ইসলামের প্রচার-প্রসার, বিস্তৃতি ও স্থায়িত্বে ওয়াজ মাহফিলের অবদান ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সর্বস্তরের জনসাধারণকে ইসলামমুখী করার ক্ষেত্রে ওয়াজ-মাহফিলের বিশেষ ভূমিকা আছে।
মহানবী মুহাম্মদ (সা.) নবুয়তের গুরুদায়িত্ব লাভের পর যখন মানুষের কাছে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের আসমানি আদেশ পেলেন, তখন মক্কার পাহাড়ে উঠে এক-একটি গোত্রের নাম ধরে সবাইকে পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হওয়ার আহ্বান করেন। সবাই সমবেত হলে তিনি আল্লাহর একত্ববাদের যৌক্তিকতা তাদের সামনে উপস্থাপন করেন। সেই থেকে শুরু হয় ওয়াজ-মাহফিলের সোনালী অধ্যায়। পরবর্তীতে নবী (সা.) মক্কাবাসীদের বিভিন্ন গনজমায়েতে উপস্থিত হয়ে ইসলামের আবেদন ও সৌন্দর্য তুলে ধরে উপস্থিত জনতাকে সম্বোধন করে ভাষণ দিতেন। এমনকি তিনি সাহাবিদেরও ওয়াজ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে পাঠাতেন। সাহাবাদের পরে তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনরা ওয়াজ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে যেতেন। তাদের অবর্তমানে যুগের উলামা-মাশায়েখরা ওয়াজের মঞ্চগুলোকে অলংকৃত করেছেন। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইসলাম পৌঁছেছে ওয়াজ মাহফিলের নিরবিচ্ছিন্ন ধারায়।
কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, বর্তমানে দ্বিনি মাহফিলগুলো তার ঐতিহ্য ও জৌলুশ হারানোর পথে এবং ক্রমে ক্রমে তা মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে যাচ্ছে। কী কারণে ওয়াজ-মাহফিল মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে যাচ্ছে—তা আজ আলোচনা করব।
পরিশুদ্ধ নিয়তের অভাব : আল্লাহ তাআলা বান্দার ভালো কাজের বিনিময়ে প্রতিদান ও পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তবে বিনিময় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিষয়টি নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। কোনো কাজ করার পেছনে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য থাকলে পরিমাণে অল্প হলেও সেটিই তার মুক্তির পাথেয় হিসেবে বিবেচিত হবে। ওয়াজ-মাহফিলসহ সব ধরনের ইবাদতে বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমার ঈমান খাঁটি করো, অল্প আমল নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম : ৪/৩৪১)
বর্তমানে মাহফিল সম্পৃক্ত মাহফিল কমিটি, বক্তা, শ্রোতা বেশির ভাগের পরিশুদ্ধ নিয়তের অভাব অনুমেয়। তাই তিন শ্রেণির উচিত পরিশুদ্ধ নিয়ত নিয়ে নিম্নোক্ত সমস্যা পরিহার করে ওয়াজ-মাহফিল আয়োজন করা।
মাহফিল কমিটির কারণে যেসব সমস্যা
বক্তা নির্বাচনে সমস্যা : বক্তা নির্বাচনে মাহফিল কমিটি বক্তার ইলম-আমল না দেখে বরং দেখে বক্তা ভাইরাল কিনা, বক্তার গলার স্বর কেমন, বক্তা গান গায় কেমন, বক্তা মানুষকে হাসাতে পারে কিনা, বক্তা বিভিন্ন বক্তার কণ্ঠ নকল করতে পারে কিনা, বক্তা বিভিন্ন সুরে আজান দিতে পারে কিনা! কোন বক্তা আনলে মাহফিলে মানুষ বেশি হবে—এ বিষয় লক্ষ্য করে। মুফতি, মুহাদ্দিস, শাইখুল হাদিস, মুহতামিম, প্রিন্সিপাল, প্রবীণ আলেম বক্তাকে প্রধান বক্তা না বানিয়ে বরং বয়সে কম, একাডেমিক যোগ্যতা কম শুধুমাত্র ভাইরাল এজন্যেই তাকে প্রধান বক্তা বানানো হয়। এসব মনোভাব থেকে সরে আসা প্রত্যেক মাহফিল কমিটির প্রয়োজন।
চাঁদা সংগ্রহ : সামাজিক ও ধর্মীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থা ও পরিচালনার জন্য ‘গণচাঁদা’ সংগ্রহের প্রচলন রয়েছে। প্রচলিত দ্বীনি মাহফিল এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু চাঁদা সংগ্রহ করতে রাস্তার গাড়ি আটকিয়ে, ছোট ছোট বাচ্চাদের দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কালেকশন করানো, মাহফিলের মূল সময়ে প্রধান বক্তাকে মাইক না দিয়ে দ্বিতীয় বক্তাকে দিয়ে লম্বা সময় কালেকশন করানো, অনেক সময় ব্যক্তির সামর্থ্য ও সাধ্যের বাইরে এমন কিছু দাবি করে, যা তার জন্য কষ্টসাধ্য ও জবরদস্তিমূলক। এমন কাজের অনুমতি ইসলাম দেয় না। এ বিষয়ে গভীর মনোযোগ কাম্য।
বাহুল্যতা : বর্তমানে মাহফিলগুলোকে ঘিরে অর্থের অপচয়, অপ্রয়োজনীয় তোরণ নির্মাণ ও আলোকসজ্জার আয়োজন যেন বিধর্মীদের উত্সব-পার্বণকেও হার মানায়। ইসলাম সৌন্দর্যতা পছন্দ করে, সুন্দরের নির্দেশ দেয়। তবে অপচয় ও বিলাসিতা বর্জনীয়।
বক্তার কারণে যেসব সমস্যা
১. নিয়ত ও ইখলাসের সমস্যা ২. চুক্তি ও কন্ট্রাক্ট করে বক্তব্য দেওয়া ৩. প্রদর্শনেচ্ছা ৪. সঠিক ইলম এর অভাব ৫. ভালো কণ্ঠস্বর, ছন্দ, গান ও কবিতাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া ৬. মিথ্যা কল্পকাহিনী বর্ণনা করা ৭. অহংকার ( পোশাক, দেহের, কণ্ঠের) ৮. বিষয় নির্ধারণে সমস্যা ৯. কথা ও কাজের হেরফের ১০. সময় সচেতনতার অভাব ১১. নেওয়া ও খাওয়ার মানসিকতা ইত্যাদি।
বক্তাদের জন্য করণীয়
১. বক্তৃতা ও আমলে ইখলাস থাকা ২. সহিহ ইলম ৩. গভীর জ্ঞান ৪. বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য দেওয়া ৫. বানোয়াট কিচ্ছা কাহিনি না বলে কোরআন-হাদিস ভিত্তিক কথা বলা ৬. চারিত্রিক মাধুর্য তথা সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, উত্তম লেনদেন, লজ্জাশীলতা ইত্যাদি ৭. ধৈর্য ও প্রজ্ঞা ৮. ইসলামের বিধানাবলীর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ৯. নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা ১০. বিনয় ও কোমলতা ১১. প্রতিশোধ প্রবণতা বিমুখ ১২. সাহসিকতা ১৩. ষ্পষ্টবাদিতা ১৪. উদারতা ১৫. নির্লোভ তথা খাওয়া পাওয়ার মনোভাব পরিহার করা ১৬. অন্যের ভুলের সমালোচনা না করে শুধু সঠিক তথ্য তুলে ধরা।
বক্তব্য প্রদানের পদ্ধতি
১. প্রস্তুতি গ্রহণ করে বক্তব্য দেওয়া ২. স্থান, কাল ও শ্রোতাদের মান বুঝে বক্তৃতা দেওয়া ৩. বক্তৃতায় বারবার বিষয়বস্তু পরিবর্তন না করা ৪. স্বরভঙ্গির যথাযথ ব্যবহার করা ৫. অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা পরিহার করা ৬. অনুকরণ প্রিয় না হয়ে বরং স্বকীয়তার প্রতি গুরুত্বারোপ করা ৭. বিতর্কিত বিষয়ে ইনসাফের সঙ্গে আলোচনা করা ৮. অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজের মত তুলে ধরা ৯. বেশি হাস্যরস পরিহার করা ১০. সারাক্ষণ গোমড়া মুখে না থেকে প্রয়োজনীয় মুচকি হাসি দিয়ে বক্তব্য দেওয়া ১১. শ্রোতাদের মনোযোগের প্রতি খেয়াল রেখে বক্তৃতার ধরণ ও সময়ের পরিধি আয়ত্বে রাখা
শ্রোতাদের কারণে যেসব সমস্যা
নৈতিক শিক্ষার অভাব, অপসংস্কৃতির বিভীষিকা, সমাজ সচেতনতার অভাব, ওয়াজ শুনে আমল করার নিয়ত না করা, সিদ্ধান্তহীনতা, দুনিয়া ও আখেরাতের ধারণা না থাকা, বক্তার ইলমি আলোচনাকে প্রাধান্য না দিয়ে বক্তার কণ্ঠ, হাসি তামাশা, কৌতুক কে প্রাধান্য দেয়া। (মাজলিসুল মুফাসসিরীনের ডায়েরী ২০২২-২৩)
পরিশেষে, মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার ভিত গড়ে তোলা এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারের প্রধান মাধ্যম ওয়াজ-মাহফিল। আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত মানুষকে আল্লাহর পথ প্রদর্শন করা ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত করার চেয়ে উত্তম কাজ আর কী হতে পারে! তবে তা তখনই সফল ও অর্থবহ হবে—যদি তা হয় সঠিক ও সুন্দর পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন হয়। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরীন
ও খতিব, বাইতুল মামুর জামে মসজিদ, উত্তরা ১২ নম্বন সেক্টর, ঢাকা।