ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য আশির্বাদ হয়ে এসেছে মেট্রোরেল। উত্তরা টু মতিঝিল এমআরটি লাইন-৬ রেল ব্যবহারকারীরা এটা সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করে থাকেন। রাজধানীতে আরও কয়েকটি লাইন চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। পুরান ঢাকার বাসিন্দারা যাতে মেট্রোরেলের সুবিধা পান এ জন্য মেট্রোরেলের আগের কাঠামোতে কিছুটা পুনর্বিন্যাশ করার চিন্তা করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
নতুন প্রস্তাবনা অনুযায়ী, বর্তমানে অপারেশনে থাকা এমআরটি লাইন-৬ এর সঙ্গে নতুন একটি ব্রাঞ্চ লাইন (শাখা লাইন) বিজয় সরণীতে যুক্ত হতে পারে এমআরটি লাইন-২ এর সঙ্গে। যদিও আগের নকশায় এমআরটি লাইন-২ ও এমআরটি লাইন-৬ এর একটি সংযোগ রয়েছে কমলাপুর হাবে।
এদিকে, এমআরটি লাইন-৫ (সাউদার্ন) এর রুট রাজধানীর গাবতলী থেকে শ্যামলী, আসাদগেট, রাসেল স্কয়ার, কাওরানবাজার, হাতিরঝিল হয়ে দাশেরকান্দি পর্যন্ত নকশা করা আছে। অন্যদিকে, এমআরটি লাইন-২ এর রুট গাবতলী, মোহাম্মদপুর, জিগাতলা, সাইন্সল্যাব, নিউ মার্কেট, পলাশী, গুলিস্তান, কমলাপুর হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত নকশা করা আছে। এ নকশায় পুরান ঢাকাকে যুক্ত করতে একটি ব্রাঞ্চ লাইন (শাখা লাইন) গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রাখা হয়েছে। কিন্তু এমআরটি লাইন-৫ (সাউদার্ন) রুটের পরিবর্তে এখন এমআরটি লাইন-২ রুটকে আর্থিক বিবেচনায় বিকল্প হিসেবে ভাবছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই ভাবনা থেকে পরিকল্পনা কমিশন রুট পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব করেছে।
রুট পুনর্বিন্যাস নিয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেল ভারী বিনিয়োগের বিষয়। মেট্রোরেলের লাইনে প্রাধিকার দেওয়া বা লাইন থেকে একটি ব্রাঞ্চ লাইন বের করে অন্য জায়গায় সংযুক্ত করার বিষয়গুলো যেন যাত্রীচাহিদার ভিত্তিতে করা হয়। কারণ, শুধু মেট্রোরেল দিয়ে যাত্রীচাহিদা পূরণ করা খুবই কঠিন। শুধু মেট্রো দিয়ে হবে না, এটার সঙ্গে বাস সার্ভিসও থাকতে হবে। একটা মডেল থাকতে হবে, যেখানে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্টেশনের যে চাহিদা, সেটা নিয়ে একসঙ্গে চিন্তা করতে হবে। যদি বিক্ষিপ্তভাবে মেট্রোর যাত্রীর কথা চিন্তা করা হয়, তাহলে যে লক্ষ্যমাত্রা পাওয়ার কথা সেটা কিন্তু ব্যাহত হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, এমআরটি লাইন-৫ (সাউদার্ন) প্রকল্পটি পুরোপুরি বাতিল করা বা এ প্রকল্পের আংশিক বাস্তবায়ন করা হতে পারে। এ ছাড়া এমআরটি লাইন-২ পুরোপুরি নির্মাণের পাশাপাশি এর সঙ্গে এমআরটি লাইন-৬ কে দ্বিতীয়বার যুক্ত করতে নতুন আরেকটি ব্রাঞ্চ লাইন তৈরি করা যেতে পারে।
বিষয়টি নিয়ে এখনও মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কাছে মতামত জানতে চাওয়া হয়নি। ডিএমটিসিএল বলছে, এ বিষয়ে যদি তাদের কাছে মতামত চাওয়া হয়, তাহলে তারা পর্যালোচনা করে জানাবে।
পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল সূত্র গণমাধ্যমকে জানায়, এমআরটি লাইন-৫ (সাউদার্ন) রুটের এসব বিকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে পরিকল্পনা উপদেষ্টার নির্দেশে। পরিকল্পনা কমিশনের যাচাই-বাছাই শেষে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বর্তমানে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
এমআরটি লাইন-৫ (সাউদার্ন) এর শেষ প্রান্ত হচ্ছে রাজধানীর আফতাব নগরের পেছনের দাশেরকান্দি এলাকা। কিন্তু ওই এলাকায় এখনো বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়নি। ফলে অর্থনৈতিক বিবেচনায় এ রুটের পরিবর্তে এমআরটি লাইন-২ কে প্রাধান্য দিচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। কারণ, এমআরটি লাইন-২ গাবতলী থেকে ঢাকা উদ্যান, মোহাম্মদপুর, জিগাতলা, সায়েন্সল্যাব, নিউ মার্কেট, আজিমপুর, পলাশী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, গুলিস্তান, মতিঝিল, কমলাপুর, মান্ডা, দক্ষিণগাঁও, দামড়িপাড়া, সাইনবোর্ড, ভূইঘর, জালকুড়ি হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত যাবে। এ লাইনে গুলিস্তান থেকে একটি ব্রাঞ্চ লাইন যাবে সদরঘাটে। যে লাইন যুক্ত করবে গোলাপ শাহ মাজার ও নয়াবাজার এলাকাকে। এতে করে পুরান ঢাকার সঙ্গে গাবতলী, উত্তরা ও নারায়ণগঞ্জের যোগাযোগ হবে দ্রুতগামী, নিরাপদ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও সময়সাশ্রয়ী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একটি বিকল্প প্রস্তাবে এমআরটি লাইন-৫ (সাউদার্ন) এর অধীন গাবতলী থেকে কারওয়ান বাজার অংশ বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে এমআরটি লাইন-২ এর একটি ব্রাঞ্চ লাইন বিজয় সরণীতে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অন্য একটি প্রস্তাবে এমআরটি লাইন-৫ (সাউদার্ন) শুধু কারওয়ান বাজার থেকে দশেরকান্দি পর্যন্ত নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। আরও একটি বিকল্প প্রস্তাবে পুরো এমআরটি লাইন-৫ (সাউদার্ন) এর রুট প্রকল্পই আপাতত বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পরে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে প্রকল্পটি পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আব্দুর রউফ গণমাধ্যমকে বলেন, তারা (পরিকল্পনা কমিশন) আমাদের এ প্রজেক্টগুলো পর্যালোচনা করে পুনরায় যৌক্তিকীকরণসহ পাঠাতে বলেছে। ব্যয় ও লাইন, যৌক্তিকীকরণে কোনটা থাকবে, কোনটা যাবে, সে বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলেনি। এটার বিষয়ে মতামত চেয়েছে মিনিস্ট্রিতে (মন্ত্রণালয়ে)। আমাদের কাছে যদি চায়, তাহলে আমরা পর্যালোচনা করে মতামত দেব।
রুট পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব নিয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের মেট্রোরেল লাইনগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ আছে। এগুলো করতেই হবে। নতুন করে এ ভাবনা যেন বিজ্ঞানভিত্তিক হয় এবং যাত্রীর চাহিদার ভিত্তিতে হয়। এটা যেন সত্যিকার অর্থে সিটি মডেল প্ল্যানিং হয়। এ মডেলে যদি আমি বুঝেশুনে বিনিয়োগ করি, তাহলে অনেকটা ফিজিবিলিটির কাছাকাছি যাবে। আমরা যদি না বুঝে কাজটি করি, তাহলে ফিজিবিলিটি কিন্তু হোঁচট খেয়ে যাবে। অতীতে আমরা এ রকম ঘটনা অনেক দেখেছি। ’