামাতি এ সময় বিবিসিকে বিতর্কিত করেছে, এর বিশ্বাসযোগ্যতা এখন তলানিতে রয়েছে। বিবিসি এখনকার প্রতিবেদন দেখলে বোঝা যায় তারা আওয়ামী শোকে কাতর।

গোলাম মোর্তোজা আগাগোড়া আওয়ামী ঘরানার লোক। বিপ্লবের আগে অল্প কিছু দিন তিনি ফ্যাসিবাদের মৃদু সমালোচনা করেন। সেটাকে ব্যবহার করে তিনি নিজেকে অন্যতম সিপাহসালার রুপে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। এর পুরস্কার প্রেস মিনিস্টার পদটি তিনি বাগিয়ে নিয়েছেন। তিনি কতটা হাসিনাভক্ত ২০২২ সালে দেয়া তার এক স্ট্যাটাসে সেটা পরিষ্কার। লিখেছেন, ‘পদ্মা সেতু কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, পদ্মা সেতু কারো ব্যক্তিগত অর্থে হয়নি, তবে পদ্মা সেতু শতভাগ ব্যক্তিগত উদ্যোগে-উদ্যমে হয়েছে। পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান পিলার ৪২টি। আসলে পদ্মা সেতুর পিলার ৪২টি নয়, পিলার মূলত একটি। সেই পিলারটির নাম শেখ হাসিনা।’

পাকিস্তান পন্থার নতুন লাঠিয়ালদের থমানো না গেলে বিপদ। অচিরেই তারা বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশকে হাসিনার বাংলাদেশে রূপান্তর করবে।

(সূত্রঃ দৈনিক নয়া দিগন্ত)
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

অর্থনীতি নিয়ে রোডম্যাপ না থাকায় হতবাক হয়েছি

‘পাকিস্তানপন্থা’ : একটি ধারালো অস্ত্র

আপডেট সময় : ০২:৫১:৩৮ অপরাহ্ণ, বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫

|| জসিম উদ্দিন ||

কুষ্টিয়ার এক পুলিশ সুপার নাগরিকদের বলেছিলেন, ‘পেয়ারা পাকিস্তানে চলে যাও’। ওই পুলিশ কর্মকর্তা একদল মানুষকে শত্রু গণ্য করছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রের নিয়ম অনুযায়ী তিনি তাদের কোনোভাবে শাস্তিযোগ্য করতে পারছিলেন না। আওয়ামী প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং নিজের উদ্দেশ্য হাসিলে তাকে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সে জন্য তিনি ‘পাকিস্তান’ শব্দটি কলঙ্ক তিলক হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে জুড়ে দেন ।

দেশের মানুষকে দমিয়ে রাখতে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের একটি বয়ান ছিল ‘পাকিস্তানপন্থা’। এ বয়ানের বিশেষত্ব ছিল এটি প্রয়োগ করা হতো আলেম ওলামা ইসলামী দল ও মাদরাসাসংশ্লিষ্টদের একটি সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ওপর। পাকিস্তান রাষ্ট্রকে বাংলাদেশে ধর্মীয় গোঁড়ামি, পশ্চাৎপদতা ও জঙ্গিবাদের প্রতীক হিসেবে তারা দেখাতে চাইত। অতএব, যে কাউকে এ তকমা এঁটে দেয়া হলে তার রেহাই ছিল না। তার সম্পদ সম্মান লুণ্ঠন জায়েজ হয়ে যেত; তার জীবন হত্যাযোগ্য হয়ে যেত।

ঘটনাটি ২০২০ সালের। কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার ছিলেন এস এম তানভীর আরাফাত। তিনি স্থানীয় এক আওয়ামী সংগঠনের আয়োজিত অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ বক্তা ছিলেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পক্ষে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। যারা শেখ মুজিবকে জাতির পিতা মানেন না, তাদের জন্য তিনটি বিকল্প দেন। ১. তাদের হাত ভেঙে দেয়া হবে, জেল খাটতে হবে ২. বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না এবং ৩. বাংলাদেশ যদি পছন্দ না হয়, তাহলে ‘ইউ আর ওয়েলকাম টু গো ইউর পেয়ারে পাকিস্তান’। তিনি ওই ভাষণে আরো কিছু অত্যন্ত আপত্তিকর কথা বলেন। তার মতে, মেধাহীনদের মাদরাসায় পড়ানো হয়। তারা বিনা পয়সায় পড়ে, ‘আমাদের’ টাকায় চলে। বঙ্গবন্ধুকে কেন জাতির পিতা বলছেন না, এর কারণ হচ্ছে আপনারা রাজাকার আলবদর আলসামসের পৌত্র ও সন্তান। মৌলবাদীদের এ দেশে দরকার নেই। তানভীরের এ বক্তব্য আসলে আওয়ামী লীগের বয়ান ‘পাকিস্তানপন্থা’র সারকথা। একটি সুনির্দিষ্ট বর্গের বিরুদ্ধে এটি ব্যবহার হয় তাদের অধিকারহীন করতে।

জাতির মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টিকারী বয়ান আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল অসাধু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে দিয়ে; যাদের অনেকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে তা অনায়াসে করেছে। সেতুবন্ধন হিসেবে তাদের কাজটি সহজ করে দিয়েছে বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজ। এ দুই গ্রুপের ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে পাবেন এরা বাম ঘরানার লোক। কেউ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কেউ সাংবাদিক সেজে বসে আছেন। মূলত তারা আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যতিব্যস্ত।

শেখ হাসিনা ঘৃণা উৎপাদনকারী যেভাবে যা বলে; তা আপনি তৃণমূলে আওয়ামী লীগের সমর্থকের মুখেও শুনবেন। প্রপাগান্ডা তৈরিতে আওয়ামী চক্র বড় সফলতা দেখিয়েছে। ফ্যাসিবাদের আমলে সরকারের আমলারাও একই বয়ান নিয়ে হাজির হয়েছেন। দুর্ভাগ্য দেশের কোনো সেক্টর বাদ ছিল না যেখানে এর ব্যবহারকারী অসাধু চক্র ছিল অনুপস্থিত। সরকারি অফিসে যারা এ বয়ানের ফেরিওয়ালা ছিলেন তারা যতটা না আওয়ামী সমর্থক ছিলেন তার চেয়ে বেশি নানা সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নিতে এবং তাদের যত অবৈধ কর্ম আছে তা জায়েজ করতে এই বয়ান ব্যবহার করেছেন।

আওয়ামী পান্ডা পুলিশ সুপার এস এম তানভীর কুষ্টিয়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তিনি যাকে খুশি ধরে শাস্তি দিতে পারতেন। একবার এক নির্বাচনী কর্মকর্তাকে তুলে নিয়ে এসে আটকে রাখেন। তার কাছ থেকে কয়েকটি কাগজে সাইন নিয়ে নেন। এরপর তার আত্মীয়স্বজনদের অসহায় করে ফেলেন। ওই নির্বাচনী কর্মকর্তা প্রভাবশালী ছিলেন বলে খবরটি বাইরে জানাজানি হয়। আরো কত মানুষ তার দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন; এর কোনো ইয়ত্তা নেই। সে সময় এক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রকাশ্যে মারধরের পরিবেশ তৈরি করেন তিনি। তাকে লাঞ্ছিত অপমানিত করেন; যাকে খুশি অপদস্ত করছিলেন তিনি, তাকে থামাতে কেউ পারছিলেন না। কারণ তিনি ইতোমধ্যে আওয়ামী বয়ান ‘পাকিস্তানপন্থা’ ফেরি করে শক্তিশালী এক মানবে পরিণত হন। সৌভাগ্য ম্যাজিস্ট্রেট উচ্চ আদালতে তার বিরুদ্ধে প্রতিকার পান। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, তানভীরের সাথে যদি কলঙ্কিত বিচারপতি মানিকের সম্পর্ক থাকত তাহলে সে সময় ওই ম্যাজিস্ট্রেট প্রতিকার পেতেন কি না, তা নিয়ে সংশয়-সন্দেহ থেকেই যায়। যা হোক, উচ্চ আদালতের এক বিচারক আদেশ দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে তানভীরের হাত থেকে উদ্ধার করেন।

ফ্যাসিস্ট আমলে সমগ্র বাংলাদেশ তানভীরের মতো শত শত পুলিশের কাছে পণবন্দী হয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় সুবিদাভোগী ও আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে পুলিশ পুরো দেশ ভাগ ভাগ করে মাফিয়া সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। কক্সবাজার অঞ্চলে এ ধরনের বড় মাফিয়া দেখতে পাই ওসি প্রদীপকে। তাকে থামানোর কোনো কর্তৃপক্ষ ছিল না বাংলাদেশে। তার মাফিয়া চক্র এতটা শক্তিশালী ছিল স্থানীয় ডিসি এসপি এবং সংসদ সদস্যরা তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। এই ক্ষমতার উৎস ছিল আওয়ামী বয়ান। যেগুলো তিনি থানায় দেয়ালে সেটে রেখেছিলেন। তবে সীমাহীন ক্ষমতা চর্চায় তার সহযোগী হয়েছে ভারত কানেকশন। খুন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা চালিয়ে ভীতি সৃষ্টি করে মূলত তারা দেশকে লুটপাট করছিলেন। ফ্যাসিস্টরা পালিয়ে যাওয়ার পর তানভীরের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তিনি গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে। স্থানীয় এক বিএনপি কর্মীকে বিচারবহির্ভূত হত্যার মামলায় আটক হয়েছেন তিনি। ওই বিএনপি কর্মীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। ভুক্তভোগী পরিবার ওই সময় মামলা করার সুযোগ পায়নি। শেখ হাসিনা পালানোর পর কেবল তার বিরুদ্ধে মামলা করা গেছে।

পুলিশ কর্মকর্তা তানভীর শুধু বিএনপির একজন কর্মীকে মেরে একটি অপরাধ করেছেন তা নয়। তার মতো যারা আছেন তারা শত শত অপরাধ করেছেন। ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে তানভীরকে দেখা গেছে, অর্ধনগ্ন হয়ে মদপান করছেন। নারী সঙ্গীও রয়েছে। ফ্যাসিবাদের সময়ে এসব পুলিশ কমকর্তা বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের সাথে জড়িত ছিলেন। এসবের মূলে ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ অর্জন ও সেগুলো পাচার। চাঁদাবাজি মাদক পাচার ভূমি দখল এমন সব অপকর্ম তাদের জন্য খুব সাধারণ ঘটনা ছিল। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে তানভীরের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরিও করা যায়নি। বিচার তো দূরের কথা; বরং শেখ হাসিনা সরকার পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছে তাকে। এই হচ্ছে ‘পাকিস্তানপন্থা’ বয়ানের জোর। তানভীরের মতো অসাধু অসংখ্য ব্যক্তি এর ব্যবহার করে পুরো দেশ নরক বানিয়ে ফেলেছিলেন।

পাকিস্তান পন্থার নতুন লাঠিয়াল

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা মাফিয়াদের উৎখাত করেছেন। মাফিয়া প্রধান ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা পালিয়ে গেছেন। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এদের সেই বয়ান আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে। অন্তর্বর্তী সরকারের এক ছাত্র উপদেষ্টা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফের ‘পাকিস্তানপন্থা’ দেখছেন। ১১ মে এক স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘৭১-এর প্রশ্নে মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে।’ যদিও তিনি দ্রুততার সাথে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। ওই স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। তবে কিছু সুযোগসন্ধানী তার স্ট্যাটাসকে তাদের সুযোগ হাসিলে ব্যবহার করেছেন।

‘পকিস্তানপন্থা’ বলে আওয়ামী সম্প্রদায় যে বয়ান চালু করে তার মধ্যে কোনো সারবত্তা কখনো ছিল না। একাত্তরের পর সময় যত গড়িয়েছে পাকিস্তান বাস্তবতা হারিয়েছে বাংলাদেশে। বন্ধুত্ব দূরে থাক, দেশটির সাথে আমরা যে শত্রুতা করব তারও সুযোগ নেই। তারা শতচেষ্টা করলেও আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমাদের চেয়ে দুই হাজার কিলোমিটার দূরে তাদের অবস্থান। মাঝখানে বিশাল দেশ ভারত। স্থলপথে পাকিস্তান পৌঁছাতে হলে তিন হাজার ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। রেলপথে সে দেশে যাওয়া আসায় আমাদের কোনো সুযোগ নেই। সাগরপথে দূরত্ব আরো বেশি। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক স্বল্প।

ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় পাকিস্তানের আমাদের কাছে কিছু পাওয়ার নেই। তার পরও আওয়ামী লীগ সবসময় পাকিস্তান নিয়ে একটা জুজুর ভয় তৈরি করে রেখেছে। এটি দিয়ে মূলত ইসলামী রাজনীতিকে দমন করেছে, তাদের পাকিস্তানি ভাবধারার বলে তকমা দিয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হয় তারাও পাকিস্তানের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেন না। বিগত কয়েক দশকে এমনটি দেখা যায়নি বাংলাদেশের ইসলামী দলের রাজনৈতিক নেতারা দলে দলে পাকিস্তান ভ্রমণ করেছেন।

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত যে বয়ান এটাও পাকিস্তানকে জড়িয়ে করা হয়। এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে এড়িয়ে যাওয়া হয় অপরাধী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কথা। যুদ্ধাপরাধের সব দায়ও ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। সশস্ত্র যুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ কিভাবে একটি বেসামরিক গোষ্ঠীর ওপর হতে পারে। এর মধ্যে এর দায়ে অভিযুক্ত করে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বকে বিচারিক হত্যা করা হয়েছে। সামরিক দায়দায়িত্ব তাদের ওপর চাপিয়ে এ অবিচার করা হয়েছে। এ অবস্থায় ‘যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে’। এমন কথা বলা অন্যায় ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

আওয়ামী বয়ানের ফেরিওয়ালারা তার স্ট্যাটাসের পক্ষে একযোগে আওয়াজ তুলেছেন। এদের মধ্যে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা, ‘মাহফুজ আলমরা নায়ক, জামায়াত চিরকাল ভিলেন’- শিরোনামে আর্টিকেল লিখে ফেলেছেন। সরকারের শীর্ষ পদে থেকে এমন অপরিণামদর্শী স্ট্যাটাসের পরও তা নিয়ে জামায়াত প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। দলটির শীর্ষ নেতারা বরং তাদের নেতাকর্মীদের ধৈর্যধারণের পরামর্শ দিয়েছেন। এ দিকে উপদেষ্টা মাহফুজ তার ভুল বুঝতে পেরে বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কিন্তু মোর্তোজা তার ঘৃণাসৃষ্টিকারী পাকিস্তানপন্থার বয়ান সরাননি, দুঃখ প্রকাশ করেননি।

এ দিকে মাহফুজ ২২ মে আরেক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘আগেকার যেকোনো বক্তব্য ও শব্দচয়ন, যা বিভাজনমূলক ছিল- সেগুলোর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সরকারে আর এক দিনও থাকলে অভ্যুত্থানের সব শক্তির প্রতি সম্মান ও সংবেদনশীলতা রেখে কাজ করতে চাই। পুরাতন বন্দোবস্তের বিভেদকামী স্লোগান ও তকমাবাজি, যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে হত্যাযোগ্য করে তোলে, সেগুলো পরিহার করলেই আশা করি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে। বাংলাদেশের শত্রুরা ঐক্যবদ্ধ ও আগ্রাসী। সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে। দেশপ্রেমিক জনগণ যারা জুলাই অভ্যুত্থানে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, তাদের সামনে দীর্ঘ পরীক্ষা। এ পরীক্ষা ঐক্যের ও ধৈর্যের। এ পরীক্ষা উতরে যেতেই হবে।’

অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে আওয়ামী বয়ান ‘পাকিস্তানপন্থা’ কতটা ভয়াবহ মাহফুজ সেটা যে সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছেন এ স্ট্যাটাসে তা স্পষ্ট। সুযোগসন্ধানী গোলাম মোর্তোজারা ঘাপটি মেরে বসে আছেন আবার কিভাবে ভিন্ন পোশাকে আওয়ামী রাজত্ব ফিরিয়ে আনা যায়। সুযোগ পেলে তারা বিপ্লবী শক্তিগুলোর মধ্যে ফাটল ধরানোর কাজটি করবেন। একজন সচিব মর্যাদায় প্রেস মিনিস্টার বানানোর জন্য কিভাবে তাকে বিবেচনা করা হয়েছে বোঝা মুশকিল। তিনি ডেইলি স্টারে কাজ করেছেন এটিই কী তার একমাত্র যোগ্যতা। এর আগে স্টার গ্রুপের সাপ্তাহিক ২০০০-এ কাজ করার সময় দাউদ হায়দারের লেখা ছেপে বিতর্কিত হন তিনি। পত্রিকার ওই সংখ্যাটি সরকার বাজেয়াপ্ত করে।

একইভাবে লন্ডনে প্রেস মিনিস্টার পদে বসিয়ে দেয়া হয়েছে বিবিসির আকবর হোসেনকে। তিনিও ডেইলি স্টারের সাবেক কর্মী। পাকিস্তানপন্থা নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়ার পর তিনিও মাহফুজের স্তুতি করে স্ট্যাটাস দেন। ফ্যাসিবাদের পুরো সময় তিনি বিবিসিতে কাজ করেছেন। এ সময় দেশে চলা গুম খুন নিয়ে বিবিসিতে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যাবেন না। হিন্দুত্ববাদ আর হাসিনাকে নিয়ে মাতামাতি এ সময় বিবিসিকে বিতর্কিত করেছে, এর বিশ্বাসযোগ্যতা এখন তলানিতে রয়েছে। বিবিসি এখনকার প্রতিবেদন দেখলে বোঝা যায় তারা আওয়ামী শোকে কাতর।

গোলাম মোর্তোজা আগাগোড়া আওয়ামী ঘরানার লোক। বিপ্লবের আগে অল্প কিছু দিন তিনি ফ্যাসিবাদের মৃদু সমালোচনা করেন। সেটাকে ব্যবহার করে তিনি নিজেকে অন্যতম সিপাহসালার রুপে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। এর পুরস্কার প্রেস মিনিস্টার পদটি তিনি বাগিয়ে নিয়েছেন। তিনি কতটা হাসিনাভক্ত ২০২২ সালে দেয়া তার এক স্ট্যাটাসে সেটা পরিষ্কার। লিখেছেন, ‘পদ্মা সেতু কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, পদ্মা সেতু কারো ব্যক্তিগত অর্থে হয়নি, তবে পদ্মা সেতু শতভাগ ব্যক্তিগত উদ্যোগে-উদ্যমে হয়েছে। পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান পিলার ৪২টি। আসলে পদ্মা সেতুর পিলার ৪২টি নয়, পিলার মূলত একটি। সেই পিলারটির নাম শেখ হাসিনা।’

পাকিস্তান পন্থার নতুন লাঠিয়ালদের থমানো না গেলে বিপদ। অচিরেই তারা বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশকে হাসিনার বাংলাদেশে রূপান্তর করবে।

(সূত্রঃ দৈনিক নয়া দিগন্ত)