|| কর্নেল মো. ইলিয়াস হোসেন ||
আঠারো কোটি মানুষের এই দেশে আজ আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত। আর এই নির্যাতনের বেশির ভাগ শিকার হচ্ছে আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষ, যাদের বেঁচে থাকার জন্য নিত্যদিনই লড়াই করতে হচ্ছে। শুধু কোনোরকমে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সংগ্রামরত এই স্বল্প আয়ের মানুষগুলো আজ বড়ই অসহায়।
একদিকে জীবন ধারণের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অন্যদিকে গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির সংকট তাদের জীবনকে করে তুলছে অতিষ্ঠ। যদিও বিশ্বায়নের এই যুগে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তার পরও ফ্যাসিবাদী পতিত সরকার-পরবর্তী নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই স্বল্প সময়ের মধ্যেও বাজার নিয়ন্ত্রণে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু তাতে কার্যকর কোনো উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয় না। কেননা বাজারে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বরং তা সমানতালে আরও এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। এই লাগামহীন বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের আয় আনুপাতিক হারে বাড়েনি। তাই সাধারণ মানুষ আজ দিশাহারা। এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির সংকট। এ অবস্থায় মানুষ তাদের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জীবন ধারণের ব্যয় নির্বাহ করতে পারছে না। ফলে বাড়ছে অপরাধ, ছিনতাই, ডাকাতি এবং চাঁদাবাজির মতো ঘটনা। আর যারা সভ্যগোছের, তারা কেবল জীবনব্যয়কে সংকুচিত করে শুধু কোনোরকমের বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদানের অধিকাংশই তাদের ক্ষেত্রে অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো স্বাস্থ্য। সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করছে কিন্তু সে অনুপাতে পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছে না। যার ফলে তারা অপুষ্টিতে ভুগছেন। এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে ভেজালযুক্ত খাবার। যার কারণে এসব মানুষ ভুগছেন নানাবিধ অসুখ-বিসুখে। আর রোগ-ব্যাধি কোনো ধনী-গরিব হিসাব করে আসে না। তাই চিকিৎসার জন্য সব মানুষকেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়।
আগেকার সময়ে অসুখ-বিসুখ অনেক কম ছিল। সেই সঙ্গে ডাক্তারের সংখ্যাও কম ছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে রোগ-ব্যাধি যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি ডাক্তার এবং চিকিৎসারও অনেক প্রসার ঘটেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এতে গরিব লোকের কোনো উপকার হয়নি। একে তো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই কষ্টকর, তার ওপর আবার চিকিৎসাব্যয়, যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া। তার পরও অসুখ হলে তো ডাক্তার দেখাতেই হয়। তবে আজকাল ডাক্তাররা তো আর শুধু ডাক্তারি পেশা নিয়েই ব্যস্ত নন। তারা বিভিন্ন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার আর প্রাইভেট হাসপাতাল খুলে রমরমা ব্যবসায় নিয়োজিত। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছে লাইন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আজকে নাম লেখালে হয়তো আগামী ৬ মাস পরে সিরিয়াল মিলবে। এমনও হতে পারে, রোগী মারা যাওয়ার পরে তার নাম ডাকা হবে। তাছাড়া তাদের ভিজিটও (প্রথম দর্শন) মাশআল্লাহ কম নয়, ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এটা তো গেল কেবল ভিজিট (প্রথম দর্শন), এর পর আছে বিভিন্ন রকম টেস্ট, যার খরচ আলাদাভাবে দিতে হয়। অতঃপর ওষুধ ক্রয় করতে হয়, যার মূল্য অসুখের ওপর নির্ভরশীল। তা হলে ভাবুন একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে একজন রোগীকে দেখাতে হলে কী পরিমাণ আর্থিক সঙ্গতির প্রয়োজন হয়? এমন অবস্থায় খেটে খাওয়া মানুষগুলোর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর বিষয়টি আজ তাই এক অলীক স্বপ্নমাত্র।
আমি একটি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। যদিও ঘটনাটা ২০০৬-০৭ এর দিকে হবে। আমার ছয় বছরের ছেলে প্রতিদিন মধ্যরাতে কাশতে কাশতে বমি করে ফেলত। ডাক্তারের কাছে গেলে সাধারণ কাশির ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দিত কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। অতঃপর রাজধানীর অভিজাত এলাকায় অবস্থিত একটি বিশেষায়িত হাসপাতালের একজন শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের (সঙ্গত কারণে নামটা উল্লেখ করলাম না) শরণাপন্ন হলে তিনি টন্সিল বড় হয়ে গেছে বলে অপারেশন করতে বলে তার পরিচিত এবং বন্ধু সমতুল্য একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞকে দেখাতে বলেন। আমরা তার কাছে গেলে তিনি বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ছেলের কণ্ঠের এডিনয়েড বড় হয়েছে বলে মত দেন এবং দ্রুত অপারেশন করতে বলেন। তিনি আমাদের ১৫ দিনের সময় দিলেন এবং বললেন ২৫০০০ থেকে ৩০০০০ টাকা লাগবে। আমরা বিষয়টিতে ভয় পেয়ে গেলাম, ছোট ছেলে, অজ্ঞান করে অপারেশন করতে হবে। তাই ওই ১৫ দিনের মধ্যেই ইএনটি’র (ঊঘঞ) অন্য বিখ্যাত সব ডাক্তারকে খুঁজতে শুরু করলাম। ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি সরকারি হাসপাতালের দুই প্রধান বিশেষজ্ঞের মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠ, তাকে দেখাব বলে তার চেম্বারে দুদিন চেষ্টা করে সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হলাম। তখন তার প্রাথমিক ভিজিট ছিল ৮০০ টাকা, যার বিনিময়ে তিনি শুধু টর্চ দিয়ে নাকের ভেতরটা বড়জোর ১০-১৫ সেকেন্ড দেখলেন। তার পর তিনি পুরনো কোনো টেস্ট না দেখে নতুন কয়েকটি টেস্ট করে পুনরায় তার কাছে আসতে বললেন এবং জানালেন ওষুধ নেওয়ার সময় আরও ৫০০ টাকা দিতে হবে। এ সময়ে আমার এক ছোট ভাই পিজি হাসপাতালেই ইন্টার্ন করছিল, তার সঙ্গে দেখা হয়। বিষয়টি তাকে জানালে সে তার সুপারভাইজারকে (একজন সহযোগী অধ্যাপক) দেখানোর জন্য অনুরোধ করে। আমি যথারীতি ছেলেকে নিয়ে পিজি হাসপাতালে তার কাছে যাই। তিনি ২০-২৫ মিনিট আমার ছেলেকে দেখলেন, গল্প করলেন, এমনকি আমার ছেলেকে চকোলেটও দিলেন। তার পর একখণ্ড কাগজে দুইটা ওষুধের নাম লিখে দিয়ে বললেন, ২১ দিন পরে দেখা করতে। কোনোরকম টেস্ট নেই, এক্স-রে নেই। ওষুধের দাম মাত্র ২৫ টাকা। আমি এতে অবাক এবং তার প্রতি কিছুটা আস্থার সংকটও হলো। কিন্তু অপারেশনের ভয়ে আমি ওই ওষুধ খাওয়ালাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার ছেলের কাশিসহ বমি বন্ধ হয়ে গেল। আজ পর্যন্ত ছেলের টন্সিল বা এডিনয়েড কোনোটারই অপারেশন করা হয়নি কিন্তু সে সুস্থ-সবল আছে।
চিকিৎসা নিয়ে এ রকম অসংখ্য ঘটনা আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়তই ঘটছে। কিন্তু আমরা কেউ কিছু করতে পারছি না, সবাই যেন তাদের কাছে এক ধরনের জিম্মি হয়ে আছি। স্বল্প আয়ের ওই দরিদ্র মানুষের জন্য আমাদের কি কিছুই করার নেই। দরিদ্র হয়ে জন্ম নেওয়াই কি সেবাবঞ্চিত ওই মানুষগুলোর অপরাধ? আসলে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের জন্য কোনো আইন নেই। কিংবা আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। চিকিৎসকরা যে যার মতো করে নিজেদের ভিজিট নির্ধারণ করছেন যা সর্বনিম্ন ১০০০ থেকে ২০০০ টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও বেসরকারি ক্লিনিকের প্রতি তাদের আসক্তি জনমানুষকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করছে। এভাবে প্রায় প্রতিটি চিকিৎসকই পর্যায়ক্রমে হয়ে উঠছে স্বেচ্ছাচারী। তাছাড়া মাশরুমের মতো গজিয়ে ওঠা অসংখ্য ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চলছে অবৈধ ব্যবসা এবং সীমাহীন অনিয়ম। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণ বা তদারক করার কেউ নেই। দেশে ভেজালবিরোধী আন্দোলন হচ্ছে, মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাদের ধরা এবং অর্থদণ্ড প্রদান করা হচ্ছে। দেশের চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রেও এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এজন্য চাই সংশ্লিষ্ট সব মহলের সদিচ্ছা এবং সমন্বিত চেষ্টা। দেশে আইন আছে, আমলা আছে, মন্ত্রী আছে কিন্তু অভাব কেবল সমন্বয়ের। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গৃহীত অসংখ্য সংস্কারের সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায়ও ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন এবং তার জন্য এখনই উপযুক্ত সময়। আমরা আশা করব বর্তমান সরকার এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আরও প্রখর করবে এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনগণের চিকিৎসাসেবাকে তাদের সামর্থ্যরে মধ্যে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে।
কর্নেল মো. ইলিয়াস হোসেন : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট