ধর্মের আভিধানিক অর্থ ও প্রকৃতি

0
11
ধর্ম এমন এক অদৃশ্য বোধশক্তির নাম, যে শক্তি মানবীয় অন্তরে জাগ্রত হয়ে মানবাত্মাকে এক মহান স্রষ্টার সন্ধানে তাড়িত করে। সঙ্গে সঙ্গে এ শক্তি মানব অন্তরে এমন এক বিশ্বাসের জন্ম দেয় যা ব্যক্তিকে স্রষ্টার সঙ্গে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে। এরই ধারাবাহিকতায় যে শক্তি ও সুশৃঙ্খল পদ্ধতি, নৈতিক উন্নতি সাধন এবং পারস্পরিক সম্প্রতি ও সংহতি স্থাপন করে ব্যক্তির জীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তা-ই ধর্ম। (ড. আহমাদ মাহমুদ আল-বারবারী, আদ-দীন বাইনাল ফারদ ওয়াল মুজতামা (কায়রো : মাকতাবা মিসর, তা.বি.), পৃ. ৪৩)সংস্কৃত ভাষায় ‘ধৃ’র সঙ্গে ‘মন’ প্রত্যয় যোগে ধর্ম শব্দের উত্পত্তি হয়েছে। এ ধাতুগত অর্থ হলো, যা ধারণ করে তাই ধর্ম। অন্তর ও বাহির মিলে মানুষের জীবনের পূর্ণ সামঞ্জস্যের মধ্যে যা মানুষের জীবনকে ধরে রাখে এবং সামাজিক জীবনের বৃহত্তর ঐক্যের মধ্যে যা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে ধর্ম বলা হয়। (প্রমোদ বন্ধু সেন গুপ্ত, ধর্মদর্শন (কলিকাতা : ব্যানার্জী পাবলিশার্স, ১৯৮৯ খ্রি.) পৃ. ৮০)
বাংলা অভিধানে ধর্ম শব্দটি সত্কর্ম, নিয়মতান্ত্রিক আচার, রীতি-নীতি, ঈশ্বর, পরকাল এবং অলৌকিক বিশ্বাস ও উপাসনাপ্রণালীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়। (বাংলা একাডেমী, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (ঢাকা : বাংলা একাডেমী প্রেস, ২০০৮ খ্রি.) পৃ. ৬৩৯; আবুল হোসেন ভট্টাচার্য, দ্বিন ধর্ম রিলিজিয়ন (ঢাকা : ইসলাম প্রচার সমিতি, ১৯৮২ খ্রি.) পৃ. ৩৫)

সুতরাং ধর্ম হচ্ছে, এমন একটি চেতনাবোধের নাম, যা অলৌকিক কোনো সত্তার ওপর বিশ্বাসের ভিত্তিতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে উত্সাহিত করে এবং এর ভিত্তিতে একটি সম্প্রদায়কে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে। (এ. এইচ. এম মুস্তাফিজুর রহমান ও মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, সমাজ বিজ্ঞান পরিচিতি (ঢাকা : লেখাপড়া লাইব্রেরী, ২০০৩ খ্রি.), পৃ. ৩০২)
ধর্মের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Religion, যা Religere শব্দ থেকে নির্গত হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ হলো বিশ্বাস, অনুশীলন, অনুভূতি, প্রকৃতি, আচার, আচরণ প্রভৃতি। (Encyclopaedia of Religion and Ethics, Vol. x (New York: Morison and Gibb Limited, 1956 A.D.) p. 694)
নৃ-বিজ্ঞানীদের কাছে ধর্মের বেশি পরিচিত সংজ্ঞাটি হলো—Religion is a belief in spiritual being. ‘ধর্ম হলো আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করার নাম।’ (Comparative Religion (Newton Abbot: David and Charles, 1972), p. 9)

সমাজবিজ্ঞানী স্যার জেমস ফ্রেজার (Sir James Frazer ) ধর্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ক্রিয়ামূলক দিকটির ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর মতে ‘ধর্ম হলো মানুষ থেকে উচ্চতর যে সকল শক্তি প্রকৃতি এবং মানবজীবনের গতিপথকে পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত করে এবং তাদের তুষ্টতা বা প্রসন্নতা সাধন করে।’ (The Golden Bough (London: Macmillan and Co. Ltd., 1960), p. 50-51)
এ ছাড়া কার্ল মার্কস ধর্মের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নেতিবাচক শব্দাবলি ব্যবহার করেছেন। এমনকি তিনি ধর্মকে অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। (The Encyclopedia of Britannica, Vol. 13, p. 109)

সমাজতন্ত্রবাদীরা ধর্মকে কুসংস্কার বলে মনে করে। যেমন লেলিন ধর্ম ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ধর্মকে ‘জনগণের আফিম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ ছাড়া তিনি মনে করেন, ধর্ম হলো এক ধরনের আধ্যাত্মিক নিপীড়ন (Spiritual appression) কিন্তু ধর্মের স্বরূপ এরূপ নয়। ধর্ম মানুষকে সুশৃঙ্খল হতে শেখায়। বিশ্বনিয়ন্তার কাছে আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে মানুষ তাঁর অনুকম্পা প্রার্থনা করে থাকে। এতে করে মানবিক জীবন হয় সুসংহত। (আদ-দ্বিন বাইনাল ফারদ ওয়াল মুজতামা, পৃ. ৮৪)ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন রচিত তুলনামূলক ধর্ম অবলম্বনে