স্টাফ রিপোর্টার:
আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতির দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে প্রায় দিনই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মানববন্ধনে অংশ নেওয়া সংশ্লিষ্ট স্টেশন এলাকার মানুষজন যাত্রাবিরতির পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরছেন। দাবিকে করে তুলছেন যৌক্তিক। তবে ট্রেনে চলাচলকারী অন্য এলাকার যাত্রীরা যত্রতত্র যাত্রাবিরতির দাবিকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন। তাঁরা বলছেন আন্তঃনগর ট্রেনকে আন্তঃলোকাল ট্রেনে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। এছাড়া বিভিন্ন রেলফ্যান গ্রুপেও এর বিপক্ষে মতামত উপস্থাপন করা হচ্ছে। এমন চলতে থাকলে পর্যায়ক্রমে সকল স্টেশনেই যাত্রাবিরতির দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আন্তঃনগর ট্রেন চলাচলের জন্য বিধিবদ্ধ ম্যানুয়েলের ১.৩১ নম্বরে বলা আছে, আন্তঃনগর ট্রেন স্বল্প সময়ে দূরের গন্তব্যে স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত দ্রুতগতিসম্পন্ন বিশেষ শ্রেণির ট্রেন। স্বাভাবিক কারণে এই ট্রেনের বিরতিসংখ্যা সীমিত থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন বা জংশন স্টেশন ছাড়া এই ট্রেনের যাত্রাবিরতি করা যাবে না। তবে এ নিয়ম উপেক্ষা করে পরবর্তীতে বিভিন্ন স্টেশনে আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেওয়ায় অন্য এলাকার মানুষজনও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
যেমন, খুলনা-রাজশাহীর মধ্যে চলাচলকারী কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেন শুরু থেকে ঝিনাইদহের সাফদারপুর রেলস্টেশনে যাত্রাবিরতি করত না। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে ট্রেনটি সেখানে যাত্রাবিরতি করছে। এছাড়া একই রুটে চলাচলকারী সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস ট্রেনও সাফদারপুর স্টেশনে যাত্রাবিরতি করে। এছাড়া সাগরদাঁড়ির যাত্রাবিরতি দেওয়া হয়েছে আব্দুলপুর রেলস্টেশনে। এবার কপোতাক্ষ ও সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেসের চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুর স্টেশনে আপ-ডাউন যাত্রাবিরতির দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার বিকালে দামুড়হুদাবাসীর পক্ষে জয়রামপুর ট্রেন সুবিধা সংরক্ষণ কমিটির আয়োজনে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
রেল সংশ্লিষ্টদের মতে, একটি স্টেশনে যাত্রাবিরতির জন্য একেকটি ৭০ কিলোমিটার গতিবেগের ট্রেনের সময় ব্যয় হয় সর্বনিম্ন ১৩ মিনিট। স্টেশনে যাত্রাবিরতির আগে নির্ধারিত দূরত্ব থেকে গতি কমিয়ে আনাসহ যাত্রাবিরতি ও আবারও সর্বোচ্চ গতিতে পৌঁছানো পর্যন্ত সময়ে একেকটি ট্রেনের এ পরিমাণ সময় ব্যয় হয়। যাত্রাবিরতি দেওয়ার ক্ষেত্রে রেলের পরিবহন ও বাণিজ্যিক বিভাগের মতামত নেওয়ার নিয়ম থাকলেও আইন লঙ্ঘন করেই বিভিন্ন আন্তঃনগর ট্রেনের স্টপেজ দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই বিভিন্ন আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতির সংখ্যা বাড়ানো শুরু হয়। তখন কয়েক মাস পরপরই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন রুটে নতুন নতুন যাত্রবিরতির স্থান ঘোষণা করত। এভাবে বাড়তে বাড়তে গত ১৫ বছরে দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব আন্তঃনগর ট্রেন প্রায়ই লোকাল ট্রেনে পরিণত হয়েছে। এর ফলে যাত্রাপথে ঘন ঘন থামছে ট্রেন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এর ফলে একদিকে বাড়ছে আন্তঃনগর ট্রেনের পরিচালন ব্যয়। আরেক দিকে বাড়ছে যাত্রীদের সময়ের অপচয় ও ভোগান্তি। এতে পরোক্ষভাবে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে অর্থনীতির ওপর। কারণ, পরিবহনব্যবস্থা নিরাপদ, দ্রুত ও সময়ানুবর্তী হলে তা অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যাদের তদবিরে যাত্রাবিরতি বেড়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মির্জা আজম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য মারুফা আকতার পপি, জামালপুর সদর উপজেলার সাংগঠনিক সম্পাদক খালেকুজ্জামান প্রদীপ, সাবেক এমপি রহমত আলী, সাবেক বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, সাবেক এমপি অসীম কুমার উকিল, সাবেক এমপি ফখরুল ইমাম, সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার, সাবেক এমপি মাহবুব-উল হানিফ, সাবেক এমপি শফিকুল আজম খান, সাবেক এমপি সামছুল আলম দুদু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ, সিরাজগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম, বগুড়ার উপজেলা ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ রাজু, সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, পঞ্চগড়ের মেয়র ওয়াহিদুজ্জামান সুজা, সাবেক এমপি রেজাউল করিম, সাবেক ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান, সাবেক পূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী, সাবেক এমপি খন্দকার আসাদুজ্জামান ও সাবেক রেলসচিব মোফাজ্জেল হোসেনের নাম জানা গেছে। এর বাইরে অনেকে প্রভাবশালী তদবির বা চাপ প্রয়োগ করে যাত্রাবিরতি আদায় করেছেন আন্তঃনগর ট্রেনের।
উল্লেখ্য, যাত্রাবিরতির সব দাবি যে অযৌক্তিক তাও কিন্তু নয়। যেমন পৌরশহর হওয়া সত্ত্বেও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা হল্ট স্টেশনে ঢাকাগামী আপ সুন্দরবন এক্সপ্রেস এবং খুলনাগামী ডাউন চিত্রা এক্সপ্রেসের যাত্রাবিরতির দীর্ঘদিনের দাবি এখনও পর্যন্ত আদায় হয়নি। দাবিটি যৌক্তিক হলেও নিরাপত্তার অজুহাতে ট্রেন দুটি স্টেশনটিতে রাতে যাত্রাবিরতি করে না। তবে ডাউন সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও আপ চিত্রা এক্সপ্রেস আপে দর্শনা হল্ট স্টেশনে যাত্রাবিরতি করে। এছাড়া সীমান্ত এক্সপ্রেসও আগেও দর্শনা হল্ট স্টেশনে যাত্রাবিরতি করত না। তবে বর্তমানে ট্রেনটি সেখানে যাত্রাবিরতি করে। সীমান্ত এক্সপ্রেসের যাত্রীদের রাতের বেলা সমস্যা না হলে সুন্দরবন ও চিত্রা এক্সপ্রেসের যাত্রীদেরও সমস্যা হবে না বলে মনে করেন দর্শনাসহ আশপাশের এলাকাবাসী। এছাড়া উপজেলা শহর ও যাত্রীচাপ বেশি হওয়ায় চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রাবিরতির দাবি পুরোপুরি যৌক্তিক বলে মনে করেন আলমডাঙ্গাবাসী।