নিউজ ডেস্ক:
সংগঠন, রাজনীতি ও আন্দোলন—বিদায়ী বছরে কোনোটাই উল্লেখ করার মতো ছিল না বিএনপির। এক বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি দলটি। হাতছাড়া করেছে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচিও। এখনো দুর্বল সংগঠন নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় বিএনপি। সর্বশেষ ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনেও তৃণমূল নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। ১৯ মার্চ কাউন্সিল করলেও এখনো দল অগোছালোই রয়ে গেছে। ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট চিঠি পাঠিয়ে এ পর্যন্ত ২২টির মতো জেলায় কমিটি দিতে পেরেছে। সাংগঠনিক জেলা ৭৫টি। যদিও ঘোষিত কমিটির বড় অংশই ছিল আংশিক কিংবা আহ্বায়ক নির্ভর। বছরজুড়ে রাজনীতির চালেও ভুল করেছে বিএনপি। কেন্দ্রীয় ‘ঢাউস’ কমিটি হলেও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চোখে পড়ার মতো ছিল না।
দেখা গেছে, এক বছরে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা ইস্যুতে কোনো জোরালো প্রতিবাদ করতে পারেনি বিএনপি। বিশেষ করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। বাম দলগুলো এর বিরুদ্ধে আন্দোলনও গড়ে তোলে। এ নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে শুধু বেগম খালেদা জিয়া একটি সংবাদ সম্মেলনই করেন। কোনো কর্মসূচিতে যায়নি দলটি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, সীমান্ত হত্যা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে আগুন, নারী-শিশু নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জঙ্গিবাদবিরোধী ঐক্যসহ অসংখ্য জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যু ছিল বিএনপির সামনে। এ নিয়ে কোনো জোরালো প্রতিবাদ করতে পারেনি দলটি। সংবাদ সম্মেলন আর গোলটেবিলেই সীমাবদ্ধ ছিল তারা।
দলীয় ইস্যুতেও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেনি বিএনপি। লুই আই কানের মূল নকশা বাস্তবায়নের কথা বলে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর সরানোর চিন্তা-ভাবনা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ লক্ষ্যে ১ ডিসেম্বর ঢাকায় আনা হয় মূল নকশা। বিভিন্ন বক্তব্যে এর প্রতিবাদ জানালেও দলীয়ভাবে কার্যত জোরালো কোনো প্রতিবাদ গড়তে পারেনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তবে শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা কিংবা গ্রেফতারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ডাকা হয়। সে কর্মসূচিগুলোও ছিল অনেকাংশে প্রেস রিলিজ নির্ভর।
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করে বিএনপি। কিন্তু ওই দিন কোনো কমিটি ঘোষণা হয়নি। এ নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরে নানা সমালোচনার সৃষ্টি হয়। ৯ দিন পর ঘোষণা দেওয়া হয় দলের মহাসচিবসহ তিনজনের নাম। সাড়ে চার মাসে ‘বিএনপির ইতিহাসে সবচেয়ে বড়’ পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা আসে। স্থায়ী কমিটি, উপদেষ্টা পরিষদসহ ৫৯২ জনের নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এত বড় কমিটি ঘোষণার পরও বাদ পড়ে যান বেশকিছু ত্যাগী নেতা। আবার পদবনতি হয় বেশ কয়েকজন। তাই কমিটি ঘোষণার দিনই দলীয় পদ ছাড়েন মোসাদ্দেক আলী ফালুসহ তিন নেতা। এ নিয়ে এখনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ রয়েছে। তবে বিএনপির গঠনতন্ত্রে থাকলেও আজও মন্ত্রণালয়ভিত্তিক উপ-কমিটি দিতে পারেনি। এ ছাড়া প্রকাশ করতে পারেনি দলীয় গঠনতন্ত্র।
জানা যায়, জেলা কমিটি গঠন করতে গিয়ে ঘাম ঝরছে বিএনপির। সরকার ও প্রশাসনের বাধা ছাড়াও দলীয় নেতাদের নানামুখী অপতত্পরতায় এক বছরেও নতুন কমিটি গঠনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই বিএনপির। এক বছরে মাত্র কমিটি হয়েছে ২২টির মতো। যদিও দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের টার্গেট দিয়েছিলেন ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলছে। ঠিকঠাক মতো চললে আগামী বছরের মাঝামাঝি ৭৫টি সাংগঠনিক জেলায় পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
চলতি বছরের মার্চে ভারতে ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর বৈঠক নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে বিএনপি। তীব্র সমালোচনার মধ্যে ১৫ মে ঢাকা থেকে আসলাম চৌধুরীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর সন্ত্রাস প্রতিরোধে ‘জাতীয় ঐক্যের’ ডাক দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। কিন্তু জোট শরিক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ না করায় সরকারি দল তাতে সাড়া দেয়নি। সরকারবিরোধী দলগুলোকে এ ঐক্যে আমন্ত্রণ জানান বিএনপিপ্রধান। খালেদা জিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী জামায়াত ছাড়ার শর্ত দেন। একই কারণে ২০-দলের বাইরের দলগুলোও বিএনপি নেত্রীর আহ্বানে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলে বেগম জিয়ার ওই আহ্বান আর ফলপ্রসূ হয়নি।
তবে বিদায়ী বছরে বেশকিছু কর্মকাণ্ডকে ইতিবাচকভাবে দেখছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তাদের মতে, সর্বশেষ নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের উদ্যোক্তা বিএনপি। ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রথম সংলাপে বসে বিএনপি। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই কাউন্সিলে বেগম জিয়ার ভিশন-২০৩০ নিয়ে দেওয়া বক্তৃতাও প্রশংসা পেয়েছে। নানা শঙ্কা সত্ত্বেও স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে গণতান্ত্রিক শক্তিকে সমুন্নত করতে পেরেছে। বছরজুড়েই এমন কোনো আন্দোলন করেনি, যা জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সফররত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও চীনের প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎও ইতিবাচক। বছরের শেষ দিকে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে খালেদা জিয়ার ১৩ দফা প্রস্তাবনাও রাজনীতিতে ইতিবাচক সাড়া পড়েছে।