শিরোনাম :
Logo বিএনপির বর্ধিত সভায় গৃহীত প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত Logo সেহরি-ইফতারের সময়সূচি নিয়ে বিভ্রান্তি, যা বলছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন Logo ঈদের পর জবির ভর্তি কার্যক্রম শুরু হবে: উপাচার্য Logo দেশের তরুণ প্রজন্ম একটি সুস্থ জাতি ও দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে: সেনাপ্রধান Logo রমজান উপলক্ষ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবের শুভেচ্ছা Logo এককাতারে সৌরজগতের ৭ গ্রহ, বিরল দৃশ্যটি দেখবেন যেভাবে Logo ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড : শফিকুল আলম Logo ছাত্রদের নতুন দলের সঙ্গে আমি যুক্ত নই : আসিফ মাহমুদ Logo জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন রিজভী-এ্যানি Logo রমজানে রাজধানীর ২৫ স্থানে সুলভমূল্যে মিলবে মাংস-ডিম-দুধ
শিক্ষা

নতুন বাংলাদেশে অধ্যাপকদের ভূমিকা

  • সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ১১:৩৪:৪৮ পূর্বাহ্ণ, শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • ৭১২ বার পড়া হয়েছে

|| খন্দকার আব্দুল্লাহ আল মামুন ||

সম্প্রতি প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বাংলাদেশের ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয় যোগ্য অধ্যাপক দিয়ে ভাইস-চ্যান্সেলরের (ভিসি) পদ পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে, যা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি গভীর সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুতর কাঠামোগত সমস্যার দিকে নির্দেশ করে, যা শুধু নেতৃত্বের অভাব নয়, বরং শিক্ষকদের (অধ্যাপকদের) সমাজ ও শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকার পরিবর্তনকে তুলে ধরে।

বিশ্বব্যাপী অধ্যাপকদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে অধ্যাপকরা তাদের প্রথাগত পাঠদানের দায়িত্ব ছাড়িয়ে গিয়ে এখন সমাজ ও শিল্পক্ষেত্রে গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবন চালাচ্ছেন, জটিল সমস্যার সমাধান করছেন এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনছেন। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে, অধ্যাপকদের ভূমিকা একইভাবে পরিবর্তিত হতে হবে। শুধু জ্ঞান বিতরণের পরিবর্তে, তাদের জ্ঞান সৃষ্টিতে, উদ্ভাবনে, সামাজিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পক্ষেত্রে পরিবর্তনে এবং জাতীয় উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অবদান রাখতে হবে।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে সেকেলে পাঠ্যক্রম শিক্ষাদানের পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য সমালোচিত হয়ে আসছে। অধ্যাপকরা প্রায়ই মুখস্থবিদ্যার ওপর বেশি জোর দেন এবং সৃজনশীল চিন্তা ও সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা উপেক্ষা করেন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং চাকরির বাজারে ব্যর্থ হয়। এ ছাড়া, অধ্যাপকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা ও প্রণোদনা দেওয়ার অভাব তাদের আন্তর্জাতিক মান এবং বর্তমান যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা ও গবেষণা থেকে পিছিয়ে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ অধ্যাপক চাকরির স্থায়িত্ব, পদোন্নতি এবং প্রশাসনিক দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দেন, যেজন্য তারা গবেষণা, উদ্ভাবন বা ব্যক্তিগত এবং পেশাগত অগ্রগতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। এ ছাড়া, শিক্ষাদানে নতুন বা বহুমাত্রিক পদ্ধতির গ্রহণে শিক্ষকদের প্রায়ই নিরুৎসাহিত করা হয়, যা সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত ও একাডেমিক স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে।

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা জবাবদিহির অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতার শিকার। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত কারণে প্রায়ই অধ্যাপকদের নতুন পাঠ্যক্রম ডিজাইন বা সংস্কার কার্যকর করার সুযোগকে সীমাবদ্ধ করে। গবেষণা সুযোগ সীমিত, কারণ আর্থিক সহায়তা খুবই কম এবং নতুন উদ্ভাবনী প্রকল্প বা ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া কলাবোরেশনের প্রতি অনাগ্রহী, যা একটি সৃজনশীল পরিবেশ তৈরির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়

বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি একমুখী, যেখানে শিক্ষকরা লেকচার দেন এবং শিক্ষার্থীরা নোট নেয়। এসব লেকচারে প্রায়ই সাম্প্রতিক গবেষণা, ইনোভেশন এবং ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, ফলে শিক্ষার্থীরা উদ্ভাবনী বা সৃজনশীলভাবে চিন্তা করার পরিবর্তে নোট সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অধ্যাপকদের পদোন্নতির মাপকাঠি হিসেবে শুধু একাডেমিক যোগ্যতাকে দেখা হয়, গবেষণা, উদ্ভাবন বা সামাজিক এবং শিল্পক্ষেত্রে তাদের অবদানকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন শিক্ষাবিদ তৈরি করে যারা নিজেদের অবস্থান বজায় রাখতে বেশি আগ্রহী। এর ফলে সমাজ, ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা এবং বাস্তব বিশ্বের সমস্যাগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন শিক্ষার্থী তৈরি হচ্ছে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অধ্যাপকরা শুধু একাডেমিক দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। তারা ইন্ডাস্ট্রি ও সরকারের সঙ্গে একত্রে কাজ করেন, সহযোগিতা করেন, নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং প্রায়ই প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ জরুরি সামাজিক ও শিল্প সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

উদাহরণস্বরূপ, কভিড-১৯ মহামারির সময় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা অত্যাধুনিক সুবিধা ও দক্ষতার ব্যবহার করে দ্রুত একটি ভ্যাকসিন তৈরি করেছিলেন। যুক্তরাজ্য সরকারের প্রাথমিক গবেষণা তহবিল এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে শিল্প সহযোগিতার মাধ্যমে উৎপাদন ও বিতরণের দ্রুত বাজারজাতকরণ সম্ভব হয়েছিল। এ উদাহরণটি প্রমাণ করে যে, সরকার-শিল্প-একাডেমিয়া একত্রে কাজ করে, জরুরি সমস্যার উদ্ভাবনী সমাধান এবং উদ্ভাবন চালনার ক্ষেত্রে অধ্যাপক ও গবেষকদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, যা বর্তমানে বাংলাদেশে অনুপস্থিত, যেখানে একাডেমিকরা ইন্ডাস্ট্রি এবং জননীতিতে খুবই সীমিত ভূমিকা পালন করেন।

অধ্যাপকদের ভূমিকা পুনর্নির্ধারণ: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য, অধ্যাপকদের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। একজন অধ্যাপক শুধু শিক্ষকই নন; তাকে হতে হবে জ্ঞান সৃষ্টিকারী, উদ্ভাবক ও পরিবর্তনের চালক।

জ্ঞান সৃষ্টিকারী: অধ্যাপকদের উচিত নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে গবেষণা, প্রকাশনা এবং বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সামগ্রিকভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা।

উদ্ভাবক: তাদের গবেষণা এমন উদ্ভাবনী কাজে রূপান্তর করবে, যা সমাজ, শিল্প ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হবে।

পরিবর্তনের পথিকৃৎ: তাদের উদ্ভাবনগুলোকে সমাজ এবং শিল্পে বাস্তব প্রভাব ফেলবে, যা জরুরি সমস্যাগুলোর সমাধান করে দেশের উন্নয়নে সহায়ক হবে।

একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি: একজন অধ্যাপকের যাত্রা কঠোর পরিশ্রম, প্রতিশ্রুতি এবং গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণার প্রতি অধ্যাবসায় ও নিবেদিততার সঙ্গে একটি সামগ্রিক পদ্ধতির সঙ্গে হওয়া উচিত। এ যাত্রায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে:

সমস্যা চিহ্নিত করা: সমাজ বা শিল্পের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা।

গভীরভাবে বোঝা: সমস্যার কারণ, প্রভাব ও বিবরণসহ গভীরভাবে বোঝা।

সমাধানে বিশ্বাস: চিহ্নিত সমস্যার সমাধানের নিজের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস রাখা।

কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ: গবেষণা, উদ্ভাবন ও কোলাবরেশনের মাধ্যমে যুগোপযোগী সমাধান খুঁজে বের করা।

এই যাত্রার ফল হবে নতুন জ্ঞান, উদ্ভাবন ও সামাজিক বা শিল্প পরিবর্তন। একজন অধ্যাপক যিনি সফলভাবে এ যাত্রা সম্পন্ন করেন, তিনি অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন এবং জাতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদাহরণ: ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন অধ্যাপকের পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী উদাহরণ। প্রথমে শিক্ষাবিদ হিসেবে কাজ করলেও তিনি দারিদ্র্যকে একটি বড় সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এটিকে সমাধান করার নিজের সক্ষমতায় বিশ্বাস রাখেন। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ প্রবর্তন করেন, যা গরিব, বিশেষ করে নারীদের ছোট ও জামানতবিহীন ঋণ প্রদান করত। এই উদ্ভাবন দারিদ্র্য দূরীকরণে বিপ্লব ঘটায় এবং প্রমাণ করে যে, আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে এমনকি সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মানুষও উন্নতি করতে পারে।

ড. ইউনূসের এ উদ্ভাবন দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবিলা করে একটি বৈশ্বিক বিপ্লবের সূচনা করে এবং তাকে পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে রূপান্তরিত করে। তার এ অধ্যাপক থেকে উদ্ভাবক, সামাজিক উদ্যোক্তা ও নেতা হয়ে ওঠার যাত্রা প্রমাণ করে যে, অধ্যাপকরা শ্রেণিকক্ষের বাইরে গিয়ে কীভাবে সমাজ ও বৈশ্বিক পরিবর্তনের পথিকৃৎ হতে পারেন।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে, যাতে তারা জ্ঞান সৃষ্টিকারী, উদ্ভাবক এবং সামাজিক পরিবর্তন সৃষ্টিকারী অধ্যাপক তৈরি করতে পারে। প্রধান পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে:  গবেষণা ও উদ্ভাবনে প্রণোদনা প্রদান: গবেষণা অবকাঠামোতে বিনিয়োগ ও প্রতিযোগিতামূলক তহবিল প্রদান।

সহযোগিতা বাড়ানো: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে শিল্প এবং সরকারের সঙ্গে বহুমাত্রিক সহযোগিতা উৎসাহিত করা। উদ্ভাবন ও ইনকিউবেশন কেন্দ্র স্থাপন: শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষার্থীদের সমাজ ও শিল্পের সমস্যার সমাধান তৈরি করতে উৎসর্গীকৃত স্থান তৈরি করা।

এ বিষয়গুলোতে জোর দিয়ে, বাংলাদেশ তার শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করতে পারে এবং এমন একটি একাডেমিক প্রজন্ম তৈরি করতে পারে, যারা জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখবে, বিদেশি প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞের ওপর নির্ভরতা কমাবে এবং বিশ্ব জ্ঞান অর্থনীতিতে দেশের অবস্থান উঁচু করবে।

বাংলাদেশের ভাইস চ্যান্সেলর পদে যোগ্য শিক্ষাবিদ দিয়ে পদ পূরণ করতে সমস্যাটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি সতর্কতা সংকেত। অধ্যাপকদের ভূমিকা পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এমন একটি শিক্ষাবিদ সমাজ গড়ে তুলতে পারে, যারা আরও উদ্ভাবনী, গতিশীল ও সামাজিকভাবে সচেতন।

অধ্যাপকদের হতে হবে জ্ঞান সৃষ্টিকারী, উদ্ভাবক এবং পরিবর্তনের পথিকৃৎ, যারা সক্রিয়ভাবে সমাজ ও শিল্পের সমস্যাগুলো সমাধানে অংশ নেবে। তাদের অঙ্গীকার, সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা এবং নিজের সক্ষমতায় বিশ্বাসের মাধ্যমে তারা দেশের ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে ও আগামী দিনের নেতৃত্বকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

 

লেখক: পরিচালক, আইআরআইআইসি ,ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

বিএনপির বর্ধিত সভায় গৃহীত প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত

শিক্ষা

নতুন বাংলাদেশে অধ্যাপকদের ভূমিকা

আপডেট সময় : ১১:৩৪:৪৮ পূর্বাহ্ণ, শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

|| খন্দকার আব্দুল্লাহ আল মামুন ||

সম্প্রতি প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বাংলাদেশের ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয় যোগ্য অধ্যাপক দিয়ে ভাইস-চ্যান্সেলরের (ভিসি) পদ পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে, যা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি গভীর সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুতর কাঠামোগত সমস্যার দিকে নির্দেশ করে, যা শুধু নেতৃত্বের অভাব নয়, বরং শিক্ষকদের (অধ্যাপকদের) সমাজ ও শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকার পরিবর্তনকে তুলে ধরে।

বিশ্বব্যাপী অধ্যাপকদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে অধ্যাপকরা তাদের প্রথাগত পাঠদানের দায়িত্ব ছাড়িয়ে গিয়ে এখন সমাজ ও শিল্পক্ষেত্রে গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবন চালাচ্ছেন, জটিল সমস্যার সমাধান করছেন এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনছেন। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে, অধ্যাপকদের ভূমিকা একইভাবে পরিবর্তিত হতে হবে। শুধু জ্ঞান বিতরণের পরিবর্তে, তাদের জ্ঞান সৃষ্টিতে, উদ্ভাবনে, সামাজিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পক্ষেত্রে পরিবর্তনে এবং জাতীয় উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অবদান রাখতে হবে।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে সেকেলে পাঠ্যক্রম শিক্ষাদানের পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য সমালোচিত হয়ে আসছে। অধ্যাপকরা প্রায়ই মুখস্থবিদ্যার ওপর বেশি জোর দেন এবং সৃজনশীল চিন্তা ও সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা উপেক্ষা করেন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং চাকরির বাজারে ব্যর্থ হয়। এ ছাড়া, অধ্যাপকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা ও প্রণোদনা দেওয়ার অভাব তাদের আন্তর্জাতিক মান এবং বর্তমান যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা ও গবেষণা থেকে পিছিয়ে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ অধ্যাপক চাকরির স্থায়িত্ব, পদোন্নতি এবং প্রশাসনিক দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দেন, যেজন্য তারা গবেষণা, উদ্ভাবন বা ব্যক্তিগত এবং পেশাগত অগ্রগতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। এ ছাড়া, শিক্ষাদানে নতুন বা বহুমাত্রিক পদ্ধতির গ্রহণে শিক্ষকদের প্রায়ই নিরুৎসাহিত করা হয়, যা সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত ও একাডেমিক স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে।

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা জবাবদিহির অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতার শিকার। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত কারণে প্রায়ই অধ্যাপকদের নতুন পাঠ্যক্রম ডিজাইন বা সংস্কার কার্যকর করার সুযোগকে সীমাবদ্ধ করে। গবেষণা সুযোগ সীমিত, কারণ আর্থিক সহায়তা খুবই কম এবং নতুন উদ্ভাবনী প্রকল্প বা ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া কলাবোরেশনের প্রতি অনাগ্রহী, যা একটি সৃজনশীল পরিবেশ তৈরির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়

বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি একমুখী, যেখানে শিক্ষকরা লেকচার দেন এবং শিক্ষার্থীরা নোট নেয়। এসব লেকচারে প্রায়ই সাম্প্রতিক গবেষণা, ইনোভেশন এবং ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, ফলে শিক্ষার্থীরা উদ্ভাবনী বা সৃজনশীলভাবে চিন্তা করার পরিবর্তে নোট সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অধ্যাপকদের পদোন্নতির মাপকাঠি হিসেবে শুধু একাডেমিক যোগ্যতাকে দেখা হয়, গবেষণা, উদ্ভাবন বা সামাজিক এবং শিল্পক্ষেত্রে তাদের অবদানকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমন শিক্ষাবিদ তৈরি করে যারা নিজেদের অবস্থান বজায় রাখতে বেশি আগ্রহী। এর ফলে সমাজ, ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা এবং বাস্তব বিশ্বের সমস্যাগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন শিক্ষার্থী তৈরি হচ্ছে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অধ্যাপকরা শুধু একাডেমিক দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। তারা ইন্ডাস্ট্রি ও সরকারের সঙ্গে একত্রে কাজ করেন, সহযোগিতা করেন, নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং প্রায়ই প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ জরুরি সামাজিক ও শিল্প সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

উদাহরণস্বরূপ, কভিড-১৯ মহামারির সময় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা অত্যাধুনিক সুবিধা ও দক্ষতার ব্যবহার করে দ্রুত একটি ভ্যাকসিন তৈরি করেছিলেন। যুক্তরাজ্য সরকারের প্রাথমিক গবেষণা তহবিল এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে শিল্প সহযোগিতার মাধ্যমে উৎপাদন ও বিতরণের দ্রুত বাজারজাতকরণ সম্ভব হয়েছিল। এ উদাহরণটি প্রমাণ করে যে, সরকার-শিল্প-একাডেমিয়া একত্রে কাজ করে, জরুরি সমস্যার উদ্ভাবনী সমাধান এবং উদ্ভাবন চালনার ক্ষেত্রে অধ্যাপক ও গবেষকদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, যা বর্তমানে বাংলাদেশে অনুপস্থিত, যেখানে একাডেমিকরা ইন্ডাস্ট্রি এবং জননীতিতে খুবই সীমিত ভূমিকা পালন করেন।

অধ্যাপকদের ভূমিকা পুনর্নির্ধারণ: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য, অধ্যাপকদের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। একজন অধ্যাপক শুধু শিক্ষকই নন; তাকে হতে হবে জ্ঞান সৃষ্টিকারী, উদ্ভাবক ও পরিবর্তনের চালক।

জ্ঞান সৃষ্টিকারী: অধ্যাপকদের উচিত নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে গবেষণা, প্রকাশনা এবং বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সামগ্রিকভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা।

উদ্ভাবক: তাদের গবেষণা এমন উদ্ভাবনী কাজে রূপান্তর করবে, যা সমাজ, শিল্প ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হবে।

পরিবর্তনের পথিকৃৎ: তাদের উদ্ভাবনগুলোকে সমাজ এবং শিল্পে বাস্তব প্রভাব ফেলবে, যা জরুরি সমস্যাগুলোর সমাধান করে দেশের উন্নয়নে সহায়ক হবে।

একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি: একজন অধ্যাপকের যাত্রা কঠোর পরিশ্রম, প্রতিশ্রুতি এবং গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণার প্রতি অধ্যাবসায় ও নিবেদিততার সঙ্গে একটি সামগ্রিক পদ্ধতির সঙ্গে হওয়া উচিত। এ যাত্রায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে:

সমস্যা চিহ্নিত করা: সমাজ বা শিল্পের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা।

গভীরভাবে বোঝা: সমস্যার কারণ, প্রভাব ও বিবরণসহ গভীরভাবে বোঝা।

সমাধানে বিশ্বাস: চিহ্নিত সমস্যার সমাধানের নিজের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস রাখা।

কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ: গবেষণা, উদ্ভাবন ও কোলাবরেশনের মাধ্যমে যুগোপযোগী সমাধান খুঁজে বের করা।

এই যাত্রার ফল হবে নতুন জ্ঞান, উদ্ভাবন ও সামাজিক বা শিল্প পরিবর্তন। একজন অধ্যাপক যিনি সফলভাবে এ যাত্রা সম্পন্ন করেন, তিনি অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন এবং জাতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদাহরণ: ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন অধ্যাপকের পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী উদাহরণ। প্রথমে শিক্ষাবিদ হিসেবে কাজ করলেও তিনি দারিদ্র্যকে একটি বড় সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এটিকে সমাধান করার নিজের সক্ষমতায় বিশ্বাস রাখেন। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ প্রবর্তন করেন, যা গরিব, বিশেষ করে নারীদের ছোট ও জামানতবিহীন ঋণ প্রদান করত। এই উদ্ভাবন দারিদ্র্য দূরীকরণে বিপ্লব ঘটায় এবং প্রমাণ করে যে, আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে এমনকি সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা মানুষও উন্নতি করতে পারে।

ড. ইউনূসের এ উদ্ভাবন দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবিলা করে একটি বৈশ্বিক বিপ্লবের সূচনা করে এবং তাকে পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে রূপান্তরিত করে। তার এ অধ্যাপক থেকে উদ্ভাবক, সামাজিক উদ্যোক্তা ও নেতা হয়ে ওঠার যাত্রা প্রমাণ করে যে, অধ্যাপকরা শ্রেণিকক্ষের বাইরে গিয়ে কীভাবে সমাজ ও বৈশ্বিক পরিবর্তনের পথিকৃৎ হতে পারেন।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে, যাতে তারা জ্ঞান সৃষ্টিকারী, উদ্ভাবক এবং সামাজিক পরিবর্তন সৃষ্টিকারী অধ্যাপক তৈরি করতে পারে। প্রধান পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে:  গবেষণা ও উদ্ভাবনে প্রণোদনা প্রদান: গবেষণা অবকাঠামোতে বিনিয়োগ ও প্রতিযোগিতামূলক তহবিল প্রদান।

সহযোগিতা বাড়ানো: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে শিল্প এবং সরকারের সঙ্গে বহুমাত্রিক সহযোগিতা উৎসাহিত করা। উদ্ভাবন ও ইনকিউবেশন কেন্দ্র স্থাপন: শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষার্থীদের সমাজ ও শিল্পের সমস্যার সমাধান তৈরি করতে উৎসর্গীকৃত স্থান তৈরি করা।

এ বিষয়গুলোতে জোর দিয়ে, বাংলাদেশ তার শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করতে পারে এবং এমন একটি একাডেমিক প্রজন্ম তৈরি করতে পারে, যারা জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখবে, বিদেশি প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞের ওপর নির্ভরতা কমাবে এবং বিশ্ব জ্ঞান অর্থনীতিতে দেশের অবস্থান উঁচু করবে।

বাংলাদেশের ভাইস চ্যান্সেলর পদে যোগ্য শিক্ষাবিদ দিয়ে পদ পূরণ করতে সমস্যাটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি সতর্কতা সংকেত। অধ্যাপকদের ভূমিকা পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ এমন একটি শিক্ষাবিদ সমাজ গড়ে তুলতে পারে, যারা আরও উদ্ভাবনী, গতিশীল ও সামাজিকভাবে সচেতন।

অধ্যাপকদের হতে হবে জ্ঞান সৃষ্টিকারী, উদ্ভাবক এবং পরিবর্তনের পথিকৃৎ, যারা সক্রিয়ভাবে সমাজ ও শিল্পের সমস্যাগুলো সমাধানে অংশ নেবে। তাদের অঙ্গীকার, সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা এবং নিজের সক্ষমতায় বিশ্বাসের মাধ্যমে তারা দেশের ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে ও আগামী দিনের নেতৃত্বকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

 

লেখক: পরিচালক, আইআরআইআইসি ,ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি