লালমনিরহাটের একটা ছোট্ট গ্রামে বেড়ে ওঠা হলেও বড় স্বপ্ন দেখার সাহস ছিল তার। ধান, পাট কিংবা মাটির গন্ধ ছোটবেলা থেকেই মুগ্ধ করত তাকে। বড় হয়েও সেই মোহাচ্ছন্নতা কাটেনি। তাই ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন কৃষিকেই। নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন গাছ, ফুল, ফল লতা-পাতার সঙ্গে। বর্তমানে কৃষি খাতের এক উজ্জ্বল নাম উম্মে কুলসুম পপি।
শুরুটা যেভাবে
করোনা মহামারি চলাকালে প্রায় সব ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থবির ছিল। সেই স্থবির হয়ে যাওয়া সময়ে আমের মৌসুম চলছিল। রংপুরে অনেক হাঁড়িভাঙা আম হয়। পপি খেয়াল করলেন, করোনাকালে সেসব আম সারাদেশে ঠিকমতো পৌঁছাতে না পেরে, তা খুব নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করছিলেন আমচাষিরা। এতে কৃষকদের বেশ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছিল। তখন পপি এবং তার স্বামী সাগর মিলে অনলাইনে সেই জনপ্রিয় হাঁড়িভাঙা আম বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্তের পরই দ্রুত শুরু করে দেন তার কার্যক্রম। প্রথমে রংপুর ও ঢাকায় থাকা পরিচিত লোকদের কাছ থেকে আমের অর্ডার পেতে থাকেন। পরিচ্ছন্নভাবে সুন্দর প্যাকেজিং করে, কুরিয়ারের মাধ্যমে তা সরবরাহ করতে থাকেন তারা এবং সবার প্রশংসা কুড়ান।
নতুন স্বপ্ন
পরে তারা ‘প্রিমিয়াম ফ্রুটস’নামে একটি ফেসবুক পেজ খুলে আরো বিস্তৃত পরিসরে কাজে নেমে পড়েন। শুধু আম নয়, পুরো দেশে বিভিন্ন মৌসুমি ফল সরবরাহ শুরু করেন তারা। আর এসব ফল শুধু রংপুর থেকেই নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করে থাকেন। যেমন : রংপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং সাতক্ষীরা থেকে আম সংগ্রহ করেন। খাগড়াছড়ি থেকে পেঁপে, বান্দরবান থেকে বন্যকলা ইত্যাদি সংগ্রহ করে পৌঁছে দেন ভোক্তাদের কাছে।
গ্রাহকের আস্থা অর্জন
প্রথমদিকে কৃষকদের কাছ থেকে ফল পাকার কিছুদিন আগে ফল কেনার অগ্রিম ক্রয় চুক্তি করে ফল নিতেন। এখন প্রায় এক বছর আগে থেকেই আমবাগানসহ অন্যান্য ফলের বাগানিদের কাছ থেকে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে ফল সংগ্রহ করে থাকেন। এতে ভালো মানের এবং নিরাপদ ফল বাছাই করে নিতে পারেন।
শুরুর দিকে বিষমুক্ত আম উৎপাদন এবং সেসব আমের ভিডিও প্রিমিয়ার ফ্রুটসের পেজে আপলোড করতে থাকেন পপি। কৃষক এবং বাগান মালিকদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করাসহ তার সব কর্মযজ্ঞের ভিডিওর মাধ্যমে তিনি সহজেই গ্রাহকদের কাছে ভরসার জায়গা তৈরি করেন। তাদের এসব ভেজালমুক্ত সুস্বাদু ফল সবাই সাদরে গ্রহণ করতে থাকেন এবং রাতারাতি তাদের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।
কনটেন্ট ক্রিয়েটর
উম্মে কুলসুম পপি একই সঙ্গে উদ্যোক্তা এবং কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। ২০২২ সালে তিনি প্রথম যে ভিডিওটা তৈরি করেছিলেন, তা তিস্তা নদীর পাড়ে চরভূমিতে, কুমড়া চাষের ব্যাপারে কথা বলেছিলেন। প্রথম ভিডিও থেকেই কুড়িয়েছিলেন মানুষের প্রশংসা। সেই থেকে শুরু। এখন তার ফেসবুক প্রোফাইল ও পেজে তাকে নিয়মিত অনুসরণ করছেন ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ! এমনকি ইউটিউবে তার সাবস্ক্রাইবার ৪ লাখ ৫৯ হাজার। তার কৃষিবিষয়ক তথ্যনির্ভর কনটেন্টগুলো মানুষ খুব আগ্রহ নিয়ে দেখে থাকে।
অনুপ্রেরণা
অনেকের মতো পপিরও অনুপ্রেরণা ছিল শাইখ সিরাজ। তার কৃষিবিষয়ক তথ্যচিত্র দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছেন পপি। সেই সঙ্গে জন্মেছে কৃষির প্রতি ভালোবাসা।
প্রতিবন্ধকতা
যেকোনো কাজেই রয়েছে প্রতিবন্ধকতা। যখন দেশের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য ফলমূল সময়মতো সরবরাহ করা সম্ভব হয় না, তখন ওয়্যারহাউসেই অনেক ফলমূল নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া কিছু ভুয়া পেজ আছে তাদের নামে। মানুষ বিশ্বাস করে সেখানে অর্ডার দিয়ে প্রতারিত হয়। কেউ কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের সার্ভিস নিয়ে নেতিবাচক কথা বলে থাকেন। এত কিছুর পরেও পপির যাত্রা অব্যাহত রয়েছেÑএটাই আশার কথা।
একটি ঠিকানা
রংপুর শহরে নিজেদের অফিস থেকে প্রিমিয়াম ফ্রুটসের সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন পপি ও সাগর। তাদের এই প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ করছেন প্রায় ৩০ তরুণ। আর ভরপুর মৌসুমে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় কর্মীর সংখ্যা ১০০ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। রংপুরের অফিস ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও নওগাঁÑ এসব জেলায় তাদের হাব রয়েছে এবং ঢাকায় রয়েছে ওয়্যারহাউস।
অনাগত দিনের স্বপ্ন
ব্যক্তিগত প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন পপি। যেখানে অ্যাগ্রো ট্যুরিজমের সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে চান তিনি ও তার স্বামী। তাদের প্রজেক্টে সারা বছর পাওয়া যায় এমন ফলমূল থাকবে, শাকসবজি থাকবে, মানুষ সেখানে গিয়ে থাকতে পারবে, বাগান থেকে তাজা ফলমূল খেতে পারবে, পুকুরের ব্যবস্থা থাকবে মাছ ধরার জন্য, গরুও থাকবে, এমন আরো নানা পরিকল্পনা বা স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে চলেছেন তারা।
শেষ কথা
বর্তমান সময়ের ছেলেমেয়েরা কৃষি থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। এমনকি কৃষিকে তেমন একটা সম্মানজনক পেশা হিসেবেও দেখা হয় না। পপি চান, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও যেন কৃষিকে ভালোবাসে, কাছ থেকে কৃষিকে দেখার সুযোগ পায়।
তিন এও মনে করেন, আমাদের দেশে উদ্যেক্তাদের জন্য আরো অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে বেশ কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। যেমন: বিনা সুদে ঋণদানের ব্যবস্থা, সিন্ডিকেট দূর করা, পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় নতুন উদ্যেক্তাদের সহজে এন্ট্রি দেওয়া, কোনোপ্রকার বাধা ছাড়া সহজভাবে তাদেরকে কাজ করতে দেওয়া এসব খুব জরুরি।