মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে মুসলিমদের সবচেয়ে বিদ্বেষী ও শত্রু হিসেবে ইহুদি এবং মুশরিকদের কথা উল্লেখ করেছেন। বর্তমান দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষ ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন। অনেকে নাস্তিকও; কিন্তু তারা মুসলিম-বিদ্বেষী নয়। অল্পসংখ্যক মানুষ ইহুদি ও তাদের রাষ্ট্র ইসরাইল মুসলিমদের সবচেয়ে বড় শত্রুরাষ্ট্র। অন্য দিকে আমরা যদি মূর্তিপূজার কথা বলি, আনুষ্ঠানিকভাবে দুনিয়াতে একমাত্র রাষ্ট্র ভারত মূর্তিপূজা করে থাকে। যার কারণে দেশটিকে আমরা মুশরিক রাষ্ট্র হিসেবে বিচেনা করতে পারি। আমরা যদি কুরআনের বর্ণনার সাথে মিলিয়ে নিই তাহলে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় শত্রু দু’টি দেশের মধ্যে একটি ভারত, অন্যটি মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইল।
আমরা যদি এ ভূ-খণ্ডের হাজার বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাবো, ১২০০ শতাব্দীতে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি মাত্র ১৭ জন সৈন্য নিয়ে লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে মোগলরা কয়েক শ’ বছর গোটা ভারতবর্ষ শাসন করেছেন। তারা কোনো অমুসলিমকে জোর করে মুসলিম বানাননি। কিন্তু এলিট অর্থাৎ উঁচু বর্ণের হিন্দুদের সবসময় মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ ছিল, কারণ তাদের বিবেচনায় প্রথম দিকে বেশির ভাগ নিম্ন বর্ণের হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে যখন সিরাজউদদৌলার পতন হয় তখন সবচেয়ে উল্লসিত হয়েছিল উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা। ইংরেজদের তারা ভারতে স্বাগতম জানিয়েছিল। পরবর্তী পৌনে ২০০ বছর ধরে ইংরেজদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত ছিল মুসলিমরা। ১৯৪৭ সালে যখন এ উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল, তখন পাকিস্তানের প্রতি ইংরেজরা যথেষ্ট বৈরী আচরণ করেছিল। সেটি আমরা এ দু’টি দেশের ভৌগোলিক বিন্যাস লক্ষ করলে বুঝতে পারব। তারা পূর্ব পাকিস্তান, হায়দরাবাদ ও কাশ্মিরে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, যেটি ভারতবর্ষের অনুকূলে ছিল। ভারত যথারীতি কাশ্মির দখল করে, পরবর্তী সময়ে হায়দরাবাদও দখল করে নেয়। ১৯৪৭ সাল থেকে দিল্লির স্বপ্ন ছিল বাংলা দখলের। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালে প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। পরে সেটি সেক্যুলার আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়। যার নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন ইন্ডিয়ান প্রেসক্রিপশন মোতাবেক চলা শেখ মুজিবুর রহমান। তার পুরো রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তিনি সবসময় ভারতের স্বার্থরক্ষায় কাজ করেছেন।
এরপরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও ভারত বাংলাদেশকে একটি প্রদেশের চেয়ে বেশি মর্যাদা দিতে প্রস্তুত ছিল না; কিন্তু ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ ইন্ডিয়ান প্রভাব বলয়ের বাইরে আসতে সক্ষম হয়। এই হাতছাড়া হওয়া বাংলাদেশকে আবার অধীনে নিতে শেখ হাসিনাকে প্রশিক্ষণ দেয় ভারত। সেই সাথে ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়।
বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তার রাজনীতিতে আসার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়া। সেটি বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন যে, তার বাবার হত্যার পর বাংলার মানুষ উল্লাস করেছিল, সুতরাং তিনি বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চান। একই সাথে সেনাবাহিনীর প্রতি তার চরম বিদ্বেষ ছিল। বিষয়টি তার পিএস মতিউর রহমান রেন্টুর লেখা ‘আমার ফাঁসি চাই’ বইতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এরপর ২০০১ সালে যখন রৌমারীতে বিডিআর জওয়ানরা বীরের মতো যুদ্ধ করে পঞ্চাশের বেশি বিএসএফ সদস্যকে হত্যা করে, তখন থেকে পেছনের দরজা দিয়ে প্রতিশোধ নেয়ার চরম স্পৃহা জেগে ওঠে ইন্ডিয়ান হাই কমান্ডের। দিল্লি সুস্পষ্টভাবে প্রতিজ্ঞা করেছিল, এ হত্যার প্রতিশোধ নেবে। সে জন্য ৯ বছর অপেক্ষা করেছিল। দিল্লির তাঁবেদার আওয়ামী লীগ যখন ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয়লাভ করে তার মাত্র ৫০ দিনের মাথায় বিডিআরের ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তা হত্যার শিকার হন। এ ঘটনার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর প্রভাব বাড়ানোর প্রয়াস পায় ভারত। জেনারেল মইন ইউ আহমেদের মতো সেনাপ্রধানের কারণে সেটি আরো ত্বরান্বিত ও সহজ হয়েছিল। জেনারেল তারেক সিদ্দিকীর মতো দেশদ্রোহীকে দিয়ে পুরো সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ভারত।
আগস্ট ২০২৪-এ যখন শেখ হাসিনার পতন ঘটে তা ইন্ডিয়ার জন্য বড় অপমানজনক। কারণ দিল্লি নিজেদের তাঁবেদারকে কোনো অবস্থাতে ক্ষমতার বাইরে রাখতে চায়নি। সুতরাং সাম্প্রতিক সময়ে ইন্ডিয়া সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে।
উপরের এসব বক্তব্যের মাধ্যমে আমরা এটি বলতে চাইছি যে, ভারত ঐতিহাসিকভাবে সবসময় বাংলাদেশের শত্রুরাষ্ট্র। আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, দুনিয়াতে প্রায় ২০০টি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের একমাত্র শত্রুরাষ্ট্র ভারত। যদিও বর্তমানে মিয়ানমারের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালো নেই। নেইপিডোর সাথে একসময় না একসময় শত্রুতার অবসান হওয়া সম্ভব। বিভিন্ন স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী মিয়ানমারকে অস্থিতিশীল করেছে, জান্তা নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেÑ তার ফলে বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন সময় বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই মিয়ানমারকে আমরা বন্ধুরাষ্ট্রে পরিণত করতে পারি। কিন্তু আমাদের স্বার্থ সর্বোচ্চ পরিমাণে বিকিয়ে দিয়েও আমরা কখনো ভারতের কাছ থেকে বন্ধুত্ব আশা করতে পারি না। আমাদের সেনাকর্মকর্তাদের দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের স্বার্থে অবশ্যই ভারতকে শত্রুরাষ্ট্র এবং সম্ভাব্য আক্রমণকারী ধরে নিয়ে সব সমর পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে। প্রায় ৪০ বছর ধরে সেটি করা হয়েছিল। কিন্তু গত ১৫ বছর আমরা বিচ্যুত হয়েছি। আমরা আমাদের প্রকৃত শত্রু চিহ্নিত করতে বিগত পনের বছরে ভুল করেছি। আমরা আমাদের শত্রুকে বন্ধু হিসেবে কল্পনা করেছি, যেটি কখনো বাস্তবম্মত ছিল না। সুতরাং আসুন আমরা সবাই মিলে আমাদের শত্রুকে চিহ্নিত করি। তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রস্তুত থাকি। দিল্লির সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে চেষ্টা করি। শত্রু যত কূট চালে আমাদের আবদ্ধ করার অপচেষ্টা করুক না কেন, ঈমানদার হিসেবে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, আল্লাহই সবচেয়ে উত্তম পরিকল্পনাকারী এবং তিনি আমাদের অস্তিত্ব সুরক্ষায় যথেষ্ট।