রাজধানীতে জুলাই-আগস্ট মাসে চলা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনী সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। আন্দোলনের শুরু থেকেই গুলি চালানোর নির্দেশ মিলেছে প্রশাসনের উচ্চপর্যায় থেকে। সরকারি নথিপত্র বলছে, শুধু ঢাকার কয়েকটি এলাকায়ই ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশে ছোড়া হয়েছে অন্তত ১ হাজার ২৪০ রাউন্ড ৭.৬২ ক্যালিবার চাইনিজ রাইফেলের গুলি।
ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয় থেকে ট্রাইব্যুনালে পাঠানো একটি গোপন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে— ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকায় প্রায় ৯৫ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করেন। তাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশে বিজিবি, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালান।
বিশেষ করে রামপুরা, যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুর এলাকায় ৭ জন ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে ছোড়া হয়েছে প্রাণঘাতী রাইফেলের শতশত গুলি। এসব গুলি ছোড়েন বিজিবি ও আনসারের সদস্যরা। সরকারি এই নথি অনুযায়ী, গুলি চালানোর নির্দেশ ছিল ‘এইম অন ফায়ার’, অর্থাৎ লক্ষ করে গুলি করা। এর ফলে, বহু শিক্ষার্থী প্রাণ হারান বা স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যান। অনেকে এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, কেউ কেউ উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছেন।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৪ জুলাই থেকে বিভিন্ন এলাকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা আন্দোলন দমনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এ সময় রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, শাহবাগ, কাওরান বাজারসহ ঢাকার অন্তত ৮টি এলাকায় ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়। ম্যাজিস্ট্রেটদের কেউ কেউ এসএমজি ও চায়না রাইফেলের মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন।
১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে রামপুরার আফতাবনগর ও বিটিভি ভবন এলাকায়। সরকারি নথি বলছে—এই সময় শুধু রামপুরায় এক ডেপুটি কালেক্টরের নির্দেশে আনসার ব্যাটালিয়নের এক কর্মকর্তা নিজ অস্ত্র থেকে ছোড়েন ৫৪ রাউন্ড গুলি। এছাড়া ওই দিন ও পরদিন বিজিবির বিভিন্ন সদস্য আরও শতাধিক রাউন্ড গুলি ছোড়েন।
১৯ জুলাই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ দিন। সকাল ৮টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত একজন সিনিয়র সহকারী কমিশনারের নেতৃত্বে চলে নির্বিচার গুলি। এদিন শুধু একজন নায়েকই ছোড়েন ৮৩ রাউন্ড গুলি। অন্যদের ছোড়া গুলির সংখ্যাও অনেক।
নথিতে ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর ও রামপুরায় দায়িত্বে থাকা ম্যাজিস্ট্রেটদের নামও উঠে এসেছে। তাদের নির্দেশে বিজিবি সদস্যরা চায়না রাইফেল ও এসএমজি দিয়ে ছোড়েন একাধিক রাউন্ড গুলি।
অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞ, পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মো. নাজমুল হুদা বলেন, ৭.৬২ ক্যালিবার চায়না রাইফেল অত্যন্ত প্রাণঘাতী অস্ত্র। সাধারণত এটি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, বেসামরিক মানুষের ওপর নয়। তিনি বলেন, এই অস্ত্রের গুলি মানুষের শরীরে লাগলে তা ছিঁড়ে দেয়, কখনও শরীরের ভেতর দিয়েই বেরিয়ে যায়।
একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা জানান, এই ধরনের গুলি ইটের দেয়াল, লোহার পাত এমনকি মাটির প্রাচীর ভেদ করে যেতে পারে। মানুষের শরীরের তুলনায় এগুলো খুবই দুর্বল। একটি গুলির ওজন প্রায় ১৬.৪ গ্রাম।
সরকারি তথ্য, ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ এবং গুলির পরিমাণ বিশ্লেষণ করে স্পষ্ট হয়—ছাত্র আন্দোলন দমন করতে বড় পরিসরে পরিকল্পিতভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। নিরাপত্তা বাহিনীর এমন ব্যবহার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের প্রশ্ন তোলে।






























