বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সন্ধ্যায় এমন দৃশ্যের দেখা মিলল চট্টগ্রামের বন্যাকবলিত ফটিকছড়ি উপজেলার সুন্দরপুর এলাকায়।
আজানের শব্দ থামতেই সুন্দরপুরের হরিণাদিঘী গ্রামের বন্যা প্লাবিত একটি ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে নারীর কণ্ঠে ‘আঁরা হডে যাইয়্যুম, ও খোদা তুঁই বাচো’ অর্থাৎ আমরা কোথায় যাব, আল্লাহ তুমি বাঁচাও।
সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা গেলো একটি টিনের ঘরে খাটের ওপর বসে এভাবে বন্যার অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন মধ্য বয়সী এক নারী। তার নাম রহিমা আক্তার।
একদিন আগেও যে ঘরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করেছিলেন সেই ঘর আজ পানিতেই ভাসছে! রান্না থেকে নড়াচড়া সব যেন বন্ধ হয়ে গেল গোয়ালে থাকা শখের গরুটিও কই যেন চলে গেলো তার!
এমন পরিস্থিতি শুধু রহিমার নয়, ফটিকছড়ির বেশিরভাগ এলাকার। কারও ঘরের ওপরে পানি। আবার কেউ কেউ পানিবন্দি। নেই বিদ্যুৎ, খাবার ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা।
গত মঙ্গলবার রাত থেকে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি নদ-নদী বেয়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করে লুকালয়ে ঢুকতে শুরু করে। বুধবার ভোর হতেই উপজেলাটির নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হতে থাকে। যা ক্রমশই বাড়তে থাকে। উপজেলা হালদা, ধুরুং, সর্তাসহ প্রায় সব নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁতে থাকে। ফলে বৃহস্পতিবার এ বন্যা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়।
ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, মিরসরাই, রাউজানসহ কয়েকটি উপজেলায় বন্যায় প্লাবিত। ক্রমশই পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে এসব উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম। স্থানীয়দের অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে আকুতি জানাচ্ছেন উদ্ধারের। উপজেলাগুলোতে আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
ফটিকছড়িতে বাড়ি-ঘর ডুবে পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়েছে ২০ হাজার পরিবারের অন্তত লক্ষাধিক মানুষ। উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের সবকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিতে ডুবে রয়েছে উপজেলার মাইজভান্ডার-রাউজান সড়কও।
বন্যার পানিতে ভাসছে বাজার
স্থানীয় সূত্র বলছে, হালদা নদী, সর্তা খাল, ধুরুং খাল, ফটিকছড়ি খাল, মন্দাকিনী খাল, গজারিয়া খাল, তেলপারি খাল, কুতুবছড়ি খাল, লেলাং খালসহ বিভিন্ন খালের বাঁধ ভেঙে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। এতে উপজেলার ফটিকছড়ি পৌরসভা, নাজিরহাট পৌরসভা, সুন্দরপুর, পাইন্দং, হারুয়ালছড়ি, সুয়াবিল, দাঁতমারা, বাগানবাজার, নারায়ণহাট, ভুজপুর, লেলাং, সমিতিরহাট, রোসাংগিরী, জাফতনগর, বক্তপুর, নানুপুরসহ বিভিন্ন স্থানের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোজ্জামেল হক চৌধুরী বলেন, ফটিকছড়ি দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদী ও বেশকিছু খালের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। লাখো মানুষ পানিবন্দি। আমরা ১৮টি ইউনিয়নের জন্য ১৮ জন কর্মকর্তা নিয়োগ করেছি। লোকজনকে আশ্রয় দিতে আমরা ৩৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছি।
মিরসরাই উপজেলায় ১২টি ইউনিয়নে ১২ হাজার পানিবন্দি পরিবারের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত এবং সীতাকুণ্ড উপজেলায় ৬টি উপদ্রুত ইউনিয়নে ৫ হাজার পরিবারের প্রায় ২০ হাজার জন পানিবন্দি আছে।
আটকে পড়াদের উদ্ধারে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, ছাত্র-জনতা ও বিভিন্ন স্বেচ্ছসেবী সংগঠন। দুর্ঘটনার আশঙ্কায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কিছু এলাকায়। বেশি সমস্যা দেখা দিয়েছে বয়োবৃদ্ধ ও শিশুদের নিয়ে।
রাস্তাঘাট বন্যার পানিতে ডুবে আছে
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা পরিষদের প্রশাসক মাহফুজা জেরিন জানান, মিরসরাইয়ে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। গ্রামীণ পর্যায়ে এখনো কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা তিনি জানাতে পারেননি
তিনি আরও জানান, এ পর্যন্ত ১৭০০ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাকিদের উদ্ধারে স্পিডবোট নিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। ৩০টার অধিক স্পিড বোট আটকে পড়াদের উদ্ধারে কাজ করছে।
এছাড়াও সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া এলাকায় শিকদার খালের মুখে বাঁধের প্রায় ১২ মিটার অংশ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ৬ ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম। জেলা প্রশাসন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, উপজেলায় ৬টি ইউনিয়নে ৫ হাজার পরিবারের প্রায় ২০ হাজার জন পানিবন্দি আছে।
এদিকে রাউজান উপজেলাও পানিতে প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামের বাসিন্দারা পানিবন্দি আছেন।
স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, পশ্চিম নোয়াপাড়া, মোকামীপাড়া, সাম মাহালদারপাড়া, ছামিদর কোয়াং, কচুখাইন, দক্ষিণ নোয়াপাড়া; উরকিরচর ইউনিয়নের মইশকরম, সওদাগরপাড়া, সুজারপাড়া, পূর্ব উরকিরচর, খলিফার ঘোনা ও বৈইজ্জাখালি, বাগোয়ান, পশ্চিম গুজরা, গহিরা, নোয়াজিশপুর, চিকদাইর, ডাবুয়াসহ কয়েকটি গ্রামে ৩২০ পরিবারের ১৬শ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হালদা নদীর হাটহাজারীর অংশে বেড়িবাঁধ দেওয়া হলেও রাউজান অংশে তা নেই। তাই অমাবস্যা-পূর্ণিমা তিথিতে জোয়ারের উচ্চতা বাড়ার কারণে গ্রামগুলোতে পানি ঢুকে পড়ে। এবার বৃষ্টির কারণে পানি আরও বেড়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন তারা।
বাজারে উঠেছে বন্যার পানি
রাউজানের পাশের উপজেলা হাটহাজারীতে বন্যায় প্লাবিত এলাকার মধ্যে রয়েছে বুড়িশ্চর, শিকারপুর, গড়দোয়ারা, দক্ষিণ মাদার্শা, উত্তর মাদার্শা, মেখল, পৌরসভার একাধিক ওয়ার্ড, নাঙ্গলমোড়া, ছিপাতলী। হালদা নদীতে পাহাড়ি ঢল বাড়ায় নদীর উপচে পড়ে তীরবর্তী এলাকার বাড়িঘর পানিতে ডুবে রয়েছে।
হাটহাজারীর ইউএনও এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, উপজেলার ৭ থেকে ৮টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি রয়েছেন প্রায় অর্ধলাখ মানুষ।
বৃহস্পতিবার সকালে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই এবং ফটিকছড়ি উপজেলার ২০ হাজার ১৭৫ পরিবার দুর্যোগ কবলিত। এসব পরিবারের প্রায় ৯৫ হাজার ৯শ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ফটিকছড়ি উপজেলায় সর্বমোট ১৩টি ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ায় ৩১৭৫ পরিবার পানিবন্দি এবং প্রায় ১৫ হাজার ৯শ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোট ৫০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ফটিকছড়ি উপজেলায় ২০ মেট্রিক টন, মিরসরাই উপজেলায় ২০ মেট্রিক টন, এবং সীতাকুণ্ড উপজেলায় ১০ মেট্রিক টন চাল ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। বন্যা মোকাবেলায় ইতোমধ্যে ২৩৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং গঠিত ১৩৭টি মেডিকেল টিমের সবকয়টি চালু আছে।
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ৬১৭ জন পুরুষ, ৬২০ জন মহিলা এবং ২৫ জন প্রতিবন্ধীসহ মোট ১৭২৫ জন নিরাপদে রয়েছে। এছাড়া ৩৭টি গরু এবং ২৫টি ছাগলসহ ৬২টি গবাদিপশু আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।