যদিও কীভাবে যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন তা নিয়ে তখন ট্রাম্প বিস্তারিত কিছু বলেননি। গত ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেন।
জেলেনস্কির পাশে দাঁড়াতে একজোট হচ্ছে ইউরোপ
তখন থেকেই ধারণা করা যাচ্ছিল ইউক্রেনকে বাদ দিয়েই তিনি শান্তি আলোচনা শুরু করতে চলেছেন। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপে কিয়েভ ক্ষুব্ধ হয়। ইউরোপিয়ান দেশগুলোও হতবাক হয়। এরপর থেকেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এবং ওয়াশিংটনের ইউরোপীয় মিত্ররা ট্রাম্পের প্রতি যেকোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে ইউক্রেনের নিরাপত্তার নিশ্চিত করার অনুরোধ করতে থাকেন।
আবার এমনও বলা হচ্ছিল, উভয় পক্ষের কেউ যদি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে তাহলে পরিণতি কি হতে পারে তাও যেন চুক্তিতে নিশ্চিত করা থাকে। তখন ট্রাম্প তাদের এই অনুরোধ উপেক্ষা করে গেছেন এবং বলেছেন, তিনি এ ধরনের কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না।
তখনই ট্রাম্প বরং জোর দিয়ে বলেছেন, “পুতিন তাকে যথেষ্ট ‘সম্মান’ করেন। তাই চুক্তি লঙ্ঘন করবেন না”। শুক্রবার জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের একপর্যায়ে ট্রাম্প এবং তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স অভিযোগ করেন, (রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে) যুক্তরাষ্ট্র যে সমর্থন দিয়েছে তার জন্য জেলেনস্কি যথেষ্ট “কৃতজ্ঞতা প্রকাশ” করেননি।
এ নিয়ে উভয় পক্ষের বাগবিতণ্ডার পর জেলেনস্কি ও তার প্রতিনিধি দলকে হোয়াইট হাউস থেকে চলে যেতে বলা হয় বলে জানিয়েছেন ট্রাম্পের প্রেস সচিব।
কূটনীতিক সম্পর্কে প্রভাব কী?
শুক্রবারের বৈঠকে রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধে ওয়াশিংটনের সমর্থন ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন জেলেনস্কি। কিন্তু বৈঠকের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। বৈঠকের পর এক্স (সাবেক টুইটার) এ এক পোস্টে লিখেন- “যুক্তরাষ্ট্র রুশ নেতার সাথে সংলাপ চালাতে চায় তা বোঝাই যায়”।
এর আগের আরেকটি বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়ে জেলেনস্কি লিখেছেন, “আমাদের পক্ষে আরও দৃঢ় অবস্থান নিন”। যদিও গত দুই সপ্তাহ আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও পুতিন তাদের প্রতিনিধিদের সৌদি আরব ও ইস্তাম্বুলে আলোচনা চালানোর জন্য পাঠিয়েছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠন। তবে সেই আলোচনায় বাদ রাখা হয়েছিল ইউক্রেনকে।
ব্রিটেনের রাজনৈতিক নেতা নাইজেল ফারাজ হোয়াইট হাউসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে গণমাধ্যমের সামনে তর্কাতর্কির ঘটনাটিকে দুঃখজনক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ফারাজের মতে, এই ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং এটি দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই প্রকাশ্য বিরোধ আসলে একটি পূর্বপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল। এতে হয় জেলেনস্কিকে যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মানতে বাধ্য করা, নতুবা সংকট তৈরি করে পরবর্তী যে কোনো ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হলো।
যদি ট্রাম্প আলোচনার ব্যর্থতার পর ইউক্রেনের সামরিক সহায়তা স্থগিত করেন, তাহলে ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো, তারা কতটা কার্যকরভাবে এবং কতদিন লড়তে পারবে?
‘সবচেয়ে অন্ধকার দিন’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে জেলেনস্কির এই বাকবিতণ্ডার ঘটনার পর এ নিয়ে হতাশা দেখা গেছে ইউক্রেনিয়ানদের মাঝে। ইউক্রেনের বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্রের সাথে সম্পর্ক হঠাৎ করেই তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে।
ইউক্রেনের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি ভাষার গণমাধ্যম ‘দ্য কিয়েভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন রাশিয়ার সঙ্গে একত্র হয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এতে বলা হয়, এখন সময় এসেছে স্পষ্ট করে বলার। আমেরিকার নেতৃত্বে যুদ্ধের পক্ষ বদল হয়েছে।
সাংবাদিক মুস্তাফা নাইয়েম বলেছেন, “ট্রাম্প প্রশাসন গোপন চুক্তি ও কূটনৈতিক হাত মেলানোর পথে সবচেয়ে বিরক্তিকর বাধা মনে করে ইউক্রেনকে। জেলেনস্কি তার অবস্থানে অটল ছিলেন এবং তিনি এমন ‘গৌরবের সঙ্গে’ দাঁড়িয়ে ছিলেন, যা তার প্রতিপক্ষরা বুঝতে পারছে না”।
সাংবাদিক ডেনিস কাজানস্কি বলেছেন, “জেলেনস্কিকে এমন এক পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছিল, যেখানে ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স তাকে অকৃতজ্ঞ হিসেবে অভিযুক্ত করেছিলেন। যদি তিনি চুপ থেকে মাথা নাড়তেন, তবে সেটি অপমানজনক মনে হতো। কিন্তু তিনি প্রতিবাদ করায় তাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অসম্মান দেখানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।”
উত্তেজনা-তর্কে পণ্ড ট্রাম্প-জেলেনস্কির বৈঠক, ফিরে গেলেন জেলেনস্কি
সামরিক বিশ্লেষক মাইকোলা বিয়েলিয়েস্কোভ বলেন, এমন অবস্থার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক পুনর্গঠন হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য মার্কিন সমর্থন এবং পারস্পরিক সুবিধাজনক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, বর্তমান পরিস্থিতি ইউক্রেনের জন্য একটি কঠিন সময় এবং এটি একটি অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, যারা এখন ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক রক্ষার দায়িত্বে আছেন, তাদের জন্য আমার সহানুভূতি আছে। গতকাল (শুক্রবার) আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সবচেয়ে অন্ধকার দিন ছিল।
তার বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এই সমস্যার সমাধান সহজ হবে না এবং ভবিষ্যতে আরও কূটনৈতিক দক্ষতার প্রয়োজন হতে পারে। এই “অন্ধকার দিন” থেকে ইউক্রেন কীভাবে বেরিয়ে আসবে এবং কীভাবে তারা তাদের বিদেশী সম্পর্ক, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে এটাই দেখার বিষয়।