দুই পাকিস্তানি সেনাসহ উভয়পক্ষে ৮ জন নিহত; কারো চাপে পাইলটকে মুক্তি দেয়া হয়নি : কোরেশি
নিউজ ডেস্ক:পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে শুক্রবার বিকেল থেকে কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে ব্যাপক গুলিবিনিময় হয়েছে। এতে দুই পাকিস্তানি সেনাসদস্য ও কাশ্মিরের দুই অংশে ৬ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া বেশ কিছু লোক আহত হয়েছেন। পাকিস্তানে বিমান হামলা চালাতে গিয়ে আটক ভারতীয় পাইলট অভিনন্দনকে শুক্রবার ফিরিয়ে দেয়ার মধ্যেই দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে ভারী অস্ত্রের গোলাবর্ষণ চলছে। এ দিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি বলেছেন, কোনো ধরনের চাপের মুখে ভারতীয় পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্তি দেয়া হয়নি। খবর ডন নিউজ, দ্য নিউজ, বিবিসি ও এনডিটিভির।
পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) পক্ষ থেকে গতকাল বিকেলে জানানো হয়েছে, ভারতীয় সেনাদের গোলাবর্ষণে কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় দুই পাকিস্তানি সৈন্য ও দুই বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং এক নারীসহ দু’জন আহত হয়েছেন। নিহত দুই সেনাসদস্য হলেন হাবিলদার আব্দুর রব ও নায়েক খুররম। তারা নাকিয়াল সেক্টরে নিহত হন। আইএসপিআর আরো জানায়, নিয়ন্ত্রণ রেখার তত্তা পানি ও জনদ্রুত সেক্টরে বেসামরিক এলাকা লক্ষ্য করে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করেছে ভারতীয় সেনারা। আহত বেসামরিক লোকজনকে কোটলির হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাদের পাল্টা গোলাবর্ষণে ভারতীয় সামরিক পোস্ট ধ্বংস ও সেনাসদস্যদের হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে বলে আইএসপিআরের বিবৃতিতে বলা হয়। এ দিকে ডনের এক প্রতিবেদনে বলা বলা হয়েছে, ভারতীয় সেনাদের গুলিতে দারা শের খান এলাকায় আব্দুল গাফ্ফার নামে ১৯ বছরের এক তরুণ নিহত হয়েছে।
পাকিস্তানশাসিত আজাদ কাশ্মিরের কোটলি জেলার ডেপুটি কমিশনার ড. ওমর আজম জানিয়েছেন, শুক্রবার ভারতীয় বাহিনীর গোলাবর্ষণে এক তরুণ নিহত ও তিনজন আহত হয়েছেন। তিনি পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডনকে জানিয়েছেন, কোটলির নাকিয়াল বাজারে ভারতীয় গোলাবর্ষণে ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছেন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা ১৯ বছরের তরুণ মোহাম্মদ সুধীর। জেলার তত্ত্বা পানি এবং গোই সেক্টরে আহত হয়েছেন তিনজন। ঝিলাম উপত্যকা জেলার ডেপুটি কমিশনার জানিয়েছেন, আগের দিন মধ্যরাতে পা-ু সেক্টরে ভারতীয় বাহিনীর প্রচ- গোলাবর্ষণে কমপক্ষে আটটি বাড়ি ও একটি দোকান মাটির সাথে মিশে গেছে। এসব বাড়ির বাসিন্দারা আগেই নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পা-ু সেক্টরের এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে আবারও ওই এলাকায় তীব্র গোলাবর্ষণ শুরু হয়। এ ছাড়া সামাহানি ও বিম্বার জেলা থেকেও দুই দেশের সেনাদের মধ্যে মর্টার এবং কামানের গোলাবিনিময় হয়েছে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম।
অন্য দিকে ভারতীয় সেনারা দাবি করেছে, পাকিস্তানের সেনাদের গোলার আঘাতে দুই শিশু ও এক নারীসহ একই পরিবারের তিনজন নিহত ও অনেকে আহত হয়েছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, শুক্রবার গভীর রাতে কাশ্মিরের পুঞ্চ জেলার সালতোরি এলাকায় পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হয়েছেন। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল দেবেন্দার আনন্দকে উদ্ধৃত করে খবরে বলা হয়, নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে পাকিস্তানি সেনাদের গোলাবর্ষণে অনেকের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সালতোরি, মানকোট ও বালাকোটসহ সংলগ্ন কয়েকটি এলাকায় সন্ধ্যা ৬টার দিকে গোলাবর্ষণ শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। নওশেরা এলাকায় গোলাবর্ষণ শুরু হয় বিকেল ৪টার কিছু পরে। পার্শ¦বর্তী উরি এলাকায় গোলাবর্ষণ শুরু হয় ১২টার দিকে।
কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণরেখায় ব্যাপক গুলিবিনিময় চাপের মুখে মুক্তি দেয়া হয়নি : কোরেশি
ভারতীয় পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে কোনো চাপের মুখে মুক্তি দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি। বিবিসির খবরে বলা হয়, ভারতীয় পাইলটের মুক্তির দাবিতে সৃষ্ট উত্তেজনা কমাতে পাকিস্তানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব চাপ দিয়ে আসছিল। তবে কোনো ধরনের চাপের কথা সরাসরি নাকচ করে দিয়ে কোরেশি বলেন, ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দেয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ ছিল না। কোনো বাধ্যবাধকতাও ছিল না। সাক্ষাৎকারে কোরেশি বলেন, আমরা তাদের (ভারত) জানাতে চাই, আমরা আপনাদের দুঃখ বাড়াতে চাই না। আমরা ভারতীয়দের দুর্দশা চাই না। আমরা শান্তি চাই। তিনি আরো বলেন, পাকিস্তান অতীতে ফিরতে চায় না; কিন্তু যদি ফিরতে হয়, তাহলে আমাদের দেখতে হবে কেমন করে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে হামলা, পাঠানকোট ও উরিতে হামলা হয়েছে। আর সে এক দীর্ঘ ইতিহাস।
আটকের পর অভিনন্দনের বাড়িতে ফোন করেছিলেন কোরেশি :
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, পাকিস্তানে আটক হওয়ার পরই দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি ফোন করেছিলেন অভিনন্দনের বাড়িতে। তার বাবা-মাকে তিনি জানান, অভিনন্দন সুরক্ষিত আছে। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কোরেশি বলেছেন, আটকের পর আমাদের তরফ থেকে অভিনন্দনের বাড়িতে বার্তা পাঠানো হয়। আমরা তার মা-বাবাকে জানিয়েছিলাম, দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার ছেলে সুস্থ ও সুরক্ষিত আছে। তার কোনো ক্ষতি হবে না।
ইমরান খানের প্রশংসা জর্ডানের বাদশাহর :
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের রাষ্ট্রনায়কোচিত উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন জর্ডানের বাদশা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ। শুক্রবার তিনি ফোন করে ইমরান খানকে সাধুবাদ জানান। এ সময় তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সঙ্কট সমাধানে জর্ডানের মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন। টেলিফোনে আলাপকালে বাদশাহ আবদুল্লাহকে শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানিয়েছেন ইমরান খান। এ সময়ে তিনি বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধের মূলে রয়েছে কাশ্মির। জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব অনুযায়ী এ সমস্যার সমাধান হওয়া প্রয়োজন বলে ইমরান খান বাদশাহ আব্দুল্লাহকে জানান।
দেশে ফিরতে পেরে ভালো লাগছে : অভিনন্দন
পাকিস্তানে ৬০ ঘণ্টা আটক থাকার পর মুক্তি পেয়ে ভারতে পা রেখে অভিনন্দন প্রথমেই বলেছেন, নিজের দেশে ফিরে আসতে পেরে ভালো লাগছে। ভারতের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন। শুক্রবার বিকেলের মধ্যেই অভিনন্দনকে দেশে ফিরিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও তাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে রাত ৯টা ২১ মিনিটে। ধীর পায়ে তিনি হেঁটে আসছিলেন ভারতের মাটির দিকে। তার ডান চোখে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অভিনন্দন বর্তমানের ফিরে আসার পর এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ঘরে ফেরায় অভিনন্দনকে স্বাগত! আপনার বীরত্বে দেশ গর্বিত। আমাদের সশস্ত্রবাহিনী ১৩০ কোটি ভারতবাসীর অনুপ্রেরণা ও গর্ব।
মুক্তিতে বিলম্বের কারণ নিয়ে নীরবতা :
শুক্রবার বিকেলের দিকে অভিনন্দনকে ভারতের কাছে হস্তান্তরের কাথা থাকলেও দু’দফা সময় পরিবর্তনের পর ওই দিন রাত ৯টার কিছু পরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তাকে তুলে দেন পাকিস্তানের কর্মকর্তারা। তবে এ দেরির কারণ সম্পর্কে কোনো কথা বলছে না উভয় দেশের কর্তৃপক্ষ। অভিনন্দনকে ফিরে পাওয়ার পর ভারতের এক ডেপুটি কমিশনার বলেছেন, পাইলটকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে পাকিস্তানের কাছে কোনো ব্যাখ্যা চাওয়া হয়নি, তারাও কোনো ব্যাখ্যা দেননি। তবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ধারণা, আটক পাইলটের কাছ থেকে ভিডিও স্বীকারোক্তি রেকর্ড করতে গিয়ে পেছানো হয়েছে তার মুক্তির সময়। অভিনন্দনের মুক্তির কিছু সময় আগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে তার নতুন একটি ভিডিও।
মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি জানায়, পাইলট অভিনন্দনকে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সাথে ছিলেন আন্তর্জাতিক রেডক্রস কর্মকর্তারা। ফিরিয়ে দেয়ার আগে ভারতীয় পাইলটের পূর্ণাঙ্গ মেডিক্যাল পরীক্ষা সম্পন্ন করে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। পদ্ধতিগত কারণে তার দেশে ফেরা বিলম্বিত হয়েছে বলে জানায় এপি।
সরিয়ে দেয়া হলো ভারতীয় বিমানবাহিনীর ওয়েস্টার্ন কমান্ডের প্রধানকে :
পাকিস্তানে ভারতীয় একটি জঙ্গি বিমান ভূপাতিত ও এর পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে আটকের পরদিনই ভারতীয় বিমানবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় এয়ার কমান্ডের প্রধান এয়ার মার্শাল সি হরি কুমারকে অবসর দেয়া হয়েছে। তার স্থলে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পূর্বাঞ্চলীয় এয়ার কমান্ডের প্রধান এয়ার মার্শাল রগুনাথ নাম্বিয়ারকে। ভারতীয় মিডিয়ার খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে পাকিস্তানের দ্য নিউজ এ খবর দিয়েছে। খবরে বলা হয়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে সি হরি কুমারকে পশ্চিমাঞ্চলীয় এয়ার কমান্ডের প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় জঙ্গি বিমানগুলো পাকিস্তানে হামলা চালাতে গেলে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানের আঘাতে ভূপাতিত হয় ভারতের একটি বিমান এবং এর পাইলট অভিনন্দন বর্তমান আটক হন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। এর পরদিনই হরি কুমারকে চাকরি থেকে অবসর দেয়া হয়েছে। গতকাল ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২৮ ফেব্রুয়ারি এয়ার মার্শাল সি হরি কুমারকে চাকরি থেকে অবসর দেয়া হয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় এয়ার কমান্ডের সদর দফতর দিল্লিতে এবং রাজস্থানের বিকানের থেকে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত এই বাহিনীর প্রায় ৪০ শতাংশ বিমানঘাঁটি এই কমান্ডের অধীনে রয়েছে।