দুমাত আল জান্দাল সৌদি আরবের আল জৌফ প্রদেশের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত প্রাচীন নগরী। যার প্রাচীন নাম আদুমাতো। প্রাদেশিক রাজধানী সাকাকা থেকে এর দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার। হাজার বছর ধরে এখানে সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের উন্নয়ন সংঘটিত হয়েছে। যার স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেছে দেয়ালে দেয়ালে, শহরের প্রতিটি কোণে।
সৌদি প্রত্নতত্ত্ববিদ হুসাইন আল খালিফা বলেন, এক সময় এখানে বৃষ্টিপাত হতো। তখন এখানে নদী ও বন ছিল। এরপর এখানে উষ্ণতা বাড়তে থাকে এবং বৃষ্টির পরিমাণ কমে যায়। ফলে মানুষ নিকটবর্তী মানব বসতির দিকে সরে যায়। প্রাচীনকালে মানুষ উর্বর মাটি ও পানির সন্ধানে স্থান ত্যাগ করত। এই প্রক্রিয়া থেকে ধারণা করা যায়, দুমাত আল জান্দাল খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছরের প্রাচীন নগরীগুলোর একটি।
প্রাচীনকালে আরব অঞ্চলে একটি অভিন্ন বাণিজ্য পথ তৈরি হয়েছিল। যা আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চলকে একত্র করেছিল এবং পণ্য বিনিময়কে সহজ করেছিল। এই বাণিজ্য পথ ধরে যারা আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে আগমন করত তাদের জন্য দুমাত আল জান্দাল একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। স্থল বাণিজ্যের শুরুভাগে এটি আরব উপদ্বীপে এর বিশেষ গুরুত্ব ছিল। ব্যবসার সুবাধে এটি শক্তিশালী ও ধনী অঞ্চল ছিল। দুমাত আল জান্দালের লোকেরা বাণিজ্য কাফেলাগুলোকে নিরাপত্তা দিত এবং বিনিময়ে নির্ধারিত হারে পণ্য (অর্থ) গ্রহণ করত।
একাধিক রাজ্য ও সাম্রাজ্য দুমাত আল জান্দালের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের চেষ্টা করেছিল। যাদের মধ্যে অ্যাসিরিয়ানরা সবচেয়ে এগিয়ে। তারা বেশ কয়েক বার নগরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের চেষ্টা করে। তাদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় উদীয়মান আরব রাজশক্তি কেদারীয়রা, যারা ফিলিস্তিন পর্যন্ত তাদের রাজত্বকে বিস্তৃত করেছিল। অবশ্য অ্যাসিরিয়ানরা আদুমাতো দখল করেছিল। অ্যাসিরিয়ানরা মাটির ফলকে তথ্য সংরক্ষণে দক্ষ ছিল। দুমাত আল জান্দালের মাটির ফলকের কিছু নমুনা এখনো পাওয়া যায়। যাতে আরব জাতি, এই নগরীর জনসাধারণ, এর শাসক ও রানির বর্ণনা পাওয়া গেছে। পাশাপাশি ইয়াবু নামক একজন বিদ্রোহীর বিবরণও আছে। মাটির ফলকে বসন্তকালীন জনপ্রিয় উত্সব সাউকের বর্ণনাও আছে।
খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দী এবং খ্রিস্টপূর্ব ৮৪৫ অব্দের নব্য অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের শিলালিপিতে এই শহরের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে শহরের নাম আদুম্মাতো বলা হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক উেস শহরটিকে কেদার রাজ্যের রাজধানী বলা হয়েছে। পাঁচজন শক্তিশালী আরব রানি কেদার রাজ্য শাসন করেছিলেন। তাদের মধ্যে চার জন হলেন জাবিবি, শামসি, তাবুয়া ও তিলহুনু। পরবর্তীতে শহরটি নাবাতীয়, রোমান, বাইজেন্টাইন ও সাসানীয়দের শাসনাধীন হয়। বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় আমলে শহরের প্রভাব-প্রতিপত্তি আরো বেড়ে যায়। এটা বড় বাণিজ্য কেন্দ্রে রূপ নেয়। আরব ধনীরা এখানে অবকাশ যাপনের জন্য আসত। তবে সে দুমাত আল জান্দালে সময় পতিতাবৃত্তি ও দাস ব্যবসার প্রসার ঘটেছিল।
মদিনা থেকে দুমাত আল জান্দালের দূরত্ব ১৫ দিনের। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে কমপক্ষে তিনবার মুসলিম বাহিনীকে দুমাত আল জান্দালে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। প্রথমবার অভিযান চালানো হয় সেসব লোককে দমন করতে যারা মদিনার বাণিজ্য পথে লুটতরাজ করত। লুটেরা বাহিনী মদিনায় আক্রমণের জন্য সংঘবদ্ধ হচ্ছে বলেও মহানবী (সা.) সংবাদ পেয়েছিলেন। এরপর বনু কালবের দেবতা ‘ওয়াদ’-এর মূর্তি ধ্বংস করতে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-কে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় প্রাচীন নগরী দুমাত আল জান্দাল মুসলমানের শাসনাধীন হয়। নবীজি (সা.)-এর নির্দেশে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-এর নেতৃত্বে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বাহিনী তা জয় করে।