নীলফামারী — দেশের উত্তরের এক শান্ত শহর। পাহাড় নেই, সাগর নেই, কিন্তু আছে এক শিক্ষাগুরুর আত্মত্যাগ আর বিশ্বাসের দুর্নিবার আলো। এই শহরে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে এক মানুষ একা হাতে জ্বেলে গেছেন শিক্ষার প্রদীপ, ছড়িয়ে দিয়েছেন মানবিকতার বাতাস। তিনি নুরুল করিম—শুধু একজন শিক্ষক নন, তিনি হয়ে উঠেছেন এই শহরের এক জীবন্ত প্রতীক, এক ব্রতী মানুষ, এক প্রেরণাসঞ্চারী বাতিঘর।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নুরুল করিম ছিলেন নীলফামারী সরকারি কলেজের এক উজ্জ্বল মুখ। তবে তার পরিচয় এতটুকুতে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, বন্ধু, অভিভাবক, মানবসেবক এবং পথপ্রদর্শক। সমাজের প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক জীবন্ত বটবৃক্ষ, যার ছায়ায় দাঁড়িয়ে হাজারো শিক্ষার্থী খুঁজে পেয়েছে আত্মবিশ্বাস, আশ্রয় ও স্বপ্নের ঠিকানা।
বিশেষ করে কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন এক আশীর্বাদস্বরূপ। এমন অসংখ্য শিক্ষার্থী রয়েছেন, যারা শুধুমাত্র তাঁর জন্যই নীলফামারী সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছেন। অভাবে থাকা শিক্ষার্থীদের তিনি নিজ খরচে বই সরবরাহ করেছেন, ক্লাসের বাইরে সময় দিয়েছেন, বছরের পর বছর নিজ বাড়ির ছাদ বা রুমে,মাঠে কিংবা কোন শিক্ষার্থীর বাড়ির উঠানে বিনামূল্যে কোচিং করিয়েছেন।
শিক্ষক যখন আশ্রয়
করোনার ভয়াবহ সময়ে মানুষ যখন ঘরবন্দি, তখনও নুরুল করিম স্যার শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়েছেন নির্মাণাধীন ভবনে নিয়েছেন ক্লাস। কারণ তাঁর কাছে শিক্ষকতা শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক শেষ করার কাজ ছিল না; ছিল হতাশ ছাত্রকে সাহস দেওয়া, হার না মানার মন্ত্র শোনানো।
নুরুল করিম স্যারের দায়িত্ববোধ কাগজে লেখা কোনো অনুচ্ছেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পাঠ্যক্রমের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি ছুঁয়ে গেছেন জীবন রচনার পাঠ। তাঁর “স্বপ্ন দেখো, আমি আছি” বিখ্যাত উক্তি যেন শিক্ষার্থীদের হৃদয়ের মন্ত্র হয়ে উঠেছে।
নুরুল করিম স্যার কখনোই কোচিং বাণিজ্যে জড়াননি। শত শত শিক্ষার্থীকে তিনি ভর্তি পরীক্ষার জন্য ফ্রি-তে প্রস্তুত করেছেন। এমনকি ভর্তির সময় যেসব শিক্ষার্থীর আর্থিক সামর্থ্য ছিল না, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন নিঃশব্দে।
হাজারো ‘পাবলিকিয়ান’ তাঁর তৈরি
নুরুল করিম স্যারের অবদান শুধু নীলফামারীতে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর হাতে গড়া শিক্ষার্থীরা আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের প্রায় সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। কেউবা চাকরি জীবন শুরু করেছে, কেউবা গবেষণায় ব্যস্ত। তাঁর শিক্ষাদান ছিল শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতা গঠনের দিকেও সমান মনোযোগী। তিনি শিখিয়েছেন কিভাবে মানুষ হতে হয়, কিভাবে সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হয়।
২০২৫ সালে সরকারি বদলির আদেশে নুরুল করিম স্যার এখন অন্যত্র যোগদান করতে যাচ্ছেন। শহরের রাস্তায়, ব্যানারে তাঁর বিদায়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই শিক্ষার্থীদের আবেগ যেন বাঁধ ভেঙে পড়ে। কেউ লিখেছে—
“স্যার, আপনি যাচ্ছেন, কিন্তু রেখে যাচ্ছেন অগণিত হৃদয়ে এক অমোচনীয় শূন্যতা।”
আরেকজন লিখেছে—
“এই ব্যানারটা দেখে ভীষণ খারাপ লাগছে। সত্যিই অনেক খারাপ লাগছে..!!”
এই বিদায় শুধু একজন ব্যক্তির নয়; এটি এক যুগের, এক অনন্য চেতনার বিদায়।
শিক্ষকতার বাইরেও তাঁর পরিচয়
নুরুল করিম স্যার শুধুই একাডেমিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না। শীতার্ত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র, বন্যার্তদের জন্য খাদ্য সহায়তা, রক্ত কালেক্ট, বৃক্ষ রোপণ কিংবা রমজান মাসে ত্রিশটা এতিমখানায় ইফতার আয়োজন অথবা ফিলিস্তিনের সংকটে সোচ্চার কণ্ঠ—সবখানেই তাঁর পদচিহ্ন ছিল পরিপূর্ণভাবে মানবিক। তিনি দৌড়ান, ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে মেতে উঠেন —জীবনের প্রতিটি শাখায় যেন নতুন চেতনাকে ধারণ করে চলেছেন এই মানুষটি।
এই শহর হয়তো হারাচ্ছে তাঁর অনুপস্থিতিতে এক পরিচিত মুখ, এক অভিভাবকতুল্য শিক্ষকের দৃশ্যমান উপস্থিতি। কিন্তু তাঁর তৈরি করা শিক্ষার্থীরা, তাঁর রোপিত আদর্শ, তাঁর মানবিকতার গল্প—সব কিছু আজ নীলফামারী শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে আছে।
তাঁকে বিদায় জানিয়ে আমরা জানি—আলো নেভে না, আলো ছড়িয়ে পড়ে।