চুয়াডাঙ্গার বাংলাদেশ বর্ডারগার্ড ব্যাটালিয়নের সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জাল সনদপত্র দাখিল করে চাকরি করার অপরাধে খাইরুল ইসলামের ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে ৭ দিনের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. লুৎফর রহমান শিশির। আজ বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টায় আসামির উপস্থিতিতে তিনি এ রায় ঘোষণা করেন।
মামলার বিবরণ ও আদালত সূত্রে জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) হিসেবে খাইরুল ইসলাম ২০০২ সালের ১ আগস্ট যোগদান করেন। ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয় তার দাখিল করা সনদপত্র জাল। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে কর্তৃপক্ষের কাছে জাল সনদপত্র দাখিলের বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন। এ ঘটনায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে পুলিশে সোপর্দ করতে পারে এ সংশয়ে তিনি বিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি ও বিজিবি পরিচালক বরাবর ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল আবেদন করে স্বেচ্ছায় চাকরি হতে পদত্যাগ করেন। এ পর্যন্ত থেমে ছিল বিষয়টি।
এরপর হঠাৎ করে খাইরুল ইসলাম ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিসেস মেহজাবিনের বিরুদ্ধে ৩ লাখ টাকা চাঁদা নিয়ে তার চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগে চুয়াডাঙ্গা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। এ মামলাটি তদন্ত করেন সেই সময়কার সদর পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক ওহিদুল ইসলাম।
তিনি মামলাটি তদন্ত করে আদালতে ২০১৭ সালের ১১ জুলাই চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে তিনি মামলার বাদী খাইরুল ইসলামের দাখিল করা মামলা সাজানো, সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেন এবং মিথ্যা মামলা করায় তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ২১১ ধারায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদালতে প্রার্থনা করেন। সেই সঙ্গে চাঁদাদাবি ও গ্রহণ করার স্বপক্ষে কোনো সাক্ষী বা প্রমাণ না পাওয়ায় বিবাদী চুয়াডাঙ্গার গুলশানপাড়ার গোলাম ফারুকের স্ত্রী ও মরহুম মহিউদ্দিনের মেয়ে সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মেহজাবিনকে (৪৬) মামলার দায় হতে অব্যাহতি প্রদানের আবেদন জানান। এরপর ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল আদালতের বিচারক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মেহজাবিন চন্দনাকে বেকসুর খালাসের আদেশ দেন।
তারপর বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সভাপতির পক্ষে প্রধান শিক্ষিকা মেহজাবিন বাদী হয়ে ২০১৭ সালের ৬ জুন চুয়াডাঙ্গা চিফ জুডিশিয়াল আদালতে বিবাদী চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কুলচারা গ্রামের মরহুম ফয়জুর রহমানের ছেলে সাবেক পদত্যাগকারী সহকারী শিক্ষক খাইরুল ইসলামের বিরুদ্ধে সিআর-৭০৫/১৭ বর্তমানে টিআর-২৫৮/১৮ মামলা করেন। এই মামলার স্বপক্ষে বিদ্যালয়ে চাকরি গ্রহণের সময় খাইরুল ইসলামের দাখিল করা বগুড়ার ফুলতলায় অবস্থিত জাতীয় বহুভাষী সাঁটলিপি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমির (নট্রামস) দাখিল করা জাল সনদ এবং ২০০২ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত জাল সনদ দাখিল করে বেতন হিসেবে প্রতারণার মাধ্যমে ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪ টাকা ৯৯ পয়সা গ্রহণ করায় তার বিরুদ্ধে করা ২০১৭ সালের ১৮ জুনে করা লিগ্যাল নোটিশের কপি প্রাপ্তি স্বীকার রশিদসহ সংযুক্ত করা হয়।
এছাড়া ২০১৭ সালের ৬ মার্চ খাইরুলের চাকরির সময় জমা দেওয়া সনদপত্রটি যাচাইয়ের জন্য বগুড়া ফুলতলায় অবস্থিত জাতীয় বহুভাষী সাঁটলিপি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমির (নট্রামস) পরিচালক বরাবর পাঠানো হয়। সেখান থেকে ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ একাডেমির পরিচালক (উপসচিব) এস.এম.ফেরদৌস আলম স্বাক্ষরিত এক পত্রে জানানো হয় ‘খাইরুল ইসলাম, পিতা. ফয়জুর রহমান, সনদ নং-১৯২৮৩ রেজিস্ট্রেশন-১৭৮৬১, রেজিস্টার যাচাইয়ে দেখা যায় যে, সনদপত্রটি সাবেক নট্রামস কর্তৃক ইস্যুকৃত নয়, সনদপত্রটি জাল/ভুয়া। সেই তথ্য গুলো মামলার নথিতেও সংযুক্ত করা হয়।
মামলাটি তদন্ত করেন তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) তরিকুল ইসলাম। ওই তদন্ত করার জন্য তিনি খাইরুলকে তার সনদপত্রের মূল কপি দেখাতে বললে তিনি জানান, ‘দাখিল করা সনদপত্রটির কপি তার নয়। তাকে ফাঁসানোর জন্য ওই কপি আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে’। এরপর তাকে তার সঠিক সনদপত্রের ফটোকপি জমা দিতে বললে খাইরুল আবার তার সনদপত্র জমা দেন। যার সিরিয়াল নম্বর-১৩৫৯০ ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর-১৩৫৮৭। এই সনদপত্রটি যাচাইয়ের জন্য আবারো জাতীয় বহুভাষী সাঁটলিপি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমিতে (নট্রামস) পাঠানো হলে সেটাও জাল/ভুয়া প্রমাণিত হয়।
এই মামলাটির অনুসন্ধান পূর্বক তদন্ত করে জানা যায়, অভিযুক্ত খাইরুল ইসলাম ভুয়া কম্পিউটার সনদপত্র দাখিল করে সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান এবং তার দেওয়া জবানবন্দিটি মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হয়। আর বাদী মেহজাবিন কর্তৃক অভিযোগের আবেদনটির সত্যতা পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি ২০১৭ সালের ২৬ আগস্ট অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) তরিকুল ইসলাম আদালতে দাখিল করেন।
এ মামলাটি কোয়াশমেন্ট চেয়ে খাইরুল ইসলাম উচ্চআদালতে মামলা করেন। যার নম্বর-১৩৩৫৫৯৮/২০২৩। টেন্ডার নম্বর-৪০৬৮৭। মামলাটি ২০২৩ সালের ৭ জুন, ওই মাসের ১৪ জুন, ২১ জুন উচ্চ আদালতের এনেক্স বিল্ডিংয়ের ১৬ নম্বর আদালতে বিচারপতি রেজাউল হক ও বিচারপতি কে.এম.এমরুল কায়েশ এবং ওই বছর ১২ জুলাই ও সর্বশেষ ১৯ জুলাই বিচারপতি রেজাউল হক ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের আদালতে উপস্থাপিত হয়ে কোয়াশমেন্ট চাইলে তা বাতিল হয়। এর ফলে নিম্ন আদালতে মামলাটি চলমান থাকে।
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা জজ আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) অ্যাড. শরিফ উদ্দীন হাসু বলেন, সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জাল সনদপত্র দাখিল করে চাকরি করার অপরাধে খাইরুল ইসলামের ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে ৭ দিনের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিজ্ঞ বিচারক মো. লুৎফর রহমান শিশির।
উল্লেখ্য, খাইরুল ইসলাম সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চাকরির পাশাপাশি দৈনিক সমকাল পত্রিকার চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। একই সাথে তিনি চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্সের সচিব হিসেবেও কর্মরত ছিলেন।