সিরাজগঞ্জে জাপানি প্রকল্পের মালামাল চুরি যেন রুটিন ঘটনা

  • নীলকন্ঠ ডেস্ক: নীলকন্ঠ ডেস্ক:
  • আপডেট সময় : ০৫:৩৪:০০ অপরাহ্ণ, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫
  • ৭১২ বার পড়া হয়েছে

নজরুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ:সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদ এলাকায় জাপানি কোম্পানি আইএইচআই (ওঐও)-এর প্রকল্পে চুরি যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিস্ক্রিয়তা-উদাসীনতায় তৈরি হয়েছে অবৈধ বাণিজ্যের পথ।

স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চোর সিন্ডিকেট এবং কিছু কর্মচারীর যোগসাজশে নিয়মিতভাবে সরকারি প্রকল্প থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ নির্মাণসামগ্রী। একে কেন্দ্র করে এলাকার সাধারণ মানুষ ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। সূত্র জানায়, মালামাল চুরির প্রতিবাদ করলেই হামলা ও মামলা করা হচ্ছে, যাতে কেউ মুখ না খোলে।

সবশেষ, গত বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) গভীর রাতে সিরাজগঞ্জ সদর থানার টইল পুলিশ প্রকল্প এলাকা থেকে দুই চোরকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে। পরে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেপ্তার হওয়া দুজন হলেনÑসয়দাবাদ ইউনিয়নের পূর্বমোহনপুর গ্রামের সোলাইমানের ছেলে বনি আমিন এবং মোহনপুর বারাম গ্রামের কুখ্যাত শাহা আলম ওরফে ‘ভাঙ্গা পিস্তল’-এর ছেলে আল-আমিন।

স্থানীয়রা জানায়, আইএইচআই প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকেই নির্মাণ সামগ্রী চুরি, কাজের মান নিয়ে অনিয়ম এবং অভ্যন্তরীণ অদক্ষতা প্রকল্পটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। রাতের বেলা ট্রাকভর্তি মালামাল গায়েব হয়ে যাচ্ছে, যার বেশিরভাগই যাচ্ছে ভুয়া ঠিকাদারের মাধ্যমে। অথচ প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।

এইচআই অফিসসূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে সিরাজগঞ্জে একটি (নির্দিষ্ট) বিদ্যুৎকেন্দ্র সংযুক্ত ( রেল সেতু ও ডাবিøউডি-৫) প্রকলের কাজ শুরু করে জাপানি কোম্পানি (ওঐও)। প্রকল্পের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত।

প্রকল্পের নথি গেটে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত যমুনা সেতু চালু হওয়ার পরই ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তবে ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাঁটল দেখা দেওয়ায় ট্রেনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। এ সমস্যা সমাধানে ২০২০ সালের ৩ মার্চ যমুনা নদীর ওপর উজানে আলাদা রেল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই বছর ২৯ নভেম্বর রেল সেতুটি নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এরপর ২০২১ সালের মার্চে রেল সেতুর পিলার নির্মাণে পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়।

প্রথমে প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা নির্ধারিত হলেও পরে তা ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ অর্থায়ন এসেছে দেশি উৎস থেকে এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ ঋণ দিয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। দেশের বৃহত্তর এ রেল সেতুর নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করছে জাপানি কোম্পানি ওটিজি ও আইএইচআই জয়েন্টভেঞ্চার।

স্থানীয়দের অভিযোগ, চুরি দমনে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কখনোই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। বরং চুরিতে জড়িতদের অনেককে প্রতিনিয়ত প্রকল্প এলাকায় দেখা যায়। এ ঘটনায় প্রকল্পে কর্মরত একজন সিকিউরিটি সুপারভাইজার এর আগে চুরির প্রতিবাদ করে হামলার শিকার হয়েছিলেন, যার মামলা এখনো চলমান।

এ বিষয়ে সদর থানার ওসি বলেন, আমরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে প্রকল্প এলাকা থেকে দুইজনকে হাতেনাতে ধরেছি। চুরি এখন আর ছোটখাটো বিষয় নয়, এটি একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের কাজ বলেই আমরা ধারণা করছি। তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রকল্প এলাকার সাধারণ মানুষ, কর্মকর্তা এবং কর্মরত প্রকৌশলীদের দাবি-চুরি বন্ধ করতে দ্রæত নিরাপত্তা জোরদার। প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবী জানান সিরাজগঞ্জবাসী।

এ বিষয়ে প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর ফাহিম আহমেদ চুরি হওয়ার বিষয়ে স্বীকার করে বলেন, এ পর্যন্ত চুরি সংক্রান্ত যমুনা সেতু পশ্চিম থানায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার দুটি চলমান। দুর্গম এলাকায় হওয়ায় কোনভাবেই চুরি রোধ করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সদর থানা ও পশ্চিম থানা পুলিশ সার্বক্ষনিক তদারকিতে আছেন।

যমুনা রেল সেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান জানান, চুরির বিষয়ে এর আগেও শুনেছি। এবিষয়ে জেলার এসপি মহোদয়কে ব্যবস্থার নেওয়ার জন্য অবগতও করেছি। সরকারের সাথে এ মালামাল চুরি নিয়ে কোন সংশ্লিষ্টতা না থাকায় আমরা সরাসরি কোন পদক্ষেপ নিতে পারছি না। তবে কর্তৃপক্ষের জোড়ালো পদক্ষেপের মাধ্যমে এটা এড়ানো যেতে পারে।

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

সিরাজগঞ্জে জাপানি প্রকল্পের মালামাল চুরি যেন রুটিন ঘটনা

আপডেট সময় : ০৫:৩৪:০০ অপরাহ্ণ, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫

নজরুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ:সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদ এলাকায় জাপানি কোম্পানি আইএইচআই (ওঐও)-এর প্রকল্পে চুরি যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিস্ক্রিয়তা-উদাসীনতায় তৈরি হয়েছে অবৈধ বাণিজ্যের পথ।

স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চোর সিন্ডিকেট এবং কিছু কর্মচারীর যোগসাজশে নিয়মিতভাবে সরকারি প্রকল্প থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ নির্মাণসামগ্রী। একে কেন্দ্র করে এলাকার সাধারণ মানুষ ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। সূত্র জানায়, মালামাল চুরির প্রতিবাদ করলেই হামলা ও মামলা করা হচ্ছে, যাতে কেউ মুখ না খোলে।

সবশেষ, গত বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) গভীর রাতে সিরাজগঞ্জ সদর থানার টইল পুলিশ প্রকল্প এলাকা থেকে দুই চোরকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে। পরে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেপ্তার হওয়া দুজন হলেনÑসয়দাবাদ ইউনিয়নের পূর্বমোহনপুর গ্রামের সোলাইমানের ছেলে বনি আমিন এবং মোহনপুর বারাম গ্রামের কুখ্যাত শাহা আলম ওরফে ‘ভাঙ্গা পিস্তল’-এর ছেলে আল-আমিন।

স্থানীয়রা জানায়, আইএইচআই প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকেই নির্মাণ সামগ্রী চুরি, কাজের মান নিয়ে অনিয়ম এবং অভ্যন্তরীণ অদক্ষতা প্রকল্পটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। রাতের বেলা ট্রাকভর্তি মালামাল গায়েব হয়ে যাচ্ছে, যার বেশিরভাগই যাচ্ছে ভুয়া ঠিকাদারের মাধ্যমে। অথচ প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।

এইচআই অফিসসূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে সিরাজগঞ্জে একটি (নির্দিষ্ট) বিদ্যুৎকেন্দ্র সংযুক্ত ( রেল সেতু ও ডাবিøউডি-৫) প্রকলের কাজ শুরু করে জাপানি কোম্পানি (ওঐও)। প্রকল্পের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত।

প্রকল্পের নথি গেটে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত যমুনা সেতু চালু হওয়ার পরই ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তবে ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাঁটল দেখা দেওয়ায় ট্রেনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। এ সমস্যা সমাধানে ২০২০ সালের ৩ মার্চ যমুনা নদীর ওপর উজানে আলাদা রেল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই বছর ২৯ নভেম্বর রেল সেতুটি নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এরপর ২০২১ সালের মার্চে রেল সেতুর পিলার নির্মাণে পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়।

প্রথমে প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা নির্ধারিত হলেও পরে তা ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ অর্থায়ন এসেছে দেশি উৎস থেকে এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ ঋণ দিয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। দেশের বৃহত্তর এ রেল সেতুর নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করছে জাপানি কোম্পানি ওটিজি ও আইএইচআই জয়েন্টভেঞ্চার।

স্থানীয়দের অভিযোগ, চুরি দমনে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কখনোই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। বরং চুরিতে জড়িতদের অনেককে প্রতিনিয়ত প্রকল্প এলাকায় দেখা যায়। এ ঘটনায় প্রকল্পে কর্মরত একজন সিকিউরিটি সুপারভাইজার এর আগে চুরির প্রতিবাদ করে হামলার শিকার হয়েছিলেন, যার মামলা এখনো চলমান।

এ বিষয়ে সদর থানার ওসি বলেন, আমরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে প্রকল্প এলাকা থেকে দুইজনকে হাতেনাতে ধরেছি। চুরি এখন আর ছোটখাটো বিষয় নয়, এটি একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের কাজ বলেই আমরা ধারণা করছি। তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্রকল্প এলাকার সাধারণ মানুষ, কর্মকর্তা এবং কর্মরত প্রকৌশলীদের দাবি-চুরি বন্ধ করতে দ্রæত নিরাপত্তা জোরদার। প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবী জানান সিরাজগঞ্জবাসী।

এ বিষয়ে প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর ফাহিম আহমেদ চুরি হওয়ার বিষয়ে স্বীকার করে বলেন, এ পর্যন্ত চুরি সংক্রান্ত যমুনা সেতু পশ্চিম থানায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার দুটি চলমান। দুর্গম এলাকায় হওয়ায় কোনভাবেই চুরি রোধ করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সদর থানা ও পশ্চিম থানা পুলিশ সার্বক্ষনিক তদারকিতে আছেন।

যমুনা রেল সেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান জানান, চুরির বিষয়ে এর আগেও শুনেছি। এবিষয়ে জেলার এসপি মহোদয়কে ব্যবস্থার নেওয়ার জন্য অবগতও করেছি। সরকারের সাথে এ মালামাল চুরি নিয়ে কোন সংশ্লিষ্টতা না থাকায় আমরা সরাসরি কোন পদক্ষেপ নিতে পারছি না। তবে কর্তৃপক্ষের জোড়ালো পদক্ষেপের মাধ্যমে এটা এড়ানো যেতে পারে।