কালের আবর্তে আমাদের মাঝে উপনীত হয়েছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। দীর্ঘ ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসন-শোষণকে কবর দিয়ে এ দেশের দামাল সন্তানরা এ মাসেই ছিনিয়ে এনেছিলেন বাঙালি জাতির আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন—স্বাধীনতা।
পাকিস্তানিদের জুলুম-নির্যাতন থেকে মুক্ত করেছিল আমাদের মাতৃভূমিকে। এ মাসেই জন্ম হয়েছিল আমাদের স্বাধীন সত্তার, স্বাধীন রাষ্ট্রের। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিল বিজয়ের রক্তিম সূর্য। এ দিনেই আমরা পরিত্রাণ পেয়েছিলাম পাকিস্তানি শোষণ থেকে, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের শৌর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয়ের দিন।
প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জীবনে ফিরে আসে সংগ্রামী সেই সব ইতিহাস নিয়ে, যে ইতিহাসের প্রতিটি অক্ষর লেখা এ দেশের লাখো মানুষের রক্তবিন্দু দিয়ে। ইতিহাস সাক্ষী, প্রায় আড়াই শ বছর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি আমাদের শোষণ করেছে। এ দেশের সম্পদ পাচার করে নিজেদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছে। আর আমাদের উপহার দিয়েছে ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বরণডালা। লাখো মানুষকে মরতে হয়েছে ক্ষুধার জ্বালায়। ওরা আমাদের মান-সম্মানকে বুটের তলায় পিষ্ট করেছে, আমাদের প্রতিবাদী কণ্ঠকে রুদ্ধ করেছে। বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা মাটির নিচে চাপা দিয়েছে বারবার।
এরপর ব্রিটিশরা চলে গেল। দেশও ভাগ হলো। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে হিন্দুরা হিন্দুস্তান কায়েম করল। আর ইসলামের সুমহান আদর্শ—সাম্য, ন্যায়বিচার, সম্পদের সুষম বণ্টন ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইসলামী জীবনাদর্শের কথা ভেবে পাকিস্তান নামক একটি দেশ গঠন করে। পাকিস্তান ছিল দুটি অংশে বিভক্ত। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। উভয় ভূখণ্ডের মানুষই মুসলমান। তারা এক আল্লাহকে সেজদাহ করে, একই দিকে মুখ ফিরিয়ে নামাজ পড়ে। তারা এমন নবীর উম্মত, যাঁর স্পষ্ট নির্দেশ—মুসলমান ভাই ভাই, মুসলমানের রক্ত ও মান-মর্যাদা একে অপরের জন্য আমানত। কাজেই ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূখণ্ডের ফারাক ধর্মের মেলবন্ধনকে ছিন্ন করতে পারবে না—এমনটাই ভাবনা ছিল তাদের। কিন্তু বাস্তবে হলো ঠিক তার উল্টোটা। একই ধর্মের মানুষ হিসেবে ভাই ভাই হয়ে বসবাস করার যে আশা তারা করেছিল, তা উবে গেল অল্প কদিনেই।
পাকিস্তানের নেতারা অচিরেই ভুলে গেলেন আল্লাহ ও আল্লাহর বান্দাদের সঙ্গে প্রদত্ত ওয়াদার কথা। পাকিস্তানি শাসকরা মুখে মুখে ধর্মকে আলিঙ্গন করে রাখলেও অল্প দিনেই কার্যত ধর্মের লেবাস ছেড়ে অধর্মের ডালপালা বিস্তার করেন। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক—সব দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে পদে পদে বঞ্চিত করা শুরু হয়। ব্রিটিশ শোষকদের পেতাত্মা ভর করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ওপর। ঔদ্ধত্য তাদের এতটাই অন্ধ করে দিয়েছে যে এ দেশের শত বছরের নির্যাতিত-নিপীড়িত সহজ-সরল মানুষের বুকে গুলি চালাতেও তারা দ্বিধাবোধ করেনি। ভাষার জন্য, ভোটের অধিকারের জন্য, সর্বোপরি ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার বাঙালির রক্ত ঝরতে থাকে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? অন্যায় যে করে, আর যে সহে—উভয়ই তো সমান অপরাধী। তাই বাংলার দামাল ছেলেরা গর্জে ওঠে। শুরু হয় মাতৃভাষা রক্ষার লড়াই। আর এই লড়াইয়ের স্ফুলিঙ্গ থেকেই জ্বলে উঠল মুক্তিযুদ্ধের মশাল।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে এ দেশের অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে। মা-বোনরা সম্ভ্রম হারিয়েছে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। সেই অগণিত মানুষের অগণনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসলই হলো এই বিজয়। এ দিনটি যেন আমাদের ১৯৭১ সালের সেই দিনটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যেদিন হাজার হাজার নারী-পুরুষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে রওনা হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য দেখার জন্য। সেদিন সব ঘরবাড়ি, দালানকোঠার শীর্ষদেশে শোভা পাচ্ছিল স্বাধীন বাংলার রক্ত-রঙিন পতাকা। তখন জাতির মনের একদিকে ছিল বিজয়ের আনন্দ, অন্যদিকে ছিল নিকটজন হারানোর বেদনা।
অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সেদিন সব বাঙালির প্রাণে প্রাণে বেজে উঠেছিল বিজয়ের সুর। ছড়িয়ে পড়েছিল সৃষ্টি সুখের উল্লাস।
এত কষ্টার্জিত বিজয়ের দিনে জাতি তাদের বিজয়ানন্দে আনন্দিত হবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এ কথা আমাদের খুব ভালো করে স্মরণে রাখতে হবে। মুসলমান হিসেবে আমাদের আইডল বা আদর্শ হলো বিশ্বমানবতার মূর্তপ্রতীক, মুক্তির দিশারি, সফল রাষ্ট্রনায়ক, মহান নেতা বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। আমরা যা কিছু করব, নবীজির আদর্শেই করব। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসুলের মধ্যে উত্তম আদর্শ। ’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ২১)
অন্য আয়াতে আছে, ‘যারা আপনার [মুহাম্মদ (সা.)] কাছে আনুগত্যের শপথ করে, তারা তো আল্লাহর কাছে আনুগত্যের শপথ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপর রয়েছে। সুতরাং যে শপথ ভঙ্গ করে, অবশ্যই সে তা নিজের ক্ষতির জন্যই করে। আর যে আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে, আল্লাহ শিগগিরই তাকে মহাপুরস্কার দান করেন। ’ (সুরা : আল-ফাতহ, আয়াত : ১০)
এ জন্য দেশপ্রেম, আনন্দ-বিজয় থেকে শুরু করে জীবনের সব ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর অনুসরণ করতে হবে।
প্রত্যেক ধর্মেই স্বদেশপ্রেমের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলামে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর পথে এক দিন ও এক রাত সীমান্ত পাহারা দেওয়া এক মাস পর্যন্ত সিয়াম পালন ও এক মাস ধরে রাতে সালাত আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। যদি এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল, মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে; তার রিজিক অব্যাহত থাকবে, কবর-হাশরের ফিতনা থেকে সে নিরাপদ থাকবে। ’ (মুসলিম, হাদিস : ১৯১৩)
আমরা যারা মুসলমান, বিজয় দিবসে তাদের করণীয় কী? আমাদের করণীয় হলো, আট রাকাত নফল নামাজ পড়া। কেননা নবী (সা.) বিজয়ের দিন শুকরিয়াস্বরূপ আট রাকাত নামাজ আদায় করেছিলেন। (জাদুল মা’আদ, আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওজি)
বিজয়ের দিনে বিজয়ীদের জন্য আরো কিছু করণীয় সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন। তখন আপনি আপনার পালনকর্তার পবিত্রতা বর্ণনা করুন। আর তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাকারী। ’ (সুরা : আন-নাসর, আয়াত : ১-৩)
এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, বিজয় দিবসের দিন আমাদের যা করতে হবে তা হচ্ছে—
* আল্লাহর বড়ত্ব ও পবিত্রতার বর্ণনা করা।
* যুদ্ধ চলাকালীন আমাদের অজান্তে যেসব ভুলত্রুটি হয়েছে, তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
আর হাদিস শরিফ থেকে আমরা জানতে পারি—
* আট রাকাত নামাজ আদায় করা।
* মৃত ব্যক্তিদের জন্য ইস্তেগফার ও দোয়া করা। কোরআন পাঠসহ বিভিন্নভাবে ইসালে সওয়াব করা।
মুসলমানদের উচিত, ইসলামী সংস্কৃতি অনুসরণ করে মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ করা এবং বিজয় দিবসের আনন্দ উদ্যাপন করা।
স্বদেশপ্রেম প্রতিটি মানুষের স্বভাবজাত অভ্যাস। বিশেষত মুসলমানদের প্রতিটি রক্তকণিকায়ই দেশপ্রেমের শিহরণ থাকা বাঞ্ছনীয়। কেননা ইসলামের প্রাণপুরুষ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন দেশপ্রেমিকের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হিজরতের সময় বারবার জন্মভূমি মক্কার দিকে অশ্রুভরা নয়নে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। কাফেররা যদি নির্যাতন করে আমাকে বের করে না দিত, কখনোই আমি তোমাকে ত্যাগ করতাম না। ’ (ইবনে কাসির : ৩/৪০৪)
মহানবী (সা.) কোনো সফর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মদিনার সীমান্তে ওহুদ পাহাড় চোখে পড়লে নবীজির চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠত। তিনি বলতেন, এই ওহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও ওহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি। ’ (বুখারি শরিফ : ২/৫৩৬, ৩/১০২৮; মুসলিম : ২/৯৯০)
সুতরাং এ কথা প্রত্যেক মুসলমানের হৃদয়ে গেঁথে নিতে হবে যে স্বদেশকে ভালোবাসা, জন্মভূমিকে ভালোবাসা নবীজির আদর্শ ও ইমানের বহিঃপ্রকাশ। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের সার্বভৌমত্ব, আমাদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখেন। আমাদের স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন। (আমিন)