রমজানে সুস্থ ও সতেজ থাকতে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। এই সময়ে ঋতু পরিবর্তনের কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, যা নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সারাদিন রোজা রেখে যদি খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা সঠিকভাবে মেনে চলা না হয়, তবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
রোজা পালনের মাধ্যমে শরীরের জন্য অনেক উপকারিতা পাওয়া সম্ভব। এই সময় শরীরের কোষগুলো বিশ্রাম নেয়, শরীর ডিটক্সিফাইড হয় এবং ইমিউনিটি সেল পুনর্গঠিত হয়। কিছু গ্রোথ হরমোনের নিঃসরণও বেড়ে যায়, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তবে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও অনিয়মিত জীবনযাপনের ফলে এসব উপকারিতা পাওয়া সম্ভব হয় না, বরং শরীর আরও দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সহজেই নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অতিরিক্ত ভাজাপোড়া খাবার খাওয়ার ফলে পেটের সমস্যা, গ্যাস্ট্রিক ও হজমজনিত অসুবিধা দেখা দিতে পারে।
রমজানে সাধারণত তিনবার খাবার গ্রহণ করা হয়—ইফতার, রাতের খাবার ও সেহরি। এগুলো কীভাবে গ্রহণ করা উচিত, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ইফতার
ইফতারের খাবার তিন ধাপে ভাগ করে গ্রহণ করাই উত্তম।
প্রথম ধাপ: ইফতার শুরুতে ১-২ গ্লাস পানি, খেজুর এবং যেকোনো একটি ফল খাওয়া ভালো। ইফতারের শুরুতেই চিনি বা লবণযুক্ত পানীয় গ্রহণ এড়িয়ে চলতে হবে।
দ্বিতীয় ধাপ: মাগরিবের নামাজের পর স্বাস্থ্যকর পানীয় গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে এতে চিনি ব্যবহার না করাই ভালো। পানীয় হিসেবে ফলের রস, লেবুপানি, বেলের শরবত, টকদই দিয়ে তৈরি লাচ্ছি বা ডাবের পানি উপযোগী হতে পারে। পানীয়ের সঙ্গে ইফতারের প্রধান খাবার গ্রহণ করা উচিত। প্রতিদিন একই ধরনের খাবার না রেখে ভিন্নতা আনা ভালো। কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ খাবার যেমন নুডলস, রুটি-পরোটা, দই-চিড়া, সবজি খিচুড়ি, ছোলা-মুড়ি ইত্যাদির মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নেওয়া উচিত।
প্রোটিনের উৎস হিসেবে ডালের তৈরি পেঁয়াজু, বেসন দিয়ে তৈরি খাবার, মাছ, মাংস বা ডিমের যে কোনো একটি রাখা যেতে পারে।
তৃতীয় ধাপ: প্রধান খাবারের ৩০ মিনিট পর যদি মিষ্টিজাতীয় খাবার খেতে চান, তবে ঘরোয়া তৈরি খাবার বেছে নেওয়া ভালো। পায়েস, সেমাই, ফিরনি, ফালুদা, কাস্টার্ড—এসব হতে পারে বিকল্প। শিশুরা চাইলে কিশমিশ খেতে পারে। একসঙ্গে অনেক খাবার খেলে হজমজনিত সমস্যা হতে পারে, যেমন পেট ফাঁপা, অ্যাসিডিটি বা গলা জ্বালাপোড়া। তাই ইফতারের খাবার তিন ধাপে গ্রহণ করলে এসব সমস্যা অনেকাংশে কমবে।
রাতের খাবার
ইফতারে ভারী খাবার খাওয়ার ফলে রাতের খাবার হালকা রাখা উত্তম। রাতের খাবার হিসেবে স্যুপ, এক গ্লাস দুধের সঙ্গে কলা, খেজুর ও বাদাম দিয়ে তৈরি শেক, সালাদ বা সেদ্ধ ডিম খাওয়া যেতে পারে। যদি ইফতারে খুব কম খাবার গ্রহণ করা হয়, তবে রাতে তুলনামূলক ভারী খাবার খাওয়া যেতে পারে। রুটি, অল্প পরিমাণ ভাত, সবজি ও মাছ বা অল্প মাংস যুক্ত করা যেতে পারে। তবে ভাতের পরিমাণ কম রাখাই উত্তম। লাউ, পেঁপে, চিচিঙ্গা, চালকুমড়া জাতীয় জলীয় সবজি শরীরকে দীর্ঘক্ষণ আর্দ্র রাখে। রেডমিট মাসে ২-৩ বার খাওয়াই ভালো।
সেহরি
সেহরির খাবারে বৈচিত্র্য থাকা জরুরি। ভাত খেলে কম মশলাযুক্ত সবজি, মাছ বা মাংস ও ডাল রাখা উচিত। প্রতিদিন ভাতের পরিবর্তে দই-চিড়া বা ওটসও রাখা যেতে পারে।
অনেকে ভারী খাবার খেতে না পারলে এক গ্লাস দুধ, একটি সেদ্ধ ডিম, একটি কলা বা এক গ্লাস দুধের সঙ্গে খেজুর ও কলা খেতে পারেন। এটি সারাদিনের শক্তির চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে।
সবচেয়ে ভালো হয় যদি লাল ভাতের সঙ্গে মিশ্রিত সবজি (যেমন লাউশাক, মিষ্টিকুমড়া, শসা, পটোল, ঝিঙে, কচুশাক, কচু), মাছ বা মুরগির একটি টুকরা, আধা কাপ ডাল ও এক কাপ দই বা লো-ফ্যাট দুধ খাওয়া যায়। সঙ্গে ১-২টি খেজুর রাখলে সারাদিনের ক্যালরির ঘাটতি পূরণ হবে।
সেহরি খাওয়ার সময়ের দিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। শেষ মুহূর্তে না খেয়ে সেহরির সময় শেষ হওয়ার অন্তত ৩০-৬০ মিনিট আগে খাওয়া উচিত, যাতে খাবার হজমের জন্য যথেষ্ট সময় পায় এবং সারাদিন পর্যাপ্ত শক্তি জোগায়। অনেকে সেহরির সময় একসঙ্গে প্রচুর পানি পান করেন, যা স্বাস্থ্যকর নয়। বরং ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত অল্প অল্প করে ২-৩ লিটার পানি পান করা উচিত।
আরো কিছু
পর্যাপ্ত পানি পান করুন: ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় এক গ্লাস করে পানি পান করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। দিনে অন্তত ১০-১২ গ্লাস পানি পান করা জরুরি।
ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলুন: চা, কফি বা ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যত কম গ্রহণ করবেন, তত ভালো। এগুলো শরীরকে ডিহাইড্রেট করতে পারে। এর পরিবর্তে হারবাল চা পান করা যেতে পারে।
পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন: রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া জরুরি।
অতিরিক্ত ভাজাপোড়া ও দোকানের খাবার পরিহার করুন: সুস্থ ব্যক্তি হলে তিন দিন পর একদিন পছন্দের খাবার খেতে পারেন। তবে যাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা আছে, তারা ১৫ দিন পর একদিন অল্প পরিমাণে পছন্দের ইফতার গ্রহণ করতে পারেন।
উল্লেখিত পরামর্শ মেনে চলতে পারলে রমজানে সুস্থ থেকে রোজা পালন করা সম্ভব হবে এবং আপনার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে চলবেন।
লেখক : ডায়েটিশিয়ান এন্ড নিউট্রিশনিস্ট, লাইফ কেয়ার মেডিকেল সেন্টার, বিডিএন পল্লবী ডায়াবেটিস সেন্টার।