পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে যে সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি জেঁকে বসেছিল, তার মধ্যে বিআরটিএ অন্যতম। এতে ব্যতিক্রম ছিলো না চাঁদপুর বিআরটিএ। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রতিষ্ঠানটি সেই কালিমা দূর করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যার নেতৃত্বে রয়েছেন বিআরটিএ চাঁদপুরের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) মোঃ কামরুজ্জামান। দালালদের দৌরত্ব প্রতিরোধ, গ্রাহকদের সেবা সহজীকরনসহ তার নানামুখী উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে।
আর এতেই নড়ে চড়ে উঠে, দীর্ঘ সময় ধরে এই প্রতিষ্ঠান থেকে অনৈতিকভাবে সুবিধা নেওয়া একটি কুচক্রী মহল। তারা গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে চাঁদপুর বিআরটিএর এই উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করতে বিভিন্ন অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানা যায়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দুর্নীতিগ্রস্ত সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানের মত চাঁদপুর বিআরটিএ’র নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন (ইঞ্জিঃ) মোঃ কামরুজ্জামান। চাঁদপুরে যোগদানের পর প্রথমেই তিনি দালাল মুক্ত করনে উদ্যোগ নিয়ে ব্যানার ফেস্টুনে ‘দালান মুক্ত প্রতিষ্ঠান’ লেখা সেঁটে দেন।
এরপর সেবাগ্রহিতাদের অনলাইনে সেবাগ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলে ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন, ফিটনেস সার্টিফিকেট, টেক্স টোকেন, রুট পারমিট ও গাড়ির রেজিস্ট্রেশনসহ যেকোনো সেবার জন্য গ্রাহককে আর বিআরটিএ অফিসে এসে কারো ধর্না ধরতে হয় না।
এর ফলে দীর্ঘকাল ধরে চাঁদপুর বিআরটিএ কার্যালয়কে ব্যবহার করে অনৈতিক অর্থ উপার্জনকারীরা বিপাকে পড়ে যায়। তারা ধরে নেন, বিআরটিএ চাঁদপুর কার্যালয়ের প্রধানকে বিতাড়িত করতে পারলেই দুর্নীতি বিরোধী এই কার্যক্রম ভেস্তে যাবে। তাদের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রথম হাতিয়ার হিসেবে গণমাধ্যমকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা শুরু করে।
এ বিষয়ে কথা হয় চাঁদপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করতে আসা বেশ ক’জন গ্রাহকের সাথে। তাদের একজন সিপন মিয়া জানান, আমার গাড়ির যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে ব্যাংকে গিয়েছি, সেখানেই সরকার ধার্যকৃত টাকা জমা দিয়েছি। এরপর গাড়ি নিয়ে বিআরটি অফিসে এসেছি।
অফিসের মটরযান পরিদর্শক আমার গাড়ি দেখে তারপর রেজিস্ট্রেশনের প্রসেসিং অগ্রসর করেছে। তবে এর আগে শুনেছি বিআরটি অফিসে ব্যাংক ফি এর বাহিরে এক্সট্রা টাকা দিতে হয়। কিন্তু এখন এসে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। এখানে অফিসের স্টাফ ছাড়া বহিরাগত তেমন কেউ নেই, এবং অতিরিক্ত টাকাও কেউ চাইছে না।
চাঁদপুর বিআরটিএ অফিসে সেবা নিতে আসা আরেজন গ্রাহক বিল্লাল হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি অনলাইনের মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করেছি। এরপর কয়েকদিন আগে পরীক্ষা দিয়েছি। আমার পরীক্ষার রেজাল্ট আমার মোবাইল ফোনের মেসেজ এর মাধ্যমে জেনেছি।
অফিস থেকে ওনারা বলল পরীক্ষায় পাস করলে ডোপ টেস্ট করে ব্যাংকের মাধ্যম অথবা বিকাশের মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে তারপর ফিঙ্গার প্রিন্ট করতে হবে। অনলাইনে আবেদনের পর সেখানে যেই সময়সীমা দেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী আমার কাজ এগুচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমার অতিরিক্ত কোন টাকা খরচ করতে হয়নি। যেই ফি ধার্য করা হয়েছে সেটি আমি নিজে গিয়ে ব্যাংকে জমা দিয়েছি।
চাঁদপুরের পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ শাহাতাৎ হোসেন বলেন, চাঁদপুরে কয়েক হাজার পরিবহন শ্রমিক রয়েছে। এসব শ্রমিকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স সহ গাড়ির যাবতীয় কাগজপত্রের কাজ বিআরটি অফিস থেকেই করতে হয়। তারা আমাদেরকে ভোট দিয়ে নেতা নির্বাচিত করেছেন।
আমরা পরিবহন শ্রমিকদের যাবতীয় কার্যক্রমে সহযোগিতা করে থাকি। যেটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তবে আগের তুলনায় অফিসের কার্যক্রম গতিশীল হওয়া এবং অনলাইন মাধ্যম থাকায় ড্রাইভার শ্রমিকদের এখন আর হয়রানি হতে হয় না।
পরিবহন মালিক নেতা হাজী মোশাররফ হোসেন বলেন, পরিবহনের নিরাপত্তা ও যাত্রী সেবা নিশ্চিত করতে পরিবহন মালিক সমিতি কাজ করে। সড়কে গাড়ি চলাচলের যাবতীয় বিষয়ে আমাদেরকে বিআরটি অফিসে যেতে হয়।
এখন তো অনলাইন মাধ্যমের কারণে আমাদের কার্যক্রম গুলো অনেক সহজ হয়েছে। তাই খুব সহজেই কোন ঝামেলা ছাড়া বিআরটি অফিসের সেবা গ্রহণ করা যাচ্ছে। তিনি বলেন, পরিবহনের যাবতীয় বিষয়ে বিআরটি অফিস যত দ্রুত সেবা দিবে ততোই আমাদের এবং যাত্রীদের মঙ্গল।
নিরাপদ সড়ক চাই চাঁদপুর জেলা সভাপতি সাংবাদিক এম এ লতিফ বলেন, নিরাপদ সড়কের জন্য সবার আগে প্রয়োজন বিআরটিএ অফিসের স্বচ্ছ ও গতিশীল কার্যক্রম। বিগত দিনে কিছু দালাল চক্র ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তারা নিজেদের স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে পারেনি।
তবে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর এই অফিসে আমূল পরিবর্তন এসেছে। সড়ক নিরাপদ করতে চাঁদপুর বিআরটিএ অফিস কে অবৈধ যান চলাচলের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযান করতে দেখেছি। এছাড়াও প্রতি মাসে বিআরটি অফিস ও নিরাপদ সড়ক চাই এর যৌথ আয়োজনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সচেতনতা সভা আয়োজন করা হচ্ছে। তাই সাধারণ মানুষ আর এখন অফিসে গিয়ে হয়রানি হচ্ছে না।
এ বিষয়ে বিআরটিএ চাঁদপুরের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, বর্তমান সরকার বিআরটিএর সকল সেবা অনলাইন ভিত্তিক করে দিয়েছেন। এখন আর কোন গ্রাহককে বিআরটি অফিসে এসে কারো ধর্না ধরতে হয় না। ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন, ফিটনেস, টেক্স টোকেন, রুট পারমিট ও গাড়ির রেজিস্ট্রেশন সহ সকল কার্যক্রম অনলাইন মাধ্যমে করা যায়।
তিনি বলেন, ৫ই আগস্টের পট পরিবর্তনের পর বিআরটিএ অফিসকে দুর্নীতিমুক্ত করতে বিআরটিএর চেয়ারম্যান এর নির্দেশে অফিসের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রদবদল করা হয়েছে। নির্বিঘ্নে মানুষ যাতে সেবা গ্রহণ করতে পারে সে লক্ষ্যে অফিসকে দালাল মুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও বহিরাগত দালালরা যাতে গ্রাহক হয়রানি না করতে পারে, সে ব্যাপারে আমরা সোচ্চার রয়েছি। সেবা গ্রহীতা গ্রাহকদেরকেও আমরা নিয়মিত সতর্ক করে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। যাতে সাধারণ গ্রাহক অফিসে না এসে অনলাইনের মাধ্যমে তাদের সেবাগুলো গ্রহণ করে।
পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতাদের বিষয়ে তিনি বলেন, সড়ক পরিবহনকে নিরাপদ রাখতে চাঁদপুরে একটি যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি রয়েছে। যেই কমিটির সভাপতি থাকেন জেলা প্রশাসক মহোদয়। পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতৃবৃন্দ সেই কমিটির সদস্য। তাই পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতারা পরিবহনের যেকোনো সমস্যা সমাধান করার জন্য বিআরটিএ অফিসে আসেন এবং সমস্যার সমাধানে পরামর্শ দেন। তাই আমরা তো তাদের অফিসে আসার ব্যাপারে না করতে পারি না।
সহকারী পরিচালক বলেন, এই অফিসে চাঁদপুর সহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ সেবা গ্রহণ করেন।
তাই এই প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্নীতি মুক্ত এবং জনবান্ধব করে তুলতে চাঁদপুরের পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ এবং গণমাধ্যমকর্মীদের একান্ত সহযোগিতা প্রয়োজন। তাদের সহযোগিতা থাকলে চাঁদপুর বিআরটিএ অফিসকে দুর্নীতিমুক্ত সেবা বান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।