মিশুক মঞ্জুর,
নিয়োগ বাতিল নতুন কিছু নয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ থাকে যেকোনো কারণ দর্শানো ব্যতীত কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে নিয়োগ বাতিল বা স্থগিত করতে পারে। এতে কারও আপত্তি থাকে না বা করতেও পারে না। কিন্তু যখন নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ভাইভা সম্পন্ন করে চ‚ড়ান্ত ফলাফলের ঘোষণা হওয়ার পর নিয়োগ বাতিল বা রহিত হয় তখনই বিপত্তি ঘটে। এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার পর সত্যিই এটা আর মেনে নেওয়া যায় না। তখনই তা গড়ায় আদালত পর্যন্ত।
সম্প্রতি ২৭ বিসিএসে প্রথম মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের দীর্ঘ ১৭ বছর পর নিয়োগবঞ্চিত ১ হাজার ১৩৭ জনের আপিল বিভাগের পুনর্নিয়োগের রায় এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬ হাজার ৫৩১ জনের নিয়োগ বাতিল বা স্থগিত বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে নতুন করে ফলাফল ঘোষণায় নতুন কিছু লোক হয়তো নিয়োগ পাবে। কিন্তু ২৭ তম বিসিএসের মতো কোনো একদিন যখন সহকারী শিক্ষকরা আবার নিয়োগ পাবেন তখন এ সমস্যা বহুগুণে বাড়বে নিঃসন্দেহে। এভাবে আর কতদিন? তাই ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কোনো সংকট তৈরি না হয় তার জন্য সরকারকে এখনই সমাধান বের করতে হবে।
দুটি সমস্যা এক ও অভিন্ন। তবু আদালতের দুটি রায় বিপরীতমুখী। আশা করা হচ্ছে হয়তো পরিণতি একই ধরনের হবে। ২৭ তম বিসিএসে রায়ে উচ্চ পদে কর্মরত অনেকেই নিশ্চিত নন তারা আসলে কী করবেন? আদৌ যোগদান করা ঠিক হবে কি না তা নিয়ে দ্বিধায় আছেন? নতুন কোনো সরকার এলে আবার কোন বিপদে পড়তে হবে না তো?
সরকারের সবথেকে বড় নিয়োগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পরীক্ষা। বড় নিয়োগ কঠিন এবং দীর্ঘসূত্রতা থাকে। ফলে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ থাকে। তাই সতর্কও বেশি থাকতে হয়। তবু কখনো কখনো সমস্যা থেকেই যায়।
অর্ধ মাস ধরে এ ধরনেই একটি সমস্যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মোকাবিলা করছে। উচ্চ আদালতে নিয়োগবঞ্চিত ৩১ জন চাকরিপ্রার্থীর করা এক রিটের কারণে তৃতীয় ধাপে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিভাগে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে কোটায় নির্বাচিত হওয়া ৬ হাজার ৫৩১ জনের নিয়োগ আটকে যায়। আদালত মেধার ভিত্তিতে নতুন করে ফল প্রকাশের আদেশও দেন। তখন থেকেই আন্দোলন শুরু হয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পাওয়া চাকরিপ্রার্থীদের। বাতিল হওয়া নিয়োগ ফিরে পেতে প্রায় অর্ধ মাস ধরে তারা রাস্তায় আছেন। সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান কিছুই তাদের নিবৃত্ত করতে পারছে না। কেননা তাদের সামনে অন্য কোনো উপায় নেই। অনেকের বয়স ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে। বর্তমানে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে এবং বেকারত্বের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশ সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে এত কম বেতনে সরকারি চাকরি করতে চায়। হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার কাজ পাচ্ছে না। বিপুল পরিমাণ শিক্ষিত বেকারকে কাজে নিয়োগ করতে পারলে দেশেরই লাভ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে সরকারিভাবেই। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সম্ভবত কাজের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এত বেকার লোক নেই। বিপুল খরচের কারণে প্রবাসেও যেতে পারছে না লাখ লাখ বেকার যুবক। বেতন অল্প হলেও এ দেশে সরকারি চাকরি একটি সোনার হরিণ। তাই হাতে পাওয়া সোনার হরিণ হাতছাড়া হওয়ার বেদনা কেউ ভুলতে পারে না। এ জনই দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর সহকারী শিক্ষকের মতো একটি চাকরি পাওয়াকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী চলছে আন্দোলন। কেন দীর্ঘতর হচ্ছে সমাধানের প্রক্রিয়া? তারা কোনো সহিংস আন্দোলন করছে না। তবু দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের চড়াও কাম্য নয়। তবে রাস্তা আটকিয়ে আন্দোলন রাজধানীবাসীকে দুর্ভোগে ফেলছে। কথা হচ্ছে রাস্তা আটকানো ছাড়া এ দেশের কোনো আন্দোলনের চিৎকার কি সরকারের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায়?
মেধা এবং কোটার দ্ব›েদ্বর অবসান জরুরি? অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ক্রমাগত নানা বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বহুবার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। তবে বিগত আন্দোলন এবং বর্তমান শিক্ষকদের আন্দোলন এক নয়। সরকারকে এটা অনুধাবন করতে হবে। দীর্ঘদিন তাদের রাস্তায় রেখে সমাধান খোঁজাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আন্দোলনকারীদের বক্তব্য এখানে স্পষ্ট। সরকারের একই প্রক্রিয়ায় দুই দফায় অন্যদের নিয়োগ হলে তাদের ক্ষেত্রে কেন আপত্তি? তাদের আরও যুক্তি যে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারই গত বছরের ৩১ অক্টোবর পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ১১ নভেম্বর এ সংক্রান্ত আদেশ অনুসারে নির্বাচিত প্রার্থীদের নিয়োগপত্র ইস্যু করার কথা ছিল। নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা অনুসরণের অভিযোগে তুলে ফলাফল প্রকাশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে নিয়োগবঞ্চিত ৩১ জন প্রার্থী। তাদের রিট করা রায়েই কপাল পুড়ছে ৬ হাজার ৫৩১ জন চাকরি প্রত্যাশীর।
যেকোনো সরকারি চাকরি সামাজিকভাবে খুব সম্মানের। এখন যদি নিয়োগ পাওয়ার পর অনেকেই যোগদান করতে না পারে, তবে সামাজিকভাবে অনেকেই হেয় হবেন। মানসিকভাবে ভেঙে পরবেন, যা তাদের সারা জীবনে প্রভাব পড়বে। তা ছাড়া গুটিকয়েক নিয়োগবঞ্চিতের দায় তো নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের নয়। একটি বিষয় পরিষ্কার, সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশ শিক্ষকই মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। সাধারণত ধনী বা আর্থিকভাবে অধিক সচ্ছল পরিবারের খুব কমসংখ্যক শিক্ষক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করেন। কেননা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরিতে বেশিরভাগ শিক্ষককে গ্রামে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকতে হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংকট রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয় এমন কিছু করবে না যাতে এসব চাকরিপ্রত্যাশীকে দিনের পর দিন রাস্তায় থাকতে হয়। প্রথম এবং দ্বিতীয় দফায় নিয়োগপ্রাপ্তদের মতোই তাদের নিয়োগ দিয়ে দ্রুত ক্লাসে ফেরানোই হবে যুক্তিসংযত।
আশার কথা যে, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব বৈঠক করেছেন এবং তাদের বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু এতসব শিক্ষকের ভবিষ্যৎ শুধু আশ্বাসে ঝুলিয়ে রাখা কি সমীচীন হবে? আদালত তো মানুষের কল্যাণের জন্যই। লাগাতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে।
সবাই অবগত আছেন যে, সম্প্রতি ২৭ তম বিসিএসের প্রথম মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নিয়োগবঞ্চিত প্রার্থীদের ৩ মাসের মধ্যে নিয়োগ দিতে নির্দেশ দিয়ে ১৬ বছর আগে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তা পুনর্বহাল করেছে আপিল বিভাগ। এই বিসিএসে নিয়োগবঞ্চিত ১ হাজার ১৩৭ জন দ্বিতীয়বার মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়ে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০৮ সালে দ্বিতীয় মৌখিক পরীক্ষায় ৩ হাজার ২২৯ জন উত্তীর্ণ হন এবং পরে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম মৌখিক পরীক্ষায় যারা বাদ পড়েছিল তারাও সংখ্যায় ১ হাজার ১৩৭ জন। বিষয়টি দাঁড়াল ভুলের কারণে সরকারকে অতিরিক্ত ১ হাজার ১৩৭ জনকে চাকরি দিতে হচ্ছে। নিশ্চয়ই যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন এরপর তারা তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য আবার মামলা করবেন। নতুন করে আবার নতুন কিছু জটিলতার সৃষ্টি তো হবেই।
তাই এখন এটা অবশ্যই ভাবতে হবে আজকে যাদের নিয়োগ বাতিল করা হলো, দীর্ঘদিন পরে হলেও তারাও চাকরি ফেরত পাবে। ততদিনে অনেকের জীবনের যবনিকাপাত ঘটবে, কারও জীবনে হয়তো নেমে আসবে অমানিশার অন্ধকার। কেউ নতুন কোনো জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নেবে। যাদের সে সুযোগ নেই তারা কী করবে? চাকরি নিয়ে এমন জটিলতা কখনো কাম্য নয়। তারা আবার ক্ষতিপূরণ দাবি করবে। কোনো ধরনের সেবা না দিয়ে জাতিকেই তাদের এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নিয়োগপ্রাপ্তরা দীর্ঘদিন পরে চাকরিতে যোগদান করবেন যাদের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই বড় অঙ্কের অর্থ নিয়মিত গুনতে হবে সরকারকে।
আমরা আর এরকম চাই না। প্রতিটা নিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি। নিয়োগে ক্রটি থাকলে শুরুতেই তা বাতিল করতে হবে। চ‚ড়ান্ত ফলের পরে আপিল কতটুকু গ্রহণযোগ্য তাও খতিয়ে দেখা উচিত। ভুল নিয়োগ জাতিকে ভুল পথে নিয়ে যায়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস নিশ্চয়ই একটি সঠিক সমাধান দেবেন। সেই প্রত্যাশায় রাস্তায় দিন গুনছে হাজারো চাকরিপ্রার্থী। আদালতের রায় পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টাতেই। হাজারো পরিবারের স্বপ্ন বেঁচে থাক। রাস্তায় গড়াগড়ি খাওয়া শিক্ষকদের স্বপ্নকে বাঁচতে দিন, তাদের স্বপ্নকে গুরুত্ব দিন।
সরকারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হোক এবং আলাদত নিশ্চয় বরাবরের মতো মানবিক হবেন এবং প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ন্যায় তারা চাকরিতে যোগদান করতে পারবেন। নব নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের যত তাড়াতাড়ি কাজে লাগাতে পারব, ততই মঙ্গল। রাস্তা নয়, শিক্ষকদের আসল ঠিকানা স্কুল, তাদের স্কুলেই ভালো মানাই।