নুসরাত হত্যা মামলার রায়: নৃশংসতার দৃষ্টান্তমূলক সাজা
নিউজ ডেস্ক:বিচার হলো নৃশংসতার। রায়ও হলো দ্রুততম সময়ে। দৃষ্টান্তমূলক সাজা পেল ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার আসামিরা। মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুুদ- দিয়েছেন আদালত। আসামিদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে। এই টাকা আদায় করে নুসরাতের পরিবারকে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ২১ মিনিটে এ চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায় শুনে আসামিরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিহত নুসরাতের পরিবার রায়ে সন্তোষ জানিয়েছে। ফেনীতে হয়েছে আনন্দ মিছিল। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায় নুসরাতের তেজোদীপ্ত আত্মত্যাগ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এই হত্যাকা-ের বিষয়টি মানুষের সামনে আনায় সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ আদালত।
বিচারক রায় পড়া শুরু করেন বেলা ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে। ১৭২ পৃষ্ঠার রায়ের চুম্বক অংশ পাঠ করেন তিনি। আসামিপক্ষ আপিল করতে চাইলে সাত কার্যদিবসের মধ্যে হাইকোর্টে আবেদন করতে বলা হয়েছে। এর আগে বেলা পৌনে ১১টার দিকে প্রিজন ভ্যানে করে আসামিদের ফেনী জেলা কারাগার থেকে আদালতের হাজতখানায় আনা হয়। তাদের কাঠগড়ায় তোলার পর বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। রায় শেষে আসামিদের আবার জেলা কারাগারে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়।
মামলার দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে বিচারক গত ৩০ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণার এই দিন ধার্য করেন। হত্যাকা-ের সাড়ে ছয় মাসের মাথায় রায়টি হলো। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ১৬ আসামি হলো সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সাবেক সহসভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন, পৌরসভার কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম, মাদ্রাসার শিক্ষক আবদুল কাদের ও আফসার উদ্দিন, মাদ্রাসার ছাত্র নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ যোবায়ের, সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, কামরুন নাহার মণি, উম্মে সুলতানা পপি, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামীম ও মহি উদ্দিন শাকিল।
নুসরাত হত্যা মামলায় বাদীপক্ষে ছিলেন বিচারিক আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর হাফেজ আহমেদ, এডভোকেট আকরামুজ্জামান ও এডভোকেট এম শাহজাহান সাজু। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নুসরাতের বাবা এ কে এম মুসা মানিক ও বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এ রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। পরিবারের নিরাপত্তার আশঙ্কা করে দ্রুত রায় কার্যকর করার দাবি জানান বাদী নোমান। অপরদিকে আদালত পাড়ায় অপেক্ষমাণ আসামির স্বজনরা প্রতিক্রিয়ায় বলেন, পিবিআইয়ের মনগড়া তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী রায় দেয়া হয়েছে। আসামি জাবেদ হোসেনের বাবা রহমত উল্যাহ বলেন, কোনো সাক্ষী আসামিদের বিরুদ্ধে চাক্ষুস সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারলেও আদালতে তা সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণ হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন।
প্রসঙ্গত, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন নুসরাত জাহান রাফি। তাকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় নুসরাতের মা শিরীন আক্তার বাদী হয়ে ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেয়া হয়। গত ৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিতে ওই মাদ্রাসার কেন্দ্রে যান নুসরাত। এ সময় তাকে পাশের বহুতল ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়া হয়। ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় নুসরাতের।
এই ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। ১০ এপ্রিল থানা থেকে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (পিবিআই) কাছে হস্তান্তর করা হয়। আদালত সূত্র জানায়, ২৯ মে এ মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদদৌলাসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে পিবিআই। চার্জশিটভুক্ত ১৬ আসামির মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ৩০ মে মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১০ জুন আদালত মামলাটি আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। ২৭ ও ৩০ জুন মামলার বাদী নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে জেরার মধ্য দিয়ে বিচার কাজ শুরু হয়। এরপর ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জন সাক্ষ্য দেন আদালতে।
এদিকে রায়কে ঘিরে বুধবার রাত থেকে নুসরাতের বাড়িতে পাহারা জোরদার করা হয়েছে। মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মো. খালেদ দাইয়ান বলেন, প্রহরায় নিয়োজিত আগের তিনজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে আরো ৯ সদস্যকে যুক্ত করা হয়েছে। গত ৭ এপ্রিল থেকে বাড়িটিতে পুলিশ পাহারা বসানো হয়। প্রয়োজনে রায় কার্যকর হওয়া পর্যন্ত নুসরাতের পরিবারের নিরাপত্তা দেবে সরকার।