স্বর্ণ চোরকারবারি চুয়াডাঙ্গার রিপনুল হাসান রিপন ঢাকার একটি হত্যা মামলার আসামি হয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময়ে এক ব্যক্তি নিহতের ঘটনায় হত্যা মামলাটি দায়ের করেন ঢাকার মোহাম্মদপুর পশ্চিম কাটাসুর বাছিলা রোডের মনির হোসেন। তিনি বাদী হয়ে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ মামলা রুজু করেন। চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (মোহাম্মদপুর আমলী) আদালতের বিচারক রাজেশ চৌধুরী মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জকে এজাহার হিসাবে গণ্য করার নির্দেশ প্রদান করেন। হত্যা মামলাটি রুজু হয়েছে দন্ড বিধির ১৮৬০ এর ৩০২/১০৯/৩৪ ধারায়। সিআর মামলা নম্বর ৫৫৫/২০২৪। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (মোহাম্মদপুর আমলী) আদালতে এ মামলা রুজু হয়।
এদিকে, চতুর রিপনুল হাসান রিপন হত্যা মামলার আসামি হওয়ার ঘটনাকে অনেকেই স্বাভাবিকভাবে দেখছেন। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, স্বর্ণ ব্যবসায় নিজের প্রভাব বাড়াতে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে তিনি হামলা চালাতেও পারেন। তাদের অনেকেরই বিশ্বাস, আন্দোলন দমনে রিপন তার লাইসেন্সকৃত পিস্তলও ব্যবহার করেছে। এ নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা। চুয়াডাঙ্গা শহরতলীর দৌলাতদিয়াড় গ্রামের রিপনুল হাসান রিপন বাজুসের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হওয়ার পর থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেন। পরে অনেকের আস্থাভাজন হয়ে লুফে নেন বাজুসের সহসভাপতি পদ। নিয়ন্ত্রণে আসে স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের বাজার। স্বর্ণ পাচারে একক নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন।
সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গা জেলার সন্তান হওয়ার সুবাদে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগার টগরের কথিত ভাতিজা সেজে স্বর্ণ চোরাচালানে আধিপত্য বিস্তার করেন রিপন। অবৈধভাবে স্বর্ণ পাচার করে রাতারাতি ফুলে ফেপে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। ঢাকার তাঁতিবাজারে স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের গহনা তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন। বসুন্ধরায় রয়েছে জুয়েলারি শোরুম। কৌশলী রিপনুল হাসান দেশত্যাগ করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী, আমলাসহ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সাথে কৌশলে ছবি তুলে তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করতেন। ছবির অপব্যবহার করে নিয়েছেন নানা সুযোগ-সুবিধা। সাধারণ মানুষের কাছে বোঝাতে চান, তিনি বিশাল ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল চুয়াডাঙ্গায় আসলে তার সফরসঙ্গী ছিলেন রিপনুল হাসান। তার স্বর্ণ ও ডায়মন্ড ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম জুয়েলারি হাউজ। মোবাইল ব্যাংকিং নগদ এবং সিমফনি মোবাইল কোম্পানির চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার ডিস্টিবিউটরও তিনি।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আলুকদিয়া ইউনিয়নের দৌলাতদিয়াড় গ্রামের মাঝেরপাড়া আব্দুল হান্নানের ছেলে রিপনুল হাসান রিপন। তারা তিন ভাই ও দুই বোন। বড় ভাই ঢাকার তাঁতিবাজারের স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের কারখানা দেখাশুনা করেন। ছোট ভাই রোকনুজ্জামান রোকন চুয়াডাঙ্গায় থাকেন। নিয়ন্ত্রণ করেন চুয়াডাঙ্গা বিএডিসি। চতুর রিপনুল হাসান ঢাকায় বসে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও আমলাদের দিয়ে বিএডিসির কর্মকর্তাদের কাছে ফোন করিয়ে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে রোকন বিএডিসি থেকে আয় করেন লাখ লাখ টাকা। নামমাত্র মোবাইলের ব্যবসা করেন।
রিপনুল হাসানের বাবা চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার হাউলি ব্রিজ মোড় এলাকায় ব্যবসা করেন ভূসিমালের। দীর্ঘ দিন তিনি এ ব্যবসা করছেন। পড়াশুনার জন্য ঢাকায় যান রিপন। এরপর বাবার অস্বচ্ছলতার কারণে তিনি নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে ঢাকায় থেকে যান। শুরু করেন নানা পদের ব্যবসা। ব্যবসায় লোকসান হলে হারিয়ে ফেলেন তাল। এরপর ঢাকায় প্রথমে একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে ৪ হাজার টাকা বেতনে, পরে এড পয়েন্ট নামে একটি ফার্মে চাকরি নেন ১০ হাজার টাকা বেতনে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসলে সে সময় মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেন। রাতারাতি বদলে যেতে থাকে ভাগ্যের চাকা। বাড়তে থাকে অবৈধ ব্যবসা। স্বর্ণ ও ডায়মন্ড ব্যবসা শুরুর পর থেকে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। এছাড়াও তদবির বাণিজ্য করে বাগিয়ে নিয়েছেন অবৈধ টাকা।
স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে কৌশলে ব্যবহার করেছেন অনেককে। সাবেক জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র ওবায়দুর রহমান চৌধুরী জিপুর সাথে রিপনুল হাসানের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সুবাদে তিনি পৌরসভার ঠিকাদারি কাজ শুরু করেন। এর মাঝে বিএডিসির নিয়ন্ত্রণ নেন মেয়রকে সাথে নিয়ে। সেখান থেকে বাগিয়ে নেন অনেক বীজ সরবরাহের প্রোগ্রাম। বিএডিসির নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয় তার আপন ছোট ভাই রোকনুজ্জামান রোকনকে। চতুর রোকন কৃষকদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন। সাধারণ সম্পাদক হয়ে নিচ্ছেন সুবিধা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রোকন আড়ালে চলে যান। এখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ভিন্ন কৌশলে ভিন্ন বলয়ে যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন।১০ হাজার টাকার কর্মচারী থেকে স্বর্ণ চোরাচালান করে রিপন এখন হয়েছেন কোটিপতি। স্বর্ণ পাচার করতেন চুয়াডাঙ্গার দর্শনা ও জীবননগর এবং ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্যের সহযোগিতায়। স্বর্ণ পাচার সিন্ডিকেটের মূলহোতা হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেন। ঢাকা থেকে আসা স্বর্ণ তার মাধ্যমে তিন সীমান্তবর্তী এলাকায় পৌঁছাতো। এরপর বাংলাদেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যেত।