নিউজ ডেস্ক:
ধর্ম শব্দটির অর্থ হচ্ছে ১. বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শাস্ত্রনির্দিষ্ট বিধিবিধান। যেমন ইসলাম ধর্ম; খ্রিষ্ট ধর্ম; ইহুদি ধর্ম; বৌদ্ধ ধর্ম; সনাতন ধর্ম; শিখ ধর্ম ইত্যাদি। ২. সৎকর্ম; পুণ্যকর্ম; সদাচার; কর্তব্যকর্ম। ৩. স্বভাব; প্রকৃতি; গুণ ইত্যাদি। অভিধান মতে, ধর্ম শব্দটি স্বভাব অর্থেও ব্যবহার হয় যেমন- আগুনের ধর্ম। মানব ধর্ম (সন্ত্রাসীদের ধর্মই এমন) ইত্যাদি। নীতি অর্থেও ধর্ম তার অর্থ প্রকাশ করে ( এই তোর ধর্ম; এসব করা কী তোর ধর্মে শোভা পেল?)। তবে পবিত্র কুরআন এবং হাদিসের কোথাও ধর্ম শব্দটির উল্লেখ করা হয়নি। এটি কুরআন হাদিসের ভাষাও নয়। শব্দটি সংস্কৃত ভাষার শব্দ। অর্থাৎ ধর্ম হচ্ছে সংস্কৃত শব্দ; এর অর্থ, শাস্ত্রের বিধিনিষেধ। শব্দটি বাংলা ভাষার শব্দ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আরবি ভাষার ‘দ্বীন’ শব্দের প্রতি শব্দ হিসেবে ধর্ম শব্দটি বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে ব্যবহার হয়ে থাকে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর নিকট মনোনীত দ্বীন।’ আরবি ভাষায় ‘দ্বীন’ শব্দের প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘শরিয়াত, তাবিয়াত, খাসিলত; এগুলোও আরবি শব্দ। ‘শরিয়াত’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নিয়ম, নীতি, বিধিবিধান। তবিয়াত; খাসিলাত; অর্থ হচ্ছে স্বভাব, গুণ, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি। তাহলে কুরআনে বর্ণিত দ্বীন শব্দের অর্থ দ্বারা বুঝা যাচ্ছে মানুষের স্বভাব, গুণ, বৈশিষ্ট্য যা ইসলাম অনুযায়ী গঠিত হবে অর্থাৎ মানুষের স্বভাব, গুণ, বৈশিষ্টের সামগ্রীক রূপ হচ্ছে জীবনব্যবস্থা এবং এই জীবনব্যবস্থাকেই আল্লাহ পছন্দ করেন। মুসলিমগণ সেই শরিয়াত তবিয়াতের অনুসারী। পৃথিবীর অন্যসব মানুষ তাদের নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী ধর্ম বেছে নেন এবং অনুসরণ করেন। হজরত আদম আ: থেকে হজরত মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত সব নবীরাসূলের পছন্দের জীবনব্যবস্থা ছিল ইসলাম। সর্বশেষ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামধর্মে মানুষের প্রয়োজনীয় মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য ধর্মেও ব্যক্তি মানুষকে কিভাবে সামাজিক মানুষে পরিণত করা যায় সে শিক্ষাই দেয়া হয়েছে। ধর্মের অনেক বিধিবিধান রয়েছে যেগুলো ব্যক্তি ইচ্ছে করলেও একা একা পরিপূর্ণ করতে পারে না; অন্যান্য মানুষেরও সংশ্লিষ্টতা সেখানে থাকে। অর্থাৎ ধর্মের বিধিবিধান অধিকাংশ সময় টিমওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থাৎ পরস্পরে মিলে সম্পন্ন করতে হয়। কাজেই ধর্ম ব্যক্তিগত কোনো বিষয় কিনা তা ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় মানুষের চিন্তাতে ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে, ধর্ম একটি ব্যক্তিগত ব্যাপারস্যাপার; এটি নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলবার কোনো প্রয়োজনই পড়ে না। মসজিদে যাও মন্দিরে যাও তুমি নিজে নিজে যাও; এতে এত হাঁকডাক করার কী আছে। পারলে চুপচাপ ধর্মকর্ম করো আর না পারো তো যেমন চলছ তেমন করেই চলতে থাক। এ রকম তত্ত্ব পরিবেশিত হতে থাকলে ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায় এবং মানুষের উপলব্ধিতে জীবন ধারণের ক্ষেত্রে ধর্ম অতি সামান্য বিষয় হিসেবে পরিজ্ঞাত হতে পারে। যারা ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে আবদ্ধ করার তদবিরে ন্যস্ত তারা এমন ধারণাটিই সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা পোষণ করে থাকতে পারেন।
ধর্ম বা ধর্মের বিষয়াবলি ব্যক্তিগত নয় কিন্তু ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করার ব্যাপারটি ব্যক্তিগত হতে পারে। কোনো মানুষ কোনো একটি বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করবেন কিনা সেটি সে মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু যখনই কোনো মানুষ ধর্মের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করে, তখনই তার প্রতি ধর্মের বিধিবিধান মোতাবেক সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ যদি ধর্মের নির্ধারিত বিধিবিধান মোতাবেক না চলেন তবে তার ধর্মে বিশ্বাস করা আর না করা সমান হয়ে যায়। যদি ধর্মে বিশ্বাসী লোক বিধিবিধান মেনে চলেন তাহলে ব্যক্তি সেই বিধান দ্বারা নিজে প্রভাবিত হবেন এবং সমাজও প্রভাবিত হবে। অর্থাৎ ধার্মিক মানুষের জন্য তখন আর ধর্ম পালন ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকে না; ধর্ম এবং ধার্মিক সামাজিক বিষয় হয়ে ওঠে। ধর্মে বিশ্বাসীকে বলা হয় আস্তিক আর ধর্মে বিশ্বাস রাখে না এমন ব্যক্তিকে বলা হয় নাস্তিক। ধর্ম সামাজিক হলে আস্তিকও সামাজিক হবেন আর নাস্তিকের অসামাজিক হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যেতে পারে।
কোনো একজন মানুষ যখন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস রাখে তখন তাকে মুসলিম বলা হয়। এই মুসলিমকে ধর্মের আদেশ নিষেধ পালন করতে হয়। ইসলাম ধর্মের বিধিবিধানগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে তা সমাজের বাইরে পালন করা যায় না; সমাজের ভেতরেই পালন করতে হয়। ধর্ম পালন করার জন্য ধার্মিককে বনেজঙ্গলে যেতে হয় না এবং সেখানে যাওয়ার কোনো সম্মতিও নেই। সমাজেই ধর্ম পালন করতে হবে এবং সমাজকেই ধর্মের বিধিনিষেধের ভেতরে নিয়ে আসার নির্দেশ রয়েছে। সমাজের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই ধর্ম সৃষ্টি হয়েছে। ধর্ম নতুন কোনো তত্ত্ব নয়। মানুষ যখন থেকে পৃথিবীতে এসেছে ধর্মও তখন থেকে পৃথিবীতে। মানুষ সমাজ তৈরি করেছে আর সমাজকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ধর্ম এসেছে। ধর্ম ব্যক্তিগত হলে ধর্ম এতকাল টিকে থাকতে পারত না। সমাজের প্রয়োজনেই ধর্মকে টিকে থাকতে হবে অথবা সমাজই ধর্মকে টিকিয়ে রাখবে। ধর্ম মানুষের জন্য আর মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে বেঁচে জীবন ধারণ করে।
ইসলামধর্মের মৌলিক বিষয় বা স্তম্ভ হচ্ছে পাঁচটি। যথা- তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করা; নামাজ প্রতিষ্ঠিত করা; জাকাত প্রদান করা; বায়তুল্লাহ তাওয়াফ (হজ) করা এবং রমজান মাসের র্ফজ রোজা পালন করা । এগুলোর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে জীবনে বাস্তবায়িত করার নামই ধর্ম। এ সবে কোনো মানুষ বিশ্বাস করবেন কিনা সেটা সে মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। যখনই কোনো মানুষ এসবে বিশ্বাস স্থাপন করবেন তখনই এসব পরিপূর্ণ পালন করার জন্য মানবসমাজকে প্রয়োজন পড়বে। ধর্ম যদি ব্যক্তিগত হয় তাহলে নিজ বাড়িতে ঘরের কোনায় কাবাঘর তৈরি করে হজ পালন করতে হবে। জাকাতের অর্থকে নিজের জামাকাপড় কেনার জন্য ব্যবহার করতে হবে। নামাজ যদি ব্যক্তিগত হয় তাহলে আপনি নামাজ পড়বেন কিনা সেটাও ব্যক্তিগত হয়ে যায়। কিন্তু নামাজকে যখন যেভাবে যে সময়ে পড়ার নির্দেশ রয়েছে সেভাবেই সে সময়ে পড়তে হবে। নামাজ ব্যক্তিগত নয় বলেই ইচ্ছামতো পড়া যায় না।
ইসলাম ধর্মের সব বিষয় সমাজের সাথে সংশ্লিষ্ট। শুধু তাওহিদ বা একত্ববাদে বিশ্বাস করা না করাটা ব্যক্তিগত। অন্য ধর্মগুলো ব্যক্তিগত বিষয় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। তবে ৯০ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশে যখন কেউ কোনো ধর্মকে নির্দিষ্ট না করে মন্তব্য করেন তখন সে দেশের বৃহত্তর ধর্মটির ওপরই সে মন্তব্যের আঁচড় লাগতে পারে। ঢালাওভাবে সবধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় উল্লেখ করে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে না পারলে সমাজ অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।
ইসলামধর্ম যে সমাজনির্ভর ধর্ম তার উদাহরণ হতে পারে নামাজ। ইসলাম ধর্মের অন্যতম বিধান নামাজ পড়া। মুসলিমকে একা একা নামাজ পড়া থেকে জামায়াতের সাথে নামাজ পড়ার ব্যাপারে জোরালো তাকিদ দেয়া হয়েছে। নামাজের উপকারিতা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘আপনি পাঠ করুন কুরআন হতে যা আপনার ওপর নাজিল করা হয়েছে, আর নামাজ কায়েম করুন; নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে; আল্লাহর যিকির সর্বোত্তম, আর তোমরা যা কর আল্লাহ তা অবগত আছেন’ [সূরা আনকাবুত; ৪৫]। তাহলে নামাজ পড়া ব্যক্তির খারাপ কাজ না করা মানে সে নিজের এবং সমাজের অন্য মানুষের অনিষ্ট করা থেকে নিজেকে দূরে রাখাকে বুঝায়। অর্থাৎ নামাজ পড়া ব্যক্তির দ্বারা সমাজের অন্য মানুষদের উপকার না হলেও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকতে পারে। ধর্মের এই বিধান সম্পূর্ণভাবে সমাজনির্ভর বলা যেতে পারে।
ইসলাম ধর্মের আরেকটি বিধান হলো বিত্তবান লোকের জন্য সম্পদের জাকাত আদায় করা অত্যাবশ্যক। ধর্মের নির্দেশিত পন্থায় আদায়কৃত জাকাতের অর্থ সমাজের আট শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বণ্টন করার হুকুম রয়েছে। এই আট শ্রেণীর মানুষ হচ্ছে নিকটাত্মীয়দের মধ্য থেকে যারা ‘ফকির, মিসকিন, মুসাফির, ঋণগ্রস্ত, ক্রীতদাস, জাকাত আদায়কার্যে নিযুক্ত কর্মচারী, ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষে এবং জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ [সূরা তওবা; ৬০]। আদায়কৃত জাকাতের অর্থ গরু ছাগল, পশুপ্রাণীকে দিয়ে দিতে বলা হয়নি কিংবা নদীনালা, খালবিল, সাগর মহাসাগরেও ফেলে দিতে বলা হয়নি। ধর্মের এই হুকুমটি পালন করতে গেলে অবশ্যই সমাজের মানুষকে প্রয়োজন পড়ে। সুতরাং ধর্ম এখানেও সামাজিক হয়ে ওঠে। আবার আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিকে ধর্ম দান সদকা করতে উৎসাহিত করেছে। যারা দান করেন তারা কোনো পশুপাখি, ছাগলভেড়াকে দানের অর্থকড়ি দিয়ে দেন না। দাতা সমাজের মানুষের মধ্যেই দানের অর্থ বিলিয়ে দেন। এখানেও ধর্ম সামাজিক দায়িত্ব পালন করে। ধর্মের আরেকটি নির্দেশনা রয়েছে। সেটি হলো কোরবানি করা। কোরবানির পশু শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যে জবাই করা হয়। জবাই করা পশুর গোশত ও চামড়া সমাজের মানুষের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার বিধান রয়েছে। কোরবানিও সামাজিক ইবাদত হিসেবে পরিগণিত। পিতা-মাতার হক আদায় করা এবং প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করা ধর্মের নির্দেশনা। প্রতিবেশী সমাজেরই মানুষ। সুতরাং ধর্মের অপব্যাখ্যা প্রতিরোধে ঐকবদ্ধ থাকা জরুরি কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে।
লেখক : গবেষক