শিরোনাম :
Logo অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতার জন্য করণীয় Logo ইসলামী শ্রমিক আন্দোলন বাংলাদেশ চাঁদপুর জেলা শাখার শপথ অনুষ্ঠান Logo পাবিপ্রবি’র বার্ষিক ক্রীড়া ও শহীদ জাহিদ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত Logo তথ্য উপদেষ্টা হলেন মাহফুজ আলম Logo নতুন ছাত্র সংগঠনের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক জাবি শিক্ষার্থী তৌহিদ সিয়াম Logo কচুয়ার মালচোয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ Logo খুবির আন্তঃডিসিপ্লিন ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ইসিই Logo দাবি আদায়ে অনড় আহতরা, ঘোষণা না এলে অবস্থান চলবে Logo সুন্দরবনের হরিণ শিকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে Logo ছাত্রদের নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ, ঘোষণা ঘিরে বিক্ষোভ–হাতাহাতি
সরকার

অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতার জন্য করণীয়

  • সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৯:৩৩:৫৭ অপরাহ্ণ, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • ৭২১ বার পড়া হয়েছে

এ টি এম মোস্তফা কামাল, 

অফুরন্ত আশা নিয়ে জুলাই বিপ্লবের নায়ক- গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র সমন্বয়করা বাংলার গর্ব বিশ্বখ্যাত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বাংলার মসনদে আসীন করেছেন। তাকে সফল হতেই হবে। তার সামান্যতম ব্যর্থতা এ দেশের শিক্ষিত/জ্ঞানী-গুণী লোকজনের জন্য বড় ধরনের ইমেজ সংকট সৃষ্টি করতে পারে। ব্যর্থ রাজনীতিবিদরা তাদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য তখন জোর গলায় বলতে থাকবেন ‘কী করতে পেরেছেন নোবেলজয়ী, সেটা তো জাতি দেখতে পেয়েছে।’

সংস্কার কমিশনগুলোর উচিত ছিল নীরবে তাদের রিপোর্ট প্রস্তুত করে সরকারের কাছে জমা দেওয়া। কমিশনগুলোর কাছ থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর সেগুলো রিভিউ করে দেখার জন্য রিভিউ কমিটি গঠন করে দেওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। রিভিউ কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকার তার করণীয় নির্ধারণ করতে পারে।

যেসব কাজ অতীতের ফ্যাসিস্ট সরকারসহ কোনো সরকারই বাস্তবায়ন করেনি, সেগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে শুরু করে দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। সেরূপ কিছু কাজের নমুনা নিম্নরূপ-

১. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ : আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য সরকারের আরও কঠোর হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে।

২. চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ব্যবসা, দুর্নীতি নির্মূল অভিযান : ফ্যাসিস্ট সরকারের সুদীর্ঘ শাসনামলে এটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং সচিবালয় থেকে শুরু করে ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যন্ত প্রসারিত হয়। চাঁদাবাজির কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ। জনগণকে বাকরুদ্ধ অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হয়েছে/হচ্ছে। চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ব্যবসা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নেওয়া অত্যাবশ্যক। একটি জাতীয় পত্রিকার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি শহিদুল হকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে টেকনাফের মাদকসম্রাট আবদুর রহমান বদি সারাদেশে পরিকল্পিত উপায়ে মাদকের বিস্তৃতি ঘটিয়ে নির্বাচনের টাকা জুগিয়েছেন। প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থাও এর সঙ্গে জড়িত। এরূপ ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল দেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করা এবং অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া [সূত্র : একটি জাতীয় দৈনিক, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫]। কাজেই মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ব্যবসা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নেওয়া অত্যাবশ্যক।

সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী-ব্যাংক স্টেটমেন্ট সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গোপনীয়তার কোনো বিষয় থাকবে না। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত কোনো লেনদেন না থাকলে গোপনীয়তার প্রশ্ন আসবে কেন? ৫ কোটি টাকার বেশি লেনদেনবিশিষ্ট সব ব্যবসায়ীর সম্পদ বিবরণী এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা দিতে হবে। সরকারপ্রধানসহ সব মন্ত্রী/উপদেষ্টা এবং সংসদ সদস্যের সম্পদ-ব্যাংক হিসাব বিবরণী দুর্নীতি দমন কমিশনে দাখিল বাধ্যতামূলক করতে হবে।

বড় বড় এনজিওগুলোর মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক নিবিড় তদারকি এবং বুঝে নেওয়ার বিধান চালু করতে হবে। ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার ৫%-এ সীমিত করতে হবে। এক বছর পর কিস্তি পরিশোধ কার্যক্রম চালু করা যায়।

৩. ১৯৭২ সালে পরিবারপিছু জমির সর্বোচ্চ সিলিং নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০০ বিঘা। অতীতের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক কোনো সরকারই মাঠপর্যায়ে সেটা বাস্তবায়ন করেনি। এরপর ১৯৮৪ সালে এটা কমিয়ে আনা হলো ৬০ বিঘায়। এই ৬০ বিঘা সিলিংও মাঠপর্যায়ে আজ অবধি কার্যকর করা হয়নি। এটা অকার্যকর থাকার সুবাদে বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, কোম্পানি, গ্রুপ অব কোম্পানিসহ হাজার লাখ পরিবার সৃষ্টি হয়েছে, যাদের সম্পত্তির পরিমাণ হাজার হাজার একর। দুর্নীতি-চাঁদাবাজির টাকা বিনিয়োগ করার সর্বশ্রেষ্ঠ নিরাপদ খাত হচ্ছে জমি ক্রয় ও অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়। ভূমি মন্ত্রিত্ব অত্যন্ত লোভনীয় একটি পদ। সাবেক ভূমিমন্ত্রী তো যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে কয়েকশ অ্যাপার্টমেন্ট/বাড়ির মালিক। অতীতের নির্বাচিত সরকারগুলো যেহেতু ভূমির এই সিলিং বাস্তবায়ন করেনি, সেহেতু ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকার যে তা বাস্তবায়ন করবে সেরূপ সম্ভাবনাও অত্যন্ত ক্ষীণ। ভূমি মন্ত্রণালয় ডিজিটাল সার্ভে নিয়ে ব্যস্ত। ডিজিটাল সার্ভে দিয়ে তো ১০০/৬০ বিঘা সিলিং কার্যকর করা যাবে না। এ কাজ শুরু করার জন্য কি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজন রয়েছে? অন্তর্বর্তী সরকার কি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, বড় বড় ব্যবসায়ীÑ যাদের সম্পত্তির পরিমাণ হাজার হাজার একর, তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এবং তাদের সুরক্ষায় ১০০/৬০ বিঘা সিলিং মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে চাচ্ছে না?

৪. ভারতের আদলে সীমান্ত সড়ক নির্মাণের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়নকাজ শুরু করে দিতে হবে। ভারতের মতো মহাসড়ক না হলেও At least jeepable Road হওয়া বাঞ্ছনীয়। অতীতের নির্বাচিত সরকারগুলো এরূপ প্রকল্প গ্রহণ করার কথা চিন্তাই করেনি। এটা করা ছাড়া সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা, চোরাচালান বন্ধ করা যাবে না এবং বিজিবি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে সক্ষম হবে না।

৫. সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের প্রিমিয়ামের ৫০% বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর মাঝে প্রতি তিন মাস অন্তর বণ্টন করে দেওয়ার ফ্যাসিস্ট সরকার প্রবর্তিত আইন অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে বাতিল করা অত্যাবশ্যক। অকারণ অর্জন সংবিধান পরিপন্থী।

৬. লক্কড়ঝক্কড় মার্কা বাস, ট্রাক এবং অন্যন্য পরিবহন : ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়ক থেকে প্রত্যাহার করার একটি পরিকল্পনা ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলেই গ্রহণ করা হয়েছিল। পরিবহন ব্যবসায়ীদের চাপে তৎকালীন সরকার সেরূপ উদ্যোগ কার্যকর করা থেকে বিরত থাকে। বর্তমান সরকারের উচিত তা অবিলম্বে কার্যকর করা। ঢাকা শহরে ইউরোপ স্ট্যান্ডার্ডের ৫০০ এসি বাস চালুর ব্যবস্থা করে নগরবাসীকে যানজট থেকে মুক্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৭. পরাশক্তির মোড়লগিরি ঠেকানোর জন্য অর্থনৈতিক সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্র বন্ধক রেখে গৃহীত বৈদেশিক ঋণের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। লার্জ ট্যাক্সপেয়ারদের দেওয়া লাখ কোটি টাকার আয়কর অব্যাহতি শতভাগ নিষিদ্ধ করা আবশ্যক। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি ক্রয় আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। বৈদেশিক ঋণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যয় ৮ থেকে ১০ গুণ বেড়ে যায়। সেটা পরিহার করার জন্য এরূপ প্রকল্প প্রস্তাব থেকে গাড়ি ক্রয়, বিদেশ প্রশিক্ষণ, পরামর্শক নিয়োগ নিষিদ্ধ করা অত্যাবশ্যক। ভিয়েতনাম কাজটি অনেক আগেই করেছে। রাষ্ট্র বন্ধক রেখে গৃহীত ঋণের টাকায় ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা অত্যাবশ্যক।

৮. এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে নিজস্ব গ্যাসসম্পদ আবিষ্কার, উত্তোলন বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৯. শিক্ষাব্যবস্থাকে ইউরোপ স্ট্যান্ডার্ডে উন্নীত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। ৬ মাস সময়ের মধ্যে সেটা শেষ করতে হবে। ডাকসুসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা অত্যাবশ্যক।

১০. সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা শতভাগ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।

১১. পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে Hill Tracts regulation 1900-এর আলোকে পৃথক ভূমি আইন প্রণয়ন করা এবং Hill Tracts regulation 1900 Update করা অত্যাবশ্যক।

১২. ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনাকে ইউরোপ স্ট্যান্ডার্ডে উন্নীত করতে হবে। ঋণ প্রদান কার্যক্রমকে কঠোর নিয়মের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। এ কাজ করার জন্য এক মাস সময়ই যথেষ্ট।

রাষ্ট্রকে যদি এভাবে পরিচালনা করা যায় তাহলে সব রাজনৈতিক দল নিজস্ব দলীয় অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদকে জিন্দাবাদ দিতে থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কাল তখন ৫ বছর পর্যন্ত মেনে নিতেও কারও আপত্তি থাকবে না। সরকারকে একটি বিষয় বোঝার চেষ্টা করতে হবে। ফ্যাসিস্ট রেজিমের সুবিধাভোগীরা এবং ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারীরা এক সেকেন্ডের জন্যও বসে নেই। কাজেই কমিশনের রিপোর্টের কথা বলে সময়ক্ষেপণের কোনো সুযোগও অন্তর্বর্তী সরকারের নেই।

লেখক : এ টি এম মোস্তফা কামাল : অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

 

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতার জন্য করণীয়

সরকার

অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতার জন্য করণীয়

আপডেট সময় : ০৯:৩৩:৫৭ অপরাহ্ণ, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

এ টি এম মোস্তফা কামাল, 

অফুরন্ত আশা নিয়ে জুলাই বিপ্লবের নায়ক- গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র সমন্বয়করা বাংলার গর্ব বিশ্বখ্যাত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বাংলার মসনদে আসীন করেছেন। তাকে সফল হতেই হবে। তার সামান্যতম ব্যর্থতা এ দেশের শিক্ষিত/জ্ঞানী-গুণী লোকজনের জন্য বড় ধরনের ইমেজ সংকট সৃষ্টি করতে পারে। ব্যর্থ রাজনীতিবিদরা তাদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য তখন জোর গলায় বলতে থাকবেন ‘কী করতে পেরেছেন নোবেলজয়ী, সেটা তো জাতি দেখতে পেয়েছে।’

সংস্কার কমিশনগুলোর উচিত ছিল নীরবে তাদের রিপোর্ট প্রস্তুত করে সরকারের কাছে জমা দেওয়া। কমিশনগুলোর কাছ থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর সেগুলো রিভিউ করে দেখার জন্য রিভিউ কমিটি গঠন করে দেওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। রিভিউ কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকার তার করণীয় নির্ধারণ করতে পারে।

যেসব কাজ অতীতের ফ্যাসিস্ট সরকারসহ কোনো সরকারই বাস্তবায়ন করেনি, সেগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে শুরু করে দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। সেরূপ কিছু কাজের নমুনা নিম্নরূপ-

১. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ : আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য সরকারের আরও কঠোর হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে।

২. চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ব্যবসা, দুর্নীতি নির্মূল অভিযান : ফ্যাসিস্ট সরকারের সুদীর্ঘ শাসনামলে এটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং সচিবালয় থেকে শুরু করে ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যন্ত প্রসারিত হয়। চাঁদাবাজির কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ। জনগণকে বাকরুদ্ধ অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হয়েছে/হচ্ছে। চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ব্যবসা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নেওয়া অত্যাবশ্যক। একটি জাতীয় পত্রিকার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি শহিদুল হকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে টেকনাফের মাদকসম্রাট আবদুর রহমান বদি সারাদেশে পরিকল্পিত উপায়ে মাদকের বিস্তৃতি ঘটিয়ে নির্বাচনের টাকা জুগিয়েছেন। প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থাও এর সঙ্গে জড়িত। এরূপ ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল দেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করা এবং অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া [সূত্র : একটি জাতীয় দৈনিক, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫]। কাজেই মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ব্যবসা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নেওয়া অত্যাবশ্যক।

সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী-ব্যাংক স্টেটমেন্ট সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গোপনীয়তার কোনো বিষয় থাকবে না। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত কোনো লেনদেন না থাকলে গোপনীয়তার প্রশ্ন আসবে কেন? ৫ কোটি টাকার বেশি লেনদেনবিশিষ্ট সব ব্যবসায়ীর সম্পদ বিবরণী এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা দিতে হবে। সরকারপ্রধানসহ সব মন্ত্রী/উপদেষ্টা এবং সংসদ সদস্যের সম্পদ-ব্যাংক হিসাব বিবরণী দুর্নীতি দমন কমিশনে দাখিল বাধ্যতামূলক করতে হবে।

বড় বড় এনজিওগুলোর মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক নিবিড় তদারকি এবং বুঝে নেওয়ার বিধান চালু করতে হবে। ক্ষুদ্রঋণের সুদের হার ৫%-এ সীমিত করতে হবে। এক বছর পর কিস্তি পরিশোধ কার্যক্রম চালু করা যায়।

৩. ১৯৭২ সালে পরিবারপিছু জমির সর্বোচ্চ সিলিং নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০০ বিঘা। অতীতের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক কোনো সরকারই মাঠপর্যায়ে সেটা বাস্তবায়ন করেনি। এরপর ১৯৮৪ সালে এটা কমিয়ে আনা হলো ৬০ বিঘায়। এই ৬০ বিঘা সিলিংও মাঠপর্যায়ে আজ অবধি কার্যকর করা হয়নি। এটা অকার্যকর থাকার সুবাদে বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, কোম্পানি, গ্রুপ অব কোম্পানিসহ হাজার লাখ পরিবার সৃষ্টি হয়েছে, যাদের সম্পত্তির পরিমাণ হাজার হাজার একর। দুর্নীতি-চাঁদাবাজির টাকা বিনিয়োগ করার সর্বশ্রেষ্ঠ নিরাপদ খাত হচ্ছে জমি ক্রয় ও অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়। ভূমি মন্ত্রিত্ব অত্যন্ত লোভনীয় একটি পদ। সাবেক ভূমিমন্ত্রী তো যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে কয়েকশ অ্যাপার্টমেন্ট/বাড়ির মালিক। অতীতের নির্বাচিত সরকারগুলো যেহেতু ভূমির এই সিলিং বাস্তবায়ন করেনি, সেহেতু ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকার যে তা বাস্তবায়ন করবে সেরূপ সম্ভাবনাও অত্যন্ত ক্ষীণ। ভূমি মন্ত্রণালয় ডিজিটাল সার্ভে নিয়ে ব্যস্ত। ডিজিটাল সার্ভে দিয়ে তো ১০০/৬০ বিঘা সিলিং কার্যকর করা যাবে না। এ কাজ শুরু করার জন্য কি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজন রয়েছে? অন্তর্বর্তী সরকার কি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, বড় বড় ব্যবসায়ীÑ যাদের সম্পত্তির পরিমাণ হাজার হাজার একর, তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এবং তাদের সুরক্ষায় ১০০/৬০ বিঘা সিলিং মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে চাচ্ছে না?

৪. ভারতের আদলে সীমান্ত সড়ক নির্মাণের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়নকাজ শুরু করে দিতে হবে। ভারতের মতো মহাসড়ক না হলেও At least jeepable Road হওয়া বাঞ্ছনীয়। অতীতের নির্বাচিত সরকারগুলো এরূপ প্রকল্প গ্রহণ করার কথা চিন্তাই করেনি। এটা করা ছাড়া সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা, চোরাচালান বন্ধ করা যাবে না এবং বিজিবি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে সক্ষম হবে না।

৫. সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের প্রিমিয়ামের ৫০% বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর মাঝে প্রতি তিন মাস অন্তর বণ্টন করে দেওয়ার ফ্যাসিস্ট সরকার প্রবর্তিত আইন অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে বাতিল করা অত্যাবশ্যক। অকারণ অর্জন সংবিধান পরিপন্থী।

৬. লক্কড়ঝক্কড় মার্কা বাস, ট্রাক এবং অন্যন্য পরিবহন : ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়ক থেকে প্রত্যাহার করার একটি পরিকল্পনা ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলেই গ্রহণ করা হয়েছিল। পরিবহন ব্যবসায়ীদের চাপে তৎকালীন সরকার সেরূপ উদ্যোগ কার্যকর করা থেকে বিরত থাকে। বর্তমান সরকারের উচিত তা অবিলম্বে কার্যকর করা। ঢাকা শহরে ইউরোপ স্ট্যান্ডার্ডের ৫০০ এসি বাস চালুর ব্যবস্থা করে নগরবাসীকে যানজট থেকে মুক্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৭. পরাশক্তির মোড়লগিরি ঠেকানোর জন্য অর্থনৈতিক সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্র বন্ধক রেখে গৃহীত বৈদেশিক ঋণের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। লার্জ ট্যাক্সপেয়ারদের দেওয়া লাখ কোটি টাকার আয়কর অব্যাহতি শতভাগ নিষিদ্ধ করা আবশ্যক। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি ক্রয় আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। বৈদেশিক ঋণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যয় ৮ থেকে ১০ গুণ বেড়ে যায়। সেটা পরিহার করার জন্য এরূপ প্রকল্প প্রস্তাব থেকে গাড়ি ক্রয়, বিদেশ প্রশিক্ষণ, পরামর্শক নিয়োগ নিষিদ্ধ করা অত্যাবশ্যক। ভিয়েতনাম কাজটি অনেক আগেই করেছে। রাষ্ট্র বন্ধক রেখে গৃহীত ঋণের টাকায় ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা অত্যাবশ্যক।

৮. এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে নিজস্ব গ্যাসসম্পদ আবিষ্কার, উত্তোলন বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৯. শিক্ষাব্যবস্থাকে ইউরোপ স্ট্যান্ডার্ডে উন্নীত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। ৬ মাস সময়ের মধ্যে সেটা শেষ করতে হবে। ডাকসুসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা অত্যাবশ্যক।

১০. সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা শতভাগ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।

১১. পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে Hill Tracts regulation 1900-এর আলোকে পৃথক ভূমি আইন প্রণয়ন করা এবং Hill Tracts regulation 1900 Update করা অত্যাবশ্যক।

১২. ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনাকে ইউরোপ স্ট্যান্ডার্ডে উন্নীত করতে হবে। ঋণ প্রদান কার্যক্রমকে কঠোর নিয়মের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। এ কাজ করার জন্য এক মাস সময়ই যথেষ্ট।

রাষ্ট্রকে যদি এভাবে পরিচালনা করা যায় তাহলে সব রাজনৈতিক দল নিজস্ব দলীয় অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদকে জিন্দাবাদ দিতে থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কাল তখন ৫ বছর পর্যন্ত মেনে নিতেও কারও আপত্তি থাকবে না। সরকারকে একটি বিষয় বোঝার চেষ্টা করতে হবে। ফ্যাসিস্ট রেজিমের সুবিধাভোগীরা এবং ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারীরা এক সেকেন্ডের জন্যও বসে নেই। কাজেই কমিশনের রিপোর্টের কথা বলে সময়ক্ষেপণের কোনো সুযোগও অন্তর্বর্তী সরকারের নেই।

লেখক : এ টি এম মোস্তফা কামাল : অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব