শিরোনাম :
Logo ‘মার্চ ফর গাজা’ ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ Logo আউটসোর্সিং সেবা গ্রহণ নীতিমালা জারি Logo বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে: সেলিম উদ্দিন Logo কুয়েটে বহিষ্কারাদেশ থেকে নির্দোষ শিক্ষার্থীদের অব্যাহতির দাবি শিবিরের Logo আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাই প্রথম সংস্কার, বললেন ববি হাজ্জাজ Logo নারীদের স্বাস্থ্যের জন্য কয়টি সন্তান ভালো, যা বলছেন গবেষকরা Logo সানস্ক্রিন নাকি ময়েশ্চারাইজার, প্রথমে কোনটি মাখা উচিত Logo শত শত নারীকে স্বাবলম্বী করেছেন চাঁদপুরের বিজয়ী কন্যা তানিয়া ইশতিয়াক খান Logo সাড়া ফেলেছে জুলাই বিপ্লব নিয়ে রাবি শিক্ষার্থীর নির্মিত শর্টফিল্ম ‘মাদারল্যান্ড অর ডেথ ‘ Logo আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে চাঁদপুর জেলা কারাগারে বাংলা নববর্ষকে বরণ

জিওগেমে বাংলাদেশ

  • সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৬:২৮:০৩ অপরাহ্ণ, শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫
  • ৭২৩ বার পড়া হয়েছে

|| মোস্তফা কামাল ||

কানে পানি না গেলে বা চোখে ছানি না পড়লে কারো পক্ষে বোঝা কঠিন নয় যে বাংলাদেশ এখন বিশ্বরাজনীতির দ্য গ্রেট গেম প্ল্যানিংয়ের শুধু দর্শক নয়, গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন তথা প্লেয়ারও! এর কারণ গ্লোবাল জিওপলিটিকস ও ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান। আসছে দিনগুলো অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার লড়াইয়ের সন্ধিক্ষণও। তা আরো স্বচ্ছ বা পরিষ্কার হবে কিছুদিনের মধ্যেই। তখন হাড়ে হাড়ে মালুম হবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের স্মারক সশস্ত্র বাহিনীর কী উপযোগিতা? কেবল দলীয় রাজনীতি আর ক্ষমতা নিয়ে ব্যস্ত থাকাদের তখন নতুন উপলব্ধি হবে। বুঝবেন দেশের গ্লোবাল পজিশনিং নির্ধারণ কাকে বলে!

সেই জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন সুচতুররা তাই আগাম কাজ হিসেবে এবারের পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনীর জনসম্পৃক্ততার মেলবন্ধনে মাঝেমধ্যেই খোঁচা দিচ্ছে। ফাঁদ পেতে রেখেছেই বাহিনীটির অনন্য নজিরকে বানচাল করার। কেউ দেশে, কেউ ভিনদেশে বসে এই খোঁচায় শরিক হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভর করে ছড়াচ্ছে বাহিনী ও বাহিনী প্রধানকে নিয়ে কিচ্ছা।

তাদের রিচ, হিট বা ভাইরাল হওয়া দিয়ে কথা। যখন যেটি সামনে পায়, সেটি নিয়েই কনটেন্ট ব্যবসার কনটেইনার খোলা এই চক্রবিশেষ অপ্রাসঙ্গিক-অবান্তরভাবে সেনাবাহিনীকেও টেনে আনছে।  সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নামাজ পড়েন কেন, নামাজ পড়ান কেন, কথা বলার সময় আঙুল তোলেন কেন, চোখ ঘোরান কেন, চশমার ফাঁক দিয়ে দেখেন কেন, এত সতর্ক করেন কেন, সরকারপ্রধানকে নাম ধরে ডাকেন কেন—এ রকম বহু কেন তাদের। প্রতিটি কেন দিয়েই সাবজেক্ট, আইটেম, কনটেন্টের হাটবাজার।

তাদের উদ্দেশ এরই মধ্যে পরিষ্কার। দুর্বল সেনাবাহিনী ভীষণ কাম্য তাদের কাছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্রমেই শক্ত-সামর্থ্যবান হয়ে ওঠা, জনসম্পৃক্ততা, বাহিনীতে এবং দেশে সেনাপ্রধানের জনপ্রিয়তা তাদের কাছে বেশ অ্যালার্মিং। তাঁর নেতৃত্বে গ্লোবাল জিওপলিটিকস ও ইন্টারন্যাশনাল গ্রেট গেমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বড় ফ্যাক্টর হয়ে ওঠার একটি রিহার্সাল হয়ে গেছে এবারের জুলাই-আগস্টে, যা দেশবিরোধী শক্তির কাছে অসহ্য। পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডাররা যখন গুলি করে ছাত্র-জনতাকে মেরেছে, সেনাবাহিনী তখন শুধু ‘নো ফায়ার’ নীতিই নেয়নি, আহত হাজার হাজারকে সিএমএইচে চিকিত্সা দিয়েছে। শত শত জনকে মেজর-মাইনর অপারেশন করেছে।

তাদের উদ্দেশ এরই মধ্যে পরিষ্কার। দুর্বল সেনাবাহিনী ভীষণ কাম্য তাদের কাছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্রমেই শক্ত-সামর্থ্যবান হয়ে ওঠা, জনসম্পৃক্ততা, বাহিনীতে এবং দেশে সেনাপ্রধানের জনপ্রিয়তা তাদের কাছে বেশ অ্যালার্মিং। তাঁর নেতৃত্বে গ্লোবাল জিওপলিটিকস ও ইন্টারন্যাশনাল গ্রেট গেমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বড় ফ্যাক্টর হয়ে ওঠার একটি রিহার্সাল হয়ে গেছে এবারের জুলাই-আগস্টে, যা দেশবিরোধী শক্তির কাছে অসহ্য। পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডাররা যখন গুলি করে ছাত্র-জনতাকে মেরেছে, সেনাবাহিনী তখন শুধু ‘নো ফায়ার’ নীতিই নেয়নি, আহত হাজার হাজারকে সিএমএইচে চিকিত্সা দিয়েছে।

সেনাবাহিনীকে মাঠ থেকে সরানো হয় না কেন, এ অপেক্ষা কারো কারো। সেনাবাহিনী মাঠ থেকে সরালে কী দশা হবে, এ তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে। তারা কি না করবে, সেই প্রস্তুতি নিয়ে সংঘবদ্ধ হচ্ছে। সেনা সদস্যদের মাঠ থেকে সরালে গোটা দেশকে গোপালগঞ্জ বানিয়ে দেওয়ার হুংকার-প্রস্তুতি তো রয়েছেই। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পরিসংখ্যানগতভাবে অবনতি না হলেও নানা ঘটনা সেনাবাহিনীর নজরদারির বাইরে নয়। পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে তারা কাজ করছে। অবৈধ অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার, বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, মাদক কারবারিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের গ্রেপ্তারে অংশীজন হচ্ছে পেশাদারির সঙ্গে।দেশে একান্নবর্তী পরিবারের মতো রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতিতে সম্পৃক্তরা তা বুঝতে পারছেন। কিন্তু তাঁদের সবাই ফাংশনেবল জায়গায় নেই। অনেক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে চলছে পুরো দেশ। এখানে আবেগ বা উত্তেজনার বশবর্তী হওয়ার সুযোগ নেই। রাজনীতি-কূটনীতিতে কিছু বেসিক নর্মস মানতে হয়। অনেক কথা হয়, অনেক শলাপরামর্শ হয়, গোপনে প্রকাশ্যে নানা ধরনের বৈঠক হয়। এর মধ্যে কিছু থাকে একেবারেই কনফিডেনশিয়াল। সমঝোতা হোক বা না হোক, এসবের বিষয়বস্তু গোপনই রাখতে হয়। এটি হচ্ছে শিষ্টাচার এবং বিশ্বস্ততা রক্ষার বিষয়। তা যে ভঙ্গ করে, তার ক্রেডিবিলিটি নষ্ট হয়ে যায়। বিশ্বস্ততা উঠে যায়। অবিশ্বস্ত লোক কখনো আর কারো আস্থাভাজন হতে পারে না। নিজ দেশের সেনাবাহিনীকে হেয় করা কোনো বীরত্বের কাজ নয়, তা এক ধরনের বেয়াকুবি। এই প্রতিষ্ঠানটিকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে চাই, ভালোবাসার জায়গায় দেখতে চাই। এ ছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে সামর্থ্যবান-চৌকস। তাদের মনোবল ভাঙলে বা ডিস্টার্বে রাখলে কে লাভবান হবে, সেই বোধবুদ্ধি জরুরি। সময়টি অ্যাডভেঞ্চারিজমের নয়।

সেনাবাহিনী বা এর প্রধান কী চান, তা বুঝতে তাঁর অফিসে-বাসায় যাতায়াত বা আড়ি পাতার দরকার পড়ে না। ক্ষমতা চাইলে তিনি সেটি কবেই নিতে পারতেন। তিনি যত দ্রুত সম্ভব বা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে অ্যাডামেন্ট। প্রথম থেকেই আর্লি ইলেকশন ও ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশনের পক্ষে। প্রায় একই মানসিকতা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসেরও। ক্ষমতা চাইলে তিনিও সেই কবেই মসনদে বসতে পারতেন। বর্তমান সময়টা বড় প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আঞ্চলিক কূটনীতি তাঁদের নখদর্পণে। প্রতিবেশী, নিকট প্রতিবেশীই নয়, আরো অনেকের কাছে এই ছোট বাংলাদেশ একটি বড় সাবজেক্ট। এর অবজেক্টও বিস্তর। সেখানে চলে অনেক বড় ধরনের গেম। এ রকম সময়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র কাণ্ডারি সশস্ত্র বাহিনী একটি বড় ফ্যাক্টর। তাদের নিয়ে কুত্সা বা বন্দনার অতি মাতামাতি কোনোটিই কাম্য নয়।

ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তা উগান্ডা-রুয়ান্ডার মতো দেশের জন্যও জরুরি। বিশ্বের সুপার পাওয়ার হতে আকাঙ্ক্ষী চাণক্য কূটনীতির প্রতিবেশী ভারতের কাছে বাংলাদেশ অত্যন্ত দামি। স্বাভাবিকভাবেই এখানে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার হেন চেষ্টা নেই, যা তারা না করবে। এটি তাদের দোষ বা গুণের বিষয় নয়। আবার চীন সফরও ছিল বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার জন্য জরুরি। বিমসটেক সম্মেলনে যাওয়া, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকটিও ছিল আকাঙ্ক্ষিত। যেমন আকাঙ্খিত বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্মেলন করা। ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি, গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা প্রকাশও জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক কূটনীতিও আবশ্যক। রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মায়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এগুলোর একটি বাদ দিয়ে আরেকটি নয়। একটির গুরুত্ব আরেকটির সঙ্গে তুলনার বিষয়ও নয়। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের যে কারো পক্ষেই উপলব্ধিযোগ্য যে স্থানিক রাজনীতির বাইরেও বৈশ্বিক কোন সন্ধিক্ষণে এখন বাংলাদেশ, যেখানে সেনাবাহিনী কত প্রাসঙ্গিক!

সেনাপ্রধানের ওপর কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর রাগ থাকতেই পারে। তাঁর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী আগস্টে নিরীহ মানুষের ওপর বন্দুক চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, তা তো সবার পছন্দ নয়। অন্য একটি গোষ্ঠীর রাগের কারণটি ভিন্ন। তিনি নিজেদের মাঝে কামড়াকামড়ি করতে নিষেধ করেছেন। ফলে তাদের পানি ঘোলা করে মাছ শিকারের পথে বাধা হয়ে গেছে। অবস্থা কোথায় গেলে জেনারেল ওয়াকার কোনো রাখঢাক না রেখে সরাসরি কথাগুলো বলেছেন। রাজনীতিক বা কূটনীতিকদের মতো ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে, চিবিয়ে  তিতার  ওপর মিষ্টি মাখিয়ে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন, সতর্ক না হলে সবার কপালে খারাপি আছে। পরে যেন তাঁকে সতর্ক না করার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা না হয়, সে কথাও বলেছেন। কথা কি আরো বেশি বলতে হয়? ইশারা নয়, কথায়ও কেউ কাফি বোধ না করলে বিকল্প আর কী থাকে?

সামরিক বাহিনীর প্রধান কাজ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। সার্বভৌমের ওপর হুমকি আসে দুই ভাবে। একটি সরাসরি বাইরের আক্রমণ, অন্যটি অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা গৃহযুদ্ধের ফলে নিরাপত্তা বিঘ্নিতজনিত হুমকি। দ্বিতীয় কারণে দেশের অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, রাজনৈতিক কাঠামো, আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। ফলে সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে। তিনি সেই কথাটিই দ্ব্যর্থহীনভাবে উচ্চারণ করেছেন। মাস কয়েকের ব্যবধানে কয়েক দিন ধরে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলসহ বৈশ্বিক নানা ঘটনায় কি দেখা যাচ্ছে না কেবল দুইভাবে নয়, আরো কতভাবে সার্বভৌমত্ব ও দেশপ্রেমিক চৌকস সেনাবাহিনীর কী আবশ্যকতা? ভূ-রাজনীতির কোন স্কেলে আমরা? আর আমাদের সতর্ক হওয়া কত জরুরি?

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

‘মার্চ ফর গাজা’ ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ

জিওগেমে বাংলাদেশ

আপডেট সময় : ০৬:২৮:০৩ অপরাহ্ণ, শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫

|| মোস্তফা কামাল ||

কানে পানি না গেলে বা চোখে ছানি না পড়লে কারো পক্ষে বোঝা কঠিন নয় যে বাংলাদেশ এখন বিশ্বরাজনীতির দ্য গ্রেট গেম প্ল্যানিংয়ের শুধু দর্শক নয়, গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন তথা প্লেয়ারও! এর কারণ গ্লোবাল জিওপলিটিকস ও ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান। আসছে দিনগুলো অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার লড়াইয়ের সন্ধিক্ষণও। তা আরো স্বচ্ছ বা পরিষ্কার হবে কিছুদিনের মধ্যেই। তখন হাড়ে হাড়ে মালুম হবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের স্মারক সশস্ত্র বাহিনীর কী উপযোগিতা? কেবল দলীয় রাজনীতি আর ক্ষমতা নিয়ে ব্যস্ত থাকাদের তখন নতুন উপলব্ধি হবে। বুঝবেন দেশের গ্লোবাল পজিশনিং নির্ধারণ কাকে বলে!

সেই জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন সুচতুররা তাই আগাম কাজ হিসেবে এবারের পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনীর জনসম্পৃক্ততার মেলবন্ধনে মাঝেমধ্যেই খোঁচা দিচ্ছে। ফাঁদ পেতে রেখেছেই বাহিনীটির অনন্য নজিরকে বানচাল করার। কেউ দেশে, কেউ ভিনদেশে বসে এই খোঁচায় শরিক হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভর করে ছড়াচ্ছে বাহিনী ও বাহিনী প্রধানকে নিয়ে কিচ্ছা।

তাদের রিচ, হিট বা ভাইরাল হওয়া দিয়ে কথা। যখন যেটি সামনে পায়, সেটি নিয়েই কনটেন্ট ব্যবসার কনটেইনার খোলা এই চক্রবিশেষ অপ্রাসঙ্গিক-অবান্তরভাবে সেনাবাহিনীকেও টেনে আনছে।  সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান নামাজ পড়েন কেন, নামাজ পড়ান কেন, কথা বলার সময় আঙুল তোলেন কেন, চোখ ঘোরান কেন, চশমার ফাঁক দিয়ে দেখেন কেন, এত সতর্ক করেন কেন, সরকারপ্রধানকে নাম ধরে ডাকেন কেন—এ রকম বহু কেন তাদের। প্রতিটি কেন দিয়েই সাবজেক্ট, আইটেম, কনটেন্টের হাটবাজার।

তাদের উদ্দেশ এরই মধ্যে পরিষ্কার। দুর্বল সেনাবাহিনী ভীষণ কাম্য তাদের কাছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্রমেই শক্ত-সামর্থ্যবান হয়ে ওঠা, জনসম্পৃক্ততা, বাহিনীতে এবং দেশে সেনাপ্রধানের জনপ্রিয়তা তাদের কাছে বেশ অ্যালার্মিং। তাঁর নেতৃত্বে গ্লোবাল জিওপলিটিকস ও ইন্টারন্যাশনাল গ্রেট গেমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বড় ফ্যাক্টর হয়ে ওঠার একটি রিহার্সাল হয়ে গেছে এবারের জুলাই-আগস্টে, যা দেশবিরোধী শক্তির কাছে অসহ্য। পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডাররা যখন গুলি করে ছাত্র-জনতাকে মেরেছে, সেনাবাহিনী তখন শুধু ‘নো ফায়ার’ নীতিই নেয়নি, আহত হাজার হাজারকে সিএমএইচে চিকিত্সা দিয়েছে। শত শত জনকে মেজর-মাইনর অপারেশন করেছে।

তাদের উদ্দেশ এরই মধ্যে পরিষ্কার। দুর্বল সেনাবাহিনী ভীষণ কাম্য তাদের কাছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্রমেই শক্ত-সামর্থ্যবান হয়ে ওঠা, জনসম্পৃক্ততা, বাহিনীতে এবং দেশে সেনাপ্রধানের জনপ্রিয়তা তাদের কাছে বেশ অ্যালার্মিং। তাঁর নেতৃত্বে গ্লোবাল জিওপলিটিকস ও ইন্টারন্যাশনাল গ্রেট গেমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বড় ফ্যাক্টর হয়ে ওঠার একটি রিহার্সাল হয়ে গেছে এবারের জুলাই-আগস্টে, যা দেশবিরোধী শক্তির কাছে অসহ্য। পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডাররা যখন গুলি করে ছাত্র-জনতাকে মেরেছে, সেনাবাহিনী তখন শুধু ‘নো ফায়ার’ নীতিই নেয়নি, আহত হাজার হাজারকে সিএমএইচে চিকিত্সা দিয়েছে।

সেনাবাহিনীকে মাঠ থেকে সরানো হয় না কেন, এ অপেক্ষা কারো কারো। সেনাবাহিনী মাঠ থেকে সরালে কী দশা হবে, এ তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে। তারা কি না করবে, সেই প্রস্তুতি নিয়ে সংঘবদ্ধ হচ্ছে। সেনা সদস্যদের মাঠ থেকে সরালে গোটা দেশকে গোপালগঞ্জ বানিয়ে দেওয়ার হুংকার-প্রস্তুতি তো রয়েছেই। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পরিসংখ্যানগতভাবে অবনতি না হলেও নানা ঘটনা সেনাবাহিনীর নজরদারির বাইরে নয়। পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে তারা কাজ করছে। অবৈধ অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার, বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, মাদক কারবারিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের গ্রেপ্তারে অংশীজন হচ্ছে পেশাদারির সঙ্গে।দেশে একান্নবর্তী পরিবারের মতো রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতিতে সম্পৃক্তরা তা বুঝতে পারছেন। কিন্তু তাঁদের সবাই ফাংশনেবল জায়গায় নেই। অনেক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে চলছে পুরো দেশ। এখানে আবেগ বা উত্তেজনার বশবর্তী হওয়ার সুযোগ নেই। রাজনীতি-কূটনীতিতে কিছু বেসিক নর্মস মানতে হয়। অনেক কথা হয়, অনেক শলাপরামর্শ হয়, গোপনে প্রকাশ্যে নানা ধরনের বৈঠক হয়। এর মধ্যে কিছু থাকে একেবারেই কনফিডেনশিয়াল। সমঝোতা হোক বা না হোক, এসবের বিষয়বস্তু গোপনই রাখতে হয়। এটি হচ্ছে শিষ্টাচার এবং বিশ্বস্ততা রক্ষার বিষয়। তা যে ভঙ্গ করে, তার ক্রেডিবিলিটি নষ্ট হয়ে যায়। বিশ্বস্ততা উঠে যায়। অবিশ্বস্ত লোক কখনো আর কারো আস্থাভাজন হতে পারে না। নিজ দেশের সেনাবাহিনীকে হেয় করা কোনো বীরত্বের কাজ নয়, তা এক ধরনের বেয়াকুবি। এই প্রতিষ্ঠানটিকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে চাই, ভালোবাসার জায়গায় দেখতে চাই। এ ছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে সামর্থ্যবান-চৌকস। তাদের মনোবল ভাঙলে বা ডিস্টার্বে রাখলে কে লাভবান হবে, সেই বোধবুদ্ধি জরুরি। সময়টি অ্যাডভেঞ্চারিজমের নয়।

সেনাবাহিনী বা এর প্রধান কী চান, তা বুঝতে তাঁর অফিসে-বাসায় যাতায়াত বা আড়ি পাতার দরকার পড়ে না। ক্ষমতা চাইলে তিনি সেটি কবেই নিতে পারতেন। তিনি যত দ্রুত সম্ভব বা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে অ্যাডামেন্ট। প্রথম থেকেই আর্লি ইলেকশন ও ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশনের পক্ষে। প্রায় একই মানসিকতা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসেরও। ক্ষমতা চাইলে তিনিও সেই কবেই মসনদে বসতে পারতেন। বর্তমান সময়টা বড় প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আঞ্চলিক কূটনীতি তাঁদের নখদর্পণে। প্রতিবেশী, নিকট প্রতিবেশীই নয়, আরো অনেকের কাছে এই ছোট বাংলাদেশ একটি বড় সাবজেক্ট। এর অবজেক্টও বিস্তর। সেখানে চলে অনেক বড় ধরনের গেম। এ রকম সময়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র কাণ্ডারি সশস্ত্র বাহিনী একটি বড় ফ্যাক্টর। তাদের নিয়ে কুত্সা বা বন্দনার অতি মাতামাতি কোনোটিই কাম্য নয়।

ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তা উগান্ডা-রুয়ান্ডার মতো দেশের জন্যও জরুরি। বিশ্বের সুপার পাওয়ার হতে আকাঙ্ক্ষী চাণক্য কূটনীতির প্রতিবেশী ভারতের কাছে বাংলাদেশ অত্যন্ত দামি। স্বাভাবিকভাবেই এখানে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার হেন চেষ্টা নেই, যা তারা না করবে। এটি তাদের দোষ বা গুণের বিষয় নয়। আবার চীন সফরও ছিল বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার জন্য জরুরি। বিমসটেক সম্মেলনে যাওয়া, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকটিও ছিল আকাঙ্ক্ষিত। যেমন আকাঙ্খিত বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্মেলন করা। ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি, গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা প্রকাশও জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক কূটনীতিও আবশ্যক। রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মায়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এগুলোর একটি বাদ দিয়ে আরেকটি নয়। একটির গুরুত্ব আরেকটির সঙ্গে তুলনার বিষয়ও নয়। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের যে কারো পক্ষেই উপলব্ধিযোগ্য যে স্থানিক রাজনীতির বাইরেও বৈশ্বিক কোন সন্ধিক্ষণে এখন বাংলাদেশ, যেখানে সেনাবাহিনী কত প্রাসঙ্গিক!

সেনাপ্রধানের ওপর কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর রাগ থাকতেই পারে। তাঁর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী আগস্টে নিরীহ মানুষের ওপর বন্দুক চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, তা তো সবার পছন্দ নয়। অন্য একটি গোষ্ঠীর রাগের কারণটি ভিন্ন। তিনি নিজেদের মাঝে কামড়াকামড়ি করতে নিষেধ করেছেন। ফলে তাদের পানি ঘোলা করে মাছ শিকারের পথে বাধা হয়ে গেছে। অবস্থা কোথায় গেলে জেনারেল ওয়াকার কোনো রাখঢাক না রেখে সরাসরি কথাগুলো বলেছেন। রাজনীতিক বা কূটনীতিকদের মতো ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে, চিবিয়ে  তিতার  ওপর মিষ্টি মাখিয়ে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন, সতর্ক না হলে সবার কপালে খারাপি আছে। পরে যেন তাঁকে সতর্ক না করার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা না হয়, সে কথাও বলেছেন। কথা কি আরো বেশি বলতে হয়? ইশারা নয়, কথায়ও কেউ কাফি বোধ না করলে বিকল্প আর কী থাকে?

সামরিক বাহিনীর প্রধান কাজ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। সার্বভৌমের ওপর হুমকি আসে দুই ভাবে। একটি সরাসরি বাইরের আক্রমণ, অন্যটি অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা গৃহযুদ্ধের ফলে নিরাপত্তা বিঘ্নিতজনিত হুমকি। দ্বিতীয় কারণে দেশের অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, রাজনৈতিক কাঠামো, আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। ফলে সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে। তিনি সেই কথাটিই দ্ব্যর্থহীনভাবে উচ্চারণ করেছেন। মাস কয়েকের ব্যবধানে কয়েক দিন ধরে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলসহ বৈশ্বিক নানা ঘটনায় কি দেখা যাচ্ছে না কেবল দুইভাবে নয়, আরো কতভাবে সার্বভৌমত্ব ও দেশপ্রেমিক চৌকস সেনাবাহিনীর কী আবশ্যকতা? ভূ-রাজনীতির কোন স্কেলে আমরা? আর আমাদের সতর্ক হওয়া কত জরুরি?

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন