আসছে পুরুষের জন্মনিরোধক পিল, কাজ করবে হরমোন পরিবর্তন ছাড়াই

  • নীলকন্ঠ অনলাইন নীলকন্ঠ অনলাইন
  • আপডেট সময় : ০৪:৫১:৪১ অপরাহ্ণ, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫
  • ৭১৬ বার পড়া হয়েছে
পুরুষদের জন্য নতুন এক জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা। এটিতে কোনো হরমোন নেই। আরও সহজ করে বললে, এই ওষুধ খাওয়ার পর পুরুষের হরমোনে সেই অর্থে কোনো পরিবর্তন আসবে না। এর নাম ওয়াইসিটি-৫২৯। ওষুধটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। বিজ্ঞান বিষয়ক সংবাদমাধ্যম সায়েন্স অ্যালার্টের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে এই ওষুধটি ইঁদুর ও বানরের ওপর পরীক্ষা করে খুব ভালো ফলাফল পেয়েছেন। ওষুধটি শুক্রাণু তৈরি হওয়া কমিয়ে দিলেও, শরীরের ওপর এর তেমন কোনো খারাপ প্রভাব দেখা যায়নি। নেচার কমিউনিকেশন জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধ অনুসারে, পুরুষ ইঁদুরদের এই ওষুধ দেওয়ার এক মাসের মধ্যে এটি কাজ শুরু করে। ওষুধ দেওয়ার পর সেগুলোর সঙ্গীদের গর্ভধারণের হার প্রায় ১০০ শতাংশ কমে যায়। পুরুষ বানরদের ক্ষেত্রে অবশ্য ওষুধের পরিমাণ বাড়াতে হয়েছে। তবে বানরের ক্ষেত্রেও শুক্রাণুর সংখ্যা দ্রুত কমে যায়, কোনো বড় সমস্যা ছাড়াই।

ভালো খবর হলো, ওষুধটি বন্ধ করার পর প্রাণীরা আবার বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা ফিরে পায়। এই ওষুধটি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের (টেস্টোস্টেরন, এফএসএইচ, ইনহিবিন-বি) মাত্রায় কোনো পরিবর্তন করে না। এই হরমোনগুলো শুক্রাণু তৈরির জন্য প্রয়োজনীয়।

মেয়েদের হরমোনভিত্তিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের কিছু খারাপ দিক আছে। যেমন—ওজন বেড়ে যাওয়া, মন খারাপ থাকা বা ব্যাড কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া। আগে এমন সমস্যার কারণে কিছু ভালো ওষুধের ব্যবহারও বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তাই বিজ্ঞানীরা এখন হরমোন ছাড়া অন্য পদ্ধতি খুঁজছেন। এই পদ্ধতিতে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

ওয়াইসিটি-৫২৯ এর প্রথম ধাপের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। যদিও এর চূড়ান্ত ফলাফল এখনো জানা যায়নি, তবে এটি সফল ছিল। তাই এখন দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এই ধাপে দেখা হবে ওষুধটি কতটা নিরাপদ এবং কার্যকর। নিউজিল্যান্ডে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই পরীক্ষা শুরু হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী গুন্ডা জর্জ বলেন, ‘পুরুষদের জন্য নিরাপদ ও ভালো পিল তৈরি হলে দম্পতিদের জন্য গর্ভনিরোধের আরও সুযোগ তৈরি হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনার দায়িত্ব সবাই মিলে নিতে পারবে এবং পুরুষরাও নিজেদের প্রজনন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।’

অধ্যাপক জর্জের ল্যাব বেশ কয়েক বছর আগে ওয়াইসিটি-৫২৯ নিয়ে গবেষণা শুরু করে। তাঁরা দেখেছেন এটি রেটিনোইক অ্যাসিড রিসেপ্টর (আরএআর) আলফা নামের একটি প্রোটিনের ওপর কাজ করে। এই রিসেপ্টরটি ভিটামিন-এ থেকে তৈরি হওয়া রেটিনোইক অ্যাসিডের সঙ্গে মিশে কোষের বৃদ্ধি, শুক্রাণু তৈরি এবং ভ্রূণের বিকাশে সাহায্য করে।

ওয়াইসিটি-৫২৯ আরএআর-আলফাকে বন্ধ করে দেয়। এটি শুধু এই একটি রিসেপ্টরকে লক্ষ্য করে, তাই খারাপ প্রভাব কম পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এই গবেষণায় অর্থায়ন করছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ। আর এই প্রকল্পে যৌথভাবে কাজ করছে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইওরচয়েস থেরাপিউটিকস নামের একটি ওষুধ কোম্পানি।

অধ্যাপক জর্জ ও তাঁর সঙ্গীরা কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, তারা ২০২২ সালের মধ্যে মানুষের ওপর পরীক্ষা শুরু করবেন। তবে বাস্তবে তা হয়নি। ঘোষণার তুলনায় গবেষণাটি ধীরে চলছে, তবে এটি সঠিক পথেই এগোচ্ছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট গবেষকদের।

ইওরচয়েস থেরাপিউটিকসের প্রধান বিজ্ঞানী নাদজা মানোভিটস বলেন, ‘প্রাণীদের ওপর করা গবেষণা মানুষের ওপর ওয়াইসিটি-৫২৯-এর পরীক্ষা শুরু করার জন্য ভিত্তি তৈরি করেছে এবং পরীক্ষা ভালোভাবে চলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে এবং সারা বিশ্বে প্রায় ৫০ শতাংশ গর্ভধারণ অপ্রত্যাশিতভাবে হয়ে থাকে। তাই আমাদের আরও গর্ভনিরোধক বিকল্প দরকার, বিশেষ করে পুরুষদের জন্য।’

ওয়াইসিটি-৫২৯ ছাড়াও আরও একটি হরমোনবিহীন পুরুষদের জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ নিয়ে গবেষণা চলছে। ২০২৪ সালে বেইলর কলেজ অব মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা সিডিডি-২৮০৭ নামের একটি ওষুধ ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করেন। এটি ইনজেকশন দেওয়ার পর পুরুষ ইঁদুরদের বাচ্চা হওয়া বন্ধ করে দেয়। তবে এটি এখনো মানুষের ওপর পরীক্ষা করা হয়নি।

পুরুষদের জন্য শেষবার কোনো নতুন গর্ভনিরোধক বাজারে এসেছিল ১৯৮০-এর দশকে। তখন বিজ্ঞানীরা ছোট একটি অপারেশনের মাধ্যমে ভ্যাসেকটমি করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। ২০২৩ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ পুরুষই নতুন গর্ভনিরোধক ব্যবহার করতে রাজি। মানোভিটস বলেন, নারীরা অনেক দিন ধরে গর্ভধারণ প্রতিরোধের দায়িত্ব একা বহন করছেন।

তিনি আরও বলেন, ‘তথ্য অনুযায়ী পুরুষরাও সাহায্য করতে চান এবং তাঁরা নতুন গর্ভনিরোধক ব্যবহার করতে ইচ্ছুক। নারীরাও তাদের ওপর ভরসা করেন। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে পুরুষদের গর্ভনিরোধক উদ্ভাবনে কোনো নতুনত্ব আসেনি। তাই এখন পরিবর্তনের সময় এসেছে এবং আমরা এই পরিবর্তনে অংশ নিতে পেরে খুশি।’

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

আসছে পুরুষের জন্মনিরোধক পিল, কাজ করবে হরমোন পরিবর্তন ছাড়াই

আপডেট সময় : ০৪:৫১:৪১ অপরাহ্ণ, রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫
পুরুষদের জন্য নতুন এক জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা। এটিতে কোনো হরমোন নেই। আরও সহজ করে বললে, এই ওষুধ খাওয়ার পর পুরুষের হরমোনে সেই অর্থে কোনো পরিবর্তন আসবে না। এর নাম ওয়াইসিটি-৫২৯। ওষুধটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। বিজ্ঞান বিষয়ক সংবাদমাধ্যম সায়েন্স অ্যালার্টের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে এই ওষুধটি ইঁদুর ও বানরের ওপর পরীক্ষা করে খুব ভালো ফলাফল পেয়েছেন। ওষুধটি শুক্রাণু তৈরি হওয়া কমিয়ে দিলেও, শরীরের ওপর এর তেমন কোনো খারাপ প্রভাব দেখা যায়নি। নেচার কমিউনিকেশন জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধ অনুসারে, পুরুষ ইঁদুরদের এই ওষুধ দেওয়ার এক মাসের মধ্যে এটি কাজ শুরু করে। ওষুধ দেওয়ার পর সেগুলোর সঙ্গীদের গর্ভধারণের হার প্রায় ১০০ শতাংশ কমে যায়। পুরুষ বানরদের ক্ষেত্রে অবশ্য ওষুধের পরিমাণ বাড়াতে হয়েছে। তবে বানরের ক্ষেত্রেও শুক্রাণুর সংখ্যা দ্রুত কমে যায়, কোনো বড় সমস্যা ছাড়াই।

ভালো খবর হলো, ওষুধটি বন্ধ করার পর প্রাণীরা আবার বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা ফিরে পায়। এই ওষুধটি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের (টেস্টোস্টেরন, এফএসএইচ, ইনহিবিন-বি) মাত্রায় কোনো পরিবর্তন করে না। এই হরমোনগুলো শুক্রাণু তৈরির জন্য প্রয়োজনীয়।

মেয়েদের হরমোনভিত্তিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের কিছু খারাপ দিক আছে। যেমন—ওজন বেড়ে যাওয়া, মন খারাপ থাকা বা ব্যাড কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া। আগে এমন সমস্যার কারণে কিছু ভালো ওষুধের ব্যবহারও বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তাই বিজ্ঞানীরা এখন হরমোন ছাড়া অন্য পদ্ধতি খুঁজছেন। এই পদ্ধতিতে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

ওয়াইসিটি-৫২৯ এর প্রথম ধাপের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। যদিও এর চূড়ান্ত ফলাফল এখনো জানা যায়নি, তবে এটি সফল ছিল। তাই এখন দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এই ধাপে দেখা হবে ওষুধটি কতটা নিরাপদ এবং কার্যকর। নিউজিল্যান্ডে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই পরীক্ষা শুরু হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী গুন্ডা জর্জ বলেন, ‘পুরুষদের জন্য নিরাপদ ও ভালো পিল তৈরি হলে দম্পতিদের জন্য গর্ভনিরোধের আরও সুযোগ তৈরি হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনার দায়িত্ব সবাই মিলে নিতে পারবে এবং পুরুষরাও নিজেদের প্রজনন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।’

অধ্যাপক জর্জের ল্যাব বেশ কয়েক বছর আগে ওয়াইসিটি-৫২৯ নিয়ে গবেষণা শুরু করে। তাঁরা দেখেছেন এটি রেটিনোইক অ্যাসিড রিসেপ্টর (আরএআর) আলফা নামের একটি প্রোটিনের ওপর কাজ করে। এই রিসেপ্টরটি ভিটামিন-এ থেকে তৈরি হওয়া রেটিনোইক অ্যাসিডের সঙ্গে মিশে কোষের বৃদ্ধি, শুক্রাণু তৈরি এবং ভ্রূণের বিকাশে সাহায্য করে।

ওয়াইসিটি-৫২৯ আরএআর-আলফাকে বন্ধ করে দেয়। এটি শুধু এই একটি রিসেপ্টরকে লক্ষ্য করে, তাই খারাপ প্রভাব কম পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এই গবেষণায় অর্থায়ন করছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ। আর এই প্রকল্পে যৌথভাবে কাজ করছে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইওরচয়েস থেরাপিউটিকস নামের একটি ওষুধ কোম্পানি।

অধ্যাপক জর্জ ও তাঁর সঙ্গীরা কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, তারা ২০২২ সালের মধ্যে মানুষের ওপর পরীক্ষা শুরু করবেন। তবে বাস্তবে তা হয়নি। ঘোষণার তুলনায় গবেষণাটি ধীরে চলছে, তবে এটি সঠিক পথেই এগোচ্ছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট গবেষকদের।

ইওরচয়েস থেরাপিউটিকসের প্রধান বিজ্ঞানী নাদজা মানোভিটস বলেন, ‘প্রাণীদের ওপর করা গবেষণা মানুষের ওপর ওয়াইসিটি-৫২৯-এর পরীক্ষা শুরু করার জন্য ভিত্তি তৈরি করেছে এবং পরীক্ষা ভালোভাবে চলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে এবং সারা বিশ্বে প্রায় ৫০ শতাংশ গর্ভধারণ অপ্রত্যাশিতভাবে হয়ে থাকে। তাই আমাদের আরও গর্ভনিরোধক বিকল্প দরকার, বিশেষ করে পুরুষদের জন্য।’

ওয়াইসিটি-৫২৯ ছাড়াও আরও একটি হরমোনবিহীন পুরুষদের জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ নিয়ে গবেষণা চলছে। ২০২৪ সালে বেইলর কলেজ অব মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা সিডিডি-২৮০৭ নামের একটি ওষুধ ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করেন। এটি ইনজেকশন দেওয়ার পর পুরুষ ইঁদুরদের বাচ্চা হওয়া বন্ধ করে দেয়। তবে এটি এখনো মানুষের ওপর পরীক্ষা করা হয়নি।

পুরুষদের জন্য শেষবার কোনো নতুন গর্ভনিরোধক বাজারে এসেছিল ১৯৮০-এর দশকে। তখন বিজ্ঞানীরা ছোট একটি অপারেশনের মাধ্যমে ভ্যাসেকটমি করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। ২০২৩ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ পুরুষই নতুন গর্ভনিরোধক ব্যবহার করতে রাজি। মানোভিটস বলেন, নারীরা অনেক দিন ধরে গর্ভধারণ প্রতিরোধের দায়িত্ব একা বহন করছেন।

তিনি আরও বলেন, ‘তথ্য অনুযায়ী পুরুষরাও সাহায্য করতে চান এবং তাঁরা নতুন গর্ভনিরোধক ব্যবহার করতে ইচ্ছুক। নারীরাও তাদের ওপর ভরসা করেন। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে পুরুষদের গর্ভনিরোধক উদ্ভাবনে কোনো নতুনত্ব আসেনি। তাই এখন পরিবর্তনের সময় এসেছে এবং আমরা এই পরিবর্তনে অংশ নিতে পেরে খুশি।’