গেলো বছর ১৫ মার্চ রাতে নিজের ফেসবুক আইডিতে সুইসাইড নোট লিখে আত্নহত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা। তার মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হয়েছে। মৃত্যুর আগে তিনি ফেসবুক পোস্টে তার মৃত্যুর জন্য একজন সহপাঠী ও একজন সহকারী প্রক্টরকে দায়ী করেন।কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সেই সময়ে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৬ মার্চ তদন্ত কমিটি গঠন করে সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশ দেয় প্রশাসন তবে এই তদন্ত রিপোর্ট এক বছরেও প্রকাশ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্ত শিক্ষক দ্বীন ইসলাম ও ছাত্র আম্মানকে বহিষ্কার করা হলেও সেই সিদ্ধান্তে বহাল তারা। এতদিনে প্রকাশ হয়নি পুলিশি রিপোর্টও। এই ঘটনায় অবন্তিকার মা মামলা করলেও হয়নি চার্জশিট।
জানা যায়, গত বছর ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে গঠিত তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন আবুল হোসেন, আইন অনুষদের ডিন মাসুম বিল্লাহ, সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান ঝুমুর আহমেদ এবং আইনকর্তা রঞ্জন কুমার। এই কমিটি ১৩ জুন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট। তদন্ত রিপোর্ট সর্বশেষ সিন্ডিকেটে উঠলেও কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। এমনকি প্রকাশও করা হয়নি এই রিপোর্ট।
১ বছরেও মেলেনি পুলিশি প্রতিবেদন, হয়নি চার্জশিট –
অবন্তিকা হত্যা প্রোরোচনা মামলায় তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্ত শিক্ষক ও ছাত্র গ্রেফতার হলেও গত ১ বছরে এখনো চার্জশিট গঠন হয়নি। পাওয়া যায়নি পুলিশ প্রতিবেদন। পাওয়া যায়নি ময়নাতদন্ত ও ফরেনসিক রিপোর্ট।
সূত্র জানায়, হত্যা চেষ্টার এই মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের বিরুদ্ধে বিশেষ কোন প্রমান এখনও মেলেনি। ফলে এই মামলায় চার্জশিট গঠন হয়নি। এদিকে মামলার তদন্ত কার্যক্রম না এগোলেও একেরপর এক বদলী হচ্ছে তদন্ত কর্মকর্তা। মামলাটির বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, তদন্ত রিপোর্ট কবে নাগাদ প্রকাশ করা হবে এটা এখনো বলা যাচ্ছে না।
সিনিয়র অফিসারদের জানিয়ে তারপরে এই তদন্তের রিপোর্ট কোর্টে জমা দিতে হবে। এই রিপোর্ট কবে নাগাদ কোর্টে উঠতে পারে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটাও বলা যাচ্ছে না যে কোর্টে কবে নাগাদ জমা দিতে পারবো। তবে শীঘ্রই জমা দিয়ে দিবো। এবং জমা দিলে জানানো হবে।
অনিশ্চয়তায় ছাত্রের শিক্ষাজীবন, শিক্ষকের যোগদান-
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আলটিমেটামের ৬ ঘণ্টার মধ্যেই ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে পুলিশ আটক করে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে আম্মান ও শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
গ্রেফতার হয়ে দ্বীন ইসলাম প্রায় ৪ মাস ও আম্মান প্রায় ৮ মাস জেল খাটে। এখন তারা দুজনেই জামিনে আছে। তবে ক্লাসে ফিরতে পারেনি কেউ। আম্মানের বন্ধুদের মাস্টার্স শেষ হতে চললেও বাকি শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা আম্মান। এদিকে একই হাল শিক্ষক দ্বীন ইসলামের। তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়াতে ও পুলিশি রিপোর্ট না আসায় চাকরীতে যোগদান করার নির্দেশ পাচ্ছেন না তিনি। এছাড়া বন্ধ হয়ে আছে বেতন ভাতাও।
অভিযুক্ত শিক্ষার্থী আম্মান বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকার কারণে সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে গেলে অনেক ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বহিষ্কার করার ফলে আমি মাস্টার্স ও শেষ করতে পারছি না। এতে করে আমার ক্যারিয়ার এর উপর অনেক বড় একটা প্রভাব পড়ছে। আমি চাই জবি প্রশাসন সিদ্ধান্ত টা কে এভাবে ঝুলিয়ে না রেখে যতো দ্রুত সম্ভব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এর ফলাফল প্রকাশ করুক।
তদন্ত করে তারা কি কি প্রমাণ পেয়েছে তা সবার সামনে তুলে ধরুক। তদন্ত কমিটির দেয়া রিপোর্টে যদি এই ব্যাপারে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পায় তাহলে তারা আমার বিরুদ্ধে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক আর যদি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয় তাহলে আমার বিরুদ্ধে যে সকল নিষেধাজ্ঞা আছে সেগুলো তুলে আমাকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিক।
অভিযুক্ত শিক্ষক দ্বীন ইসলাম বলেন,বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমার সাথে রাজনৈতিক আচরণ করছে। আমার সাথে অন্যায় আচরণ করছে। এই রিপোর্ট গত ২ জানুয়ারি ৯৯ তম সিন্ডিকেট সভায় উঠেছে। এই আত্মহত্যায় আমি জড়িত কিনা বা এই রিপোর্টে আমার সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা এই ব্যাপারে তারা সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের চিঠিতে কিছু লেখেননি।
চিঠিতে তারা লিখেছে আদালতের মামলা শেষ করে আসলে তারা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করাবে। আমার প্রশ্ন যে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করবো কিনা এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আদালতের মামলার দিকে যদি তাকিয়ে থাকতে হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটি কেন গঠন করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে হয়রানি করছে। তৎকালীন প্রক্টর মোস্তফা কামাল সেই সময়ে অবন্তিকার অভিযোগ আমলে নেয়নি। এই আত্নহত্যার দায় তার।
দ্রুত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে ন্যায় বিচারের দাবি অবন্তিকার মায়েরও-অবন্তিকার মা তাহমিনা বলেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই তদন্ত রিপোর্ট কিভাবে প্রকাশ করবে! প্রকাশ করলে তো কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়ে আসবে। তারপরও আমি হাল ছাড়বো না। এই রিপোর্টের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে কথা বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার গিয়াস উদ্দিন আমার সাথে অনেক বাজে ব্যবহার করেন।
সে কোন ক্ষমতা বলে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার অধিকার তার নাই। প্রশাসন শুধু বলে আমরা শাস্তির যোগ্য ব্যবস্থা নিচ্ছি, কিন্তু তারা কি ব্যবস্থা নিচ্ছে সেটা তারাও জানে না। ১ বছর হয়ে গেছে কিন্তু তারা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অবন্তিকার আত্মহত্যায় যারা বাধ্য করেছিল তারা মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তাহলে প্রশাসন তাদের কোন শাস্তি দিবে আমি জানতে চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রেজাউল করিম বলেন, এ আত্মহত্যার সাথে আমাদের যেসব শিক্ষক এবং যেসব ছাত্র-ছাত্রীরা জড়িত আছে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া যায় সে ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়েছে এবং আমরা সেই আঙ্গিকে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
তদন্ত রিপোর্ট কবে নাগাদ প্রকাশ আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই রিপোর্টের কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে, এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়ে গেলে আমরা জানাবো। এখানে অনেক আইন-কানুনগত ইস্যু আছে। এ সকল আইনকানুন দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এখন এই রিপোর্ট প্রকাশ করার ফলে কেউ যদি কোর্টে গিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তাহলে অনেক বড় ঝামেলায় পড়ে যাবো। ইতিমধ্যে আমরা দুটো ঝামেলায় পড়ে আছি।