চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে চলছে টিকিট বাণিজ্য। টিকিকের দাম সরকারিভাবে পাঁচ টাকা নির্ধারিত হলেও রোগীর কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা। ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি এই হাসপাতালে শরীয়তপুর, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী থেকে রোগীরা আসেন। মূলত এখানে আসা রোগীরা জানেনই না জরুরি বিভাগের টিকিটের মূল্য ১০ টাকা নয়, পাঁচ টাকা।
এদিকে জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টারে ভর্তি রোগীর কাছ থেকে ১৫ টাকার বিপরীতে নেওয়া হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। শুধুমাত্র টিকিট বাণিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধতা নয়, এখানে পেইংবেইড ও কেবিনের জন্য রোগীদের গুনতে হয় বাড়তি টাকা। নির্ধারিত ফি’র বাইরে বাড়তি টাকা নেওয়ার বিষয়টিরও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন দায়িত্বরত স্টাফরা।
চাঁদপুর সরকারি হাসপাতালে আগে জায়গা স্বল্পতার কারণে জরুরি বিভাগে রোগীদের টিকিট প্রদান করা হতো না। সেখানে অধিকাংশ রোগী টিকিট ছাড়াই জরুরি চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতেন। তবে ২০২৩ সালে জরুরি বিভাগের অবকাঠামো উন্নয়ন হলে জরুরি বিভাগের প্রবেশপথেই আলাদা টিকিট কাউন্টার খোলা হয়। সেখানে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন ৭ জন স্বাস্থ্য সহকারী স্টাফ। এরপরই শুরু হয় টিকিট বাণিজ্য।
জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টারে দুইজন করে মোট ৭ জন পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। এরা হলেন- সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য সহকারী লিটন চন্দ্র নন্দী, মাহবুব, মাহফুজুর রহমান, বাশার, সাকিল, সাইফুল ও রায়হান। মূলত জরুরি বিভাগ থেকে তোলা বাড়তি টাকা ভাগ-বাটোয়ার করেন তারা নিজেরাই।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দেড় শতাধিক রোগী জরুরি বিভাগ থেকে টিকিট সংগ্রহ করেন। যাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ টাকার পরিবর্তে নেওয়া হয় ১০ টাকা। সত্যতা যাচাই করতে প্রতিবেদক রোগী সেজে টিকিট কাউন্টারের ভেতর থেকেই বাড়তি টাকা নেওয়ার প্রমাণ পান।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে সরাসরি কথা হয় জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টারের ইনচার্জ সাকিলের সঙ্গে। সেসময় দায়িত্বে ছিলেন আরেক সহকারী লিটন চন্দ্র নন্দী। এসময় সরকারিভাবে ৫ টাকা না নিয়ে ১০ টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন তারা।
সাকিল জানান, প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ রোগী জরুরি বিভাগ থেকে টিকিট সংগ্রহ করেন। তবে সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে কোনো টিকিটের ফি নেওয়া হয় না। পুলিশ, আনসার, জেলা কারাগারসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের রোগীরা পরিচয় দিলে আমরা ফি নিই না। এছাড়া আমাদের এখানে মাঝেমধ্যেই খাতা, কলম, সিলসহ বিভিন্ন সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়, সেটি এই অর্থ দিয়েই কিনে থাকি।
সরকারিভাবে কিংবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখানে কোনো ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট দেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সাকিল বলেন, আমাদের সব রকম জিনিসপত্র দেওয়া হয়। তবে মাঝেমধ্যে কলম-খাতা প্রয়োজন হয়, সেটি আমরা নিজেরাই কিনে নিই। মূলত যাদের কাছ থেকে ফি নেওয়া হয় না, সেটি পূরণ করতেই আমরা বাড়তি টাকা নিই।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার রুপসা থেকে আসা বিকাশ বলেন, মেয়েকে ডাক্তার দেখানোর জন্য জরুরি বিভাগ থেকে টিকিট সংগ্রহ করেছি। তারা আমার কাছ থেকে দশ টাকা নিয়েছে। আমরা তো জানি জরুরি বিভাগের টিকিট ১০ টাকাই। এখানে যতবার টিকিট কেটেছি তারা আমাদের কাছ থেকে ১০ টাকা করেই নেয়। আজ আপনাদের মাধ্যমে জানলাম সেখানে নির্ধারিত ফি পাঁচ টাকা। এখানে অনেক অসহায় রোগী আসেন তাদের কাছ থেকে যদি বাড়তি টাকা নেওয়া হয়, সেটা তাদের বড় ধরনের অপরাধ। আমি আশা করি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নজরে এনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
‘জরুরি বিভাগের টিকিট ৫ টাকা। ১০ টাকা নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাদেরকে বলা হয়েছে পাঁচ টাকা নেওয়ার জন্য। সেখানে ব্যবহৃত সকল জিনিসপত্র এখান থেকে দেওয়া হয়।’
শরীয়তপুর থেকে আসা রোগী উম্মে কুলসুম বলেন, আমরা সবসময় চাঁদপুর সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসি। আমার বাবা অসুস্থ, জরুরি বিভাগে ডাক্তার দেখানোর পর ভর্তি করেছে। টিকিট কাউন্টারে ভর্তি ফিসহ আমার কাছ থেকে ৩০ টাকা নিয়েছে। আমরা তো জানি না নির্ধারিত নির্ধারিত ফি কোনটা, যা বলে আমরা তাই দিয়ে দিই।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের হেলথ এডুকেটর আমিনুল ইসলাম বলেন, জরুরি বিভাগের টিকিট ৫ টাকা। ১০ টাকা নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাদেরকে বলা হয়েছে পাঁচ টাকা নেওয়ার জন্য। সেখানে ব্যবহৃত সকল জিনিসপত্র এখান থেকে দেওয়া হয়। বিষয়টি আমরা দেখবো এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এ কে এম মাহবুবুর রহমান বলেন, স্পষ্টভাবে বলা আছে জরুরি বিভাগের টিকিট ৫ টাকা, তারা কেন ১০ টাকা করে নিবে। বিশেষ করে ৫ টাকার সিলমোহর টিকেটের ওপর ব্যবহার করতে বলা হয়েছে তাদেরকে। বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। অবশ্যই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।