নারী-পুরুষ-শিশু সব বয়সী মানুষই এখন এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ দেশের সব সরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য মাত্র ৮২টি শয্যা রয়েছে। বিশেষজ্ঞ রয়েছেন ৪০ জন। সরকারি এই চিকিৎসাসেবা সম্পর্কেও মানুষ অবগত নয়। চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি জানায়, দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সুুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। সীমিত পরিসরের কয়েকটি জরিপে দেখা গেছে, গ্রামে ৮ ও শহরাঞ্চলে ১০ শতাংশ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। জনসংখ্যা ও আক্রান্তের হার বিশ্লেষণ করে তাদের ধারণা, দেশের নূ্যনতম ৮৪ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আইডিএফের চলতি বছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। আক্রান্তের এ হার অব্যাহত থাকলে ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে পেঁৗছাবে। এক হিসাবে দেখা গেছে, কেবল ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার কমাতে পারলে স্বাস্থ্য খাতে ১১ শতাংশ ব্যয় কমানো সম্ভব। অথচ রোগটি নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধে জনসচেতনতা ও চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধির কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। দেশে ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনিসহ দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসায় সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলা ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে সরকারি কোনো উদ্যোগই চোখে পড়ে না। দেশের মানুষের কাছে ডায়াবেটিক সমিতি বা বারডেমই এ রোগের প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সরকার অন্যান্য রোগের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করেছে, ডায়াবেটিসের বিষয়েও পদক্ষেপ নেবে। কীভাবে সরকারি হাসপাতালে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কেন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়: ডায়াবেটিস একটি বিপাকজনিত রোগ। মানবদেহে ইনসুলিন নামক হরমোনের ঘাটতি হলে বা উৎপাদিত ইনসুলিন কার্যকরভাবে শরীরে ব্যবহৃত না হলে কিংবা ইনসুলিন নিষ্ক্রিয় থাকলে রক্তে গ্গ্নুুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই গ্গ্নুকোজ পরে প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। এ অবস্থার নামই ডায়াবেটিস। ঘন ঘন প্রস্রাব, স্বল্প সময়ে ওজন কমে যাওয়া, অধিক তৃষ্ণা, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, অতিশয় দুর্বল ভাব, অতিরিক্ত ক্ষুধা, ক্ষত না শুকানো- এগুলোই ডায়াবেটিসের লক্ষণ। জন্মগত কিংবা পরিবেশগত কিছু কারণে টাইপ-১ বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস হতে পারে। বছরে প্রায় ৩ শতাংশ হারে এ ডায়াবেটিস বাড়ছে এবং তরুণরাই এতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত ওজন, মেদবাহুল্য, কায়িক শ্রমের অভাব, উচ্চ শর্করা ও কম আঁশযুক্ত খাদ্য গ্রহণের অভ্যাসে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হতে পারে। এ ছাড়া পারিবারিক ইতিহাস, জন্মের সময় ওজন কম থাকা, প্রবীণদের মধ্যেও টাইপ-২ বা ইনসুলিননির্ভর নয় এমন ডায়াবেটিস দেখা যায়। ডায়াবেটিক রোগীরা হৃদযন্ত্র, রক্তনালি, কিডনি, স্নায়ুতন্ত্রের নানা সমস্যার পাশাপাশি দৃষ্টিহীনতার শিকার হতে পারেন। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ৭০ ভাগই প্রতিরোধ করা সম্ভব। সুষম খাবার গ্রহণ, কোমল পানীয় ও ফাস্টফুড পরিহার, নিয়মিত ব্যায়াম এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো চললে এটি প্রতিরোধ সম্ভব।
বর্তমানে দেশে ডায়াবেটিস মহামারী আকার ধারণ করছে। প্রতিবছর আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। বাডাস সূত্রে জানা গেছে, বারডেম, ন্যাশনাল হেলথকেয়ার নেটওয়ার্ক (এনএইচএন), হেলথকেয়ার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এইচসিডিপি) ও অধিভুক্ত সমিতিতে এখন ৩৫ লাখের বেশি নিবন্ধিত ডায়াবেটিক রোগী রয়েছেন। গত দুই বছরে পাঁচ লাখ করে নতুন রোগী নিবন্ধিত হয়েছেন। আগের তিন বছর গড়ে তিন লাখ করে নিবন্ধন নিয়েছিলেন।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) ২০১১ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক ৩৯ শতাংশ নারী-পুরুষের রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি। তাদের ১১ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২৫ শতাংশ ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থায় রয়েছে। উচ্চশিক্ষিত, ভালো আর্থিক অবস্থা- এমন মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস আক্রান্তের হার বেশি। ধনী পরিবারের নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার দরিদ্রদের তুলনায় তিন গুণ বেশি।
আইডিএফ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৪১ দশমিক ৫০ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এখনই প্রতিরোধ করা না গেলে ২০৪০ সাল নাগাদ আক্রান্তের সংখ্যা ৬৪ দশমিক ২০ কোটিতে পেঁৗছানোর আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডায়াবেটিসের কারণে প্রতিবছর পাঁচ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, রোগটির কারণে অর্থনৈতিক চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেননা, ডায়াবেটিসের ওষুধ, ইনসুলিন সবকিছুরই দাম দিন দিন বাড়ছে।
সংকটে সরকারি চিকিৎসা: পরিস্থিতি ক্রমে উদ্বেগজনক আকার ধারণ করলেও এ রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। রোগটি প্রতিরোধে বাডাসের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দেওয়া একটি খসড়া নীতিমালা মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেলেও এখনও গেজেট আকারে জারি হয়নি। বাডাসের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, জাতীয় নীতিমালার গেজেট নোটিফিকেশন হওয়ার পর তা কার্যকর করা হবে। ওই নীতিমালায় থাকা বিষয়বস্তু কার্যকর হলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৪ সালে প্রকাশিত হেলথ বুুলেটিনে বলা হয়েছে, ওই বছর সরকারি হাসপাতালে যত রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে ডায়াবেটিস আক্রান্ত বা ডায়াবেটিস-পূর্ব অবস্থায় রয়েছেন। অথচ সারাদেশের সরকারি হাসপাতালের ৫০ হাজার শয্যার মধ্যে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য মাত্র ৮২টি পৃথক শয্যা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ১৩টি শয্যা। পুরনো আট মেডিকেল কলেজসহ সারাদেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৪০ জন। এর মধ্যে ঢাকা ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ছয়জন করে; চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও রংপুর মেডিকেল কলেজে চারজন করে এবং রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালে একজন করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন।
সরকার কেন উদাসীন: এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাধীনতার আগে থেকেই ডায়াবেটিক সমিতি আক্রান্তদের চিকিৎসা ও সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সাবেক একজন চিকিৎসক জানান, স্বাধীনতার পর ডায়াবেটিস আক্রান্ত একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর মাধ্যমে ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম রাজধানীর শাহবাগে সমিতির জন্য একখণ্ড জমি বরাদ্দ পান। ১৯৮০ সালে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বারডেম হাসপাতাল। এর পর থেকেই সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় ডায়াবেটিক সমিতির মাধ্যমে বারডেমে রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত হয়ে আসছে। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। অন্যদিকে, সরকার এ রোগের ভয়াবহতা বুঝতে পারেনি। অন্যান্য রোগের চিকিৎসার জন্য সরকার যতটা পদক্ষেপ নিয়েছে, ডায়াবেটিসের বিষয়ে তা নেয়নি।
বিএসএমএমইউর এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ডায়াবেটিসের কোনো রোগী অন্য সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত তার চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয় না। সরকারি পর্যায়ে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা অপ্রতুলতার কারণে রোগীকে তখন বারডেমে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ কারণে ডায়াবেটিস-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রোগীও বারডেমে ভিড় করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ডসহ অন্যান্য হাসপাতালে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ থাকলেও প্রচারের অভাবে রোগীরা সেখানে চিকিৎসা নিতে যান না।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের প্রধান ডা. রুহুল আমিন বলেন, ডায়াবেটিসের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল না থাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও কাজ করতে পারছেন না। অন্যান্য রোগের মতো ডায়াবেটিসের বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার মানুষের রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আবদুল জলিল আনসারী বলেন, সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে সীমিত পরিসরে ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা চলছে। তবে প্রচারের অভাবে মানুষ এ সেবা সম্পর্কে অবহিত নয়। মানুষকে জানানোর পাশাপাশি ডায়াবেটিস রোগের সেবা সরকারিভাবে সম্প্রসারণ করা উচিত বলে মত দেন তিনি।