পশ্চিমাদের চোখ রাঙানো ইব্রাহিম কি হবেন আফ্রিকার মুক্তির নায়ক?

গত মাসের মাঝামাঝি, বিশ্ব যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির পতনের ৮০ বছর পূর্তি স্মরণে রাশিয়ার দিকে নজর রাখছে, তখন মস্কোর রাজকীয় প্রাসাদে পুতিনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক তরুণ আফ্রিকান নেতা—ইব্রাহিম ত্রাউরে। বয়স মাত্র ৩৭। বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট হিসেবে রুশ সংবাদমাধ্যমে তখন তাঁর পরিচয় ‘আফ্রিকার নতুন হিরো’। পুতিনের সঙ্গে করমর্দন, ক্যামেরার সামনে দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়ানো—সব মিলিয়ে এক রাজনীতিকভাবে মোহনীয় ছবি।

কিন্তু ঠিক সেই সময়েই তার নিজের দেশ বুরকিনা ফাসোতে বেসামরিক মানুষের ওপর নামে রক্তের বৃষ্টি। জিহাদি গোষ্ঠী ও সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষে প্রাণ হারায় শত শত মানুষ। দেশের ভেতরের এই রক্তাক্ত বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর উপস্থিতি, এই দুই বিপরীত চিত্র এক তরুণ শাসকের জন্য সৃষ্টি করে চরম দ্বিধা ও বিব্রতকর পরিস্থিতি।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির পরাজয়ের ৮০তম বার্ষিকীতে গত মাসে মস্কোয় থাকা ৩৭ বছর বয়সী ত্রাউরে হলেন আফ্রিকার সবচেয়ে কমবয়সী নেতা। এই মহাদেশ সব সময় প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও তাদের কঠোর শাসন দেখে অভ্যস্ত। এমতাবস্থায় ভিন্ন এক আবেদন নিয়ে এসেছেন ইব্রাহিম।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় দফা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বুরকিনা ফাসোর ক্ষমতায় আসেন ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ত্রাউরে। এরপর থেকেই তিনি পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সের প্রভাবমুক্ত হয়ে দেশের আত্মনির্ভরতার ডাক দিয়ে যাচ্ছেন। তার একের পর এক সাহসী ও সোজাসাপ্টা বক্তব্য আজও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দারুণ আলোচিত।

ত্রাউরের সেই বক্তব্যগুলো যেন পশ্চিমাদের মুখে স্পষ্ট চপেটাঘাত। বার্তাটি খুবই সরল—‘বুরকিনা ফাসো আর কারও পদলেহন করবে না।’

তবে এই অবস্থান তাকে রাজনৈতিকভাবে নিরঙ্কুশ নিরাপত্তা দেয়নি। সম্প্রতি তার সরকারের বিরুদ্ধে আরও একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে, আফ্রিকায় মার্কিন সামরিক শাখার প্রধান জেনারেল মাইকেল ল্যাংলে সরাসরি অভিযোগ করেছেন, ক্ষমতায় এসে ত্রাউরে দেশের সোনার মজুত নিয়ে স্বচ্ছ নন, করছেন টালবাহানা।

এই অভিযোগের পরপরই গত এপ্রিল মাসে রাজধানী ওয়াগাডুগুর রাস্তায় নেমে আসে হাজারো মানুষ। তারা একজোট হয়ে জানিয়ে দেয়, দেশের সর্বোচ্চ নেতার পাশে তারা অটল। স্লোগান ওঠে—‘কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে, ইব্রাহিম, তুমি এগিয়ে যাও। আমরা তোমার সঙ্গে আছি।’

২০২২ সালের অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় এসে ত্রাউরে দেশটির কয়েক দশক ধরে চলা মারাত্মক নিরাপত্তা সংকটের অবসান ঘটানোর এবং এর সমৃদ্ধ খনিজ সম্পদকে ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য কাজে লাগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অভ্যুত্থানে জর্জরিত দেশ নাইজার ও মালির মতো আঞ্চলিক জোট ইসিওডব্লিউএএস থেকে বেরিয়ে আসে বুরকিনা ফাসো। অনেক তরুণ সমালোচনা করে বলছেন, এই জোট আফ্রিকান নাগরিকদের নয় বরং নেতাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী। সেই সাথে ফ্রান্সের মতো দীর্ঘস্থায়ী পশ্চিমা মিত্রের পক্ষ হয়ে কাজ করে।

বিশ্লেষক ও স্থানীয়রা বলছে, এই পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব ও তারুণ্য ইব্রাহিমকে তরুণদের নেতায় পরিণত করেছে। বুরকিনা ফাসো সীমান্তের কাছে বসবাসকারী ঘানার রিচার্ড আলানডু বলছেন, ‘দেশ-বিদেশে আফ্রিকান তরুণদের মধ্যে এই চেতনা ক্রমেই বাড়ছে যে, তাদের মহাদেশের অগ্রগতিতে বাধা সম্পর্কে কিছু করা দরকার। মনে হচ্ছে ত্রাউরে সেই চেতনার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছেন।’

ইব্রাহিম ত্রাউরের অবস্থান এখন কেমন

গবেষকদের বিভিন্ন তথ্যের বরাতে সংবাদ সংস্থা এপি বলছে, যে নিরাপত্তা সংকটের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি ত্রাউরে দিয়েছিলেন, তা আরও ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। আর সেটি প্রভাব ফেলছে দেশের অর্থনীতিতে। এখনো বুরকিনা ফাসোর বেশির ভাগ নাগরিক খনিজ সম্পদ থেকে কোনো লাভই পাচ্ছে না। পশ্চিম আফ্রিকা নিয়ে কাজ করা নাইজেরিয়ার বেজ ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং নিরাপত্তা অধ্যয়নের অধ্যাপক গাবারা আওয়ানেন বলেন, ‘বুরকিনা ফাসোতে আসলে উন্নতি এখনো হয়নি। চারপাশে যা বলা হচ্ছে, তা কেবল প্রচারণার অংশ।’

আমেরিকাভিত্তিক আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্ট এসিএলইডির তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের অভ্যুত্থানের আগের বছরে সরকার এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী উভয়ের হাতেই ২ হাজার ৮৯৪ জন নিহত হয়েছিল। গত বছরে এই সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে কমপক্ষে ৭ হাজার ২০০ জনে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, হামলার তীব্রতা এতটাই বেড়েছে যে, ওয়াগাডুগু এখন ক্রমেই হুমকির মুখে।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশটির ৬০ শতাংশের বেশি এলাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সহিংসতার ফলে কমপক্ষে ২১ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে এবং প্রায় ৬৫ ​​লাখ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। সেনেগালভিত্তিক টিমবুকতু ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো বাবাকার এনডিয়ায়ে বলছেন, ‘রুশ প্রচারণার অংশ হিসেবে ত্রাউরেকে এভাবে  প্রশংসায় ভাসানো হচ্ছে। বুরকিনা ফাসোর ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা সংকট সত্ত্বেও ত্রাউরে এখনও কেবলমাত্র প্রচারণার কারণে জনমনে এত আগ্রহ তৈরি করছেন এবং আলোড়ন তুলে যাচ্ছেন। আফ্রিকাতে বিভিন্ন নেতৃত্বের প্রতি গভীর হতাশা রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব এখন বলির পাঁঠা। সেই অবস্থায় আলোচনা ত্রাউরেকে নিয়ে হওয়াটাই স্বাভাবিক।’

পশ্চিম আফ্রিকায় তরুণদের ক্ষমতা দখলের ইতিহাস রয়েছে। যেমনটি ১৯৮০-এর দশকে ঘানায় জন জেরি রাওলিংস, লাইবেরিয়ার স্যামুয়েল ডো এবং বুরকিনা ফাসোতে থমাস সাঙ্কারাকে দেখা যায়। আফ্রিকায় পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সেই ইতিহাস ত্রাউরের মতো ব্যক্তিদের ‘আদর্শ’ হিসেবে গড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করে। তবুও, আফ্রিকার কনিষ্ঠ শাসককে ঘিরে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তাকে কেবল ‘প্রচারণার ম্যাজিক’ বলে ব্যাখ্যা করা যায় না। আফ্রিকার বিশ্লেষক এবং টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চিডি ওডিনকালুর মতে, ‘ত্রাউরে একটি বিপ্লবী বার্তা প্রকাশ করেছেন, যা তাদের দেশে গণতন্ত্র হারিয়ে যাওয়ার কারণে হতাশ তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে বেশ আগ্রহ তৈরি করেছে।’

পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ বুরকিনা ফাসো গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক সংকট, নিরাপত্তাহীনতা ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পটভূমিতেই উঠে আসেন তরুণ সাহসী নেতা ইব্রাহিম ত্রাউরে। বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, তিনি দেশের তরুণদের আশার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

বুরকিনা ফাসোর সেনাবাহিনীর ছোট একটি বিদ্রোহী অংশের নেতৃত্ব দেওয়া ত্রাউরে দেশটির সাবেক জান্তা শাসক লে. কর্নেল পল–হেনরি সান্দাওগো দামিবাকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির ক্ষমতা দখল করেন। পল–হেনরি সান্দাওগোও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বুরকিনা ফাসোর ক্ষমতা দখল করেন। অভ্যুত্থানের পর নিজেকে বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন ত্রাউরে। তিনি ওই ঘোষণায় দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং রাষ্ট্রীয় বিধি–বিধান জারি রাখার প্রতিশ্রুতি দেন।

ত্রাউরের কথা শুধু বুরকিনা ফাসোতেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে গোটা আফ্রিকায়, এমনকি আফ্রিকার বাইরেও। অনেকেই মনে করেন, তিনি আফ্রিকার বীরদের পথেই হাঁটছেন। ভক্তরা তাঁকে তুলনা করেন বুরকিনা ফাসোরই আরেক কিংবদন্তি নেতা টমাস সাঙ্কারার সঙ্গে, যিনি ছিলেন একজন মার্কসবাদী বিপ্লবী এবং অনেকের চোখে ‘আফ্রিকার চে গুয়েভারা’।

আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কন্ট্রোল রিস্কসের জ্যেষ্ঠ গবেষক বেভারলি ওচেং ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, ‘ত্রাউরের প্রভাব অনেক। আমি এমনকি কেনিয়া থেকেও রাজনীতিক ও লেখকদের বলতে শুনেছি—এই তো সেই মানুষ, যাকে আমরা খুঁজছিলাম।’

২০২২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর ক্যাপ্টেন ত্রাউরে ফ্রান্সের সঙ্গে পুরোনো ঔপনিবেশিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এর বদলে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ জোট গড়ে তোলেন—যার অংশ হিসেবে একটি রুশ প্যারামিলিটারি বাহিনীও বুরকিনা ফাসোতে মোতায়েন করা হয়। একইসঙ্গে তাঁর সরকার বাম ঘরানার অর্থনৈতিক নীতির পথে হাঁটে। এই নীতির আওতায় গঠন করা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত খনি প্রতিষ্ঠান। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দেশটিতে ব্যবসা করতে চাইলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারকে ১৫ শতাংশ অংশীদারত্ব দিতে হবে। শুধু তাই নয়, তাদের শিখিয়ে দিতে হবে সেসব প্রযুক্তি ও দক্ষতা, যাতে দেশের লোকজন নিজেরাই একদিন সবকিছু পরিচালনা করতে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকার ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের গবেষক এনোক র‍্যান্ডি আইকিনস বিবিসিকে বলেন, ত্রাউরের এই সংস্কার আফ্রিকাজুড়ে তার জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়েছে। তার মতে, ত্রাউরে এখন সম্ভবত আফ্রিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রপ্রধান। তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। এতে অবশ্য অনেক ভুয়া তথ্য বা পোস্ট ছড়ানো হচ্ছে। এসব পোস্ট মূলত তাঁর বিপ্লবী ইমেজকে শক্তিশালী করার জন্যই তৈরি।

বক্তব্য দিতে বেশ পটু ত্রাউরে। তার এই গুণের কারণে সমর্থনও বাড়ছে। বক্তৃতায় পশ্চিমাদের তুলোধুনো করেন এই তরুণ নেতা, যা জনমনে এক ধরনের মানসিক শান্তি দেয়। তারা ভাবতে থাকে, এই বুঝি আফ্রিকার ত্রাণকর্তা ধরায় এসে পড়েছেন।

তবে ২০২২ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইব্রাহিম ত্রাউরের নেতৃত্বে বুরকিনা ফাসোতে বড় কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতির খবর মেলেনি। বরং দেশটির রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দৃশ্যপটে রাশিয়ার প্রভাব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ত্রাউরে এখন প্রায় পুরোপুরি রুশ বলয়ের অংশ হয়ে উঠেছেন।

তবে তিনি যেই বলয়ের সঙ্গেই থাকুন না কেন, বুরকিনা ফাসোর সাধারণ মানুষ এখনো তাকিয়ে আছেন সত্যিকারের মুক্তির পথে। তাদের স্বপ্ন—একটি নিরাপদ দেশ, যেখানে দিনে-দুপুরে রাস্তায় বের হলে জীবনের শঙ্কা থাকবে না। প্রশ্ন উঠছে, ইব্রাহিম ত্রাউরে কি সত্যিই পারবেন সেই প্রতিশ্রুত সুদিন এনে দিতে?

ট্যাগস :

পশ্চিমাদের চোখ রাঙানো ইব্রাহিম কি হবেন আফ্রিকার মুক্তির নায়ক?

আপডেট সময় : ০৭:৪২:৩২ অপরাহ্ণ, বৃহস্পতিবার, ৫ জুন ২০২৫

গত মাসের মাঝামাঝি, বিশ্ব যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির পতনের ৮০ বছর পূর্তি স্মরণে রাশিয়ার দিকে নজর রাখছে, তখন মস্কোর রাজকীয় প্রাসাদে পুতিনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক তরুণ আফ্রিকান নেতা—ইব্রাহিম ত্রাউরে। বয়স মাত্র ৩৭। বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট হিসেবে রুশ সংবাদমাধ্যমে তখন তাঁর পরিচয় ‘আফ্রিকার নতুন হিরো’। পুতিনের সঙ্গে করমর্দন, ক্যামেরার সামনে দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়ানো—সব মিলিয়ে এক রাজনীতিকভাবে মোহনীয় ছবি।

কিন্তু ঠিক সেই সময়েই তার নিজের দেশ বুরকিনা ফাসোতে বেসামরিক মানুষের ওপর নামে রক্তের বৃষ্টি। জিহাদি গোষ্ঠী ও সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষে প্রাণ হারায় শত শত মানুষ। দেশের ভেতরের এই রক্তাক্ত বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর উপস্থিতি, এই দুই বিপরীত চিত্র এক তরুণ শাসকের জন্য সৃষ্টি করে চরম দ্বিধা ও বিব্রতকর পরিস্থিতি।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির পরাজয়ের ৮০তম বার্ষিকীতে গত মাসে মস্কোয় থাকা ৩৭ বছর বয়সী ত্রাউরে হলেন আফ্রিকার সবচেয়ে কমবয়সী নেতা। এই মহাদেশ সব সময় প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও তাদের কঠোর শাসন দেখে অভ্যস্ত। এমতাবস্থায় ভিন্ন এক আবেদন নিয়ে এসেছেন ইব্রাহিম।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় দফা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বুরকিনা ফাসোর ক্ষমতায় আসেন ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ত্রাউরে। এরপর থেকেই তিনি পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সের প্রভাবমুক্ত হয়ে দেশের আত্মনির্ভরতার ডাক দিয়ে যাচ্ছেন। তার একের পর এক সাহসী ও সোজাসাপ্টা বক্তব্য আজও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দারুণ আলোচিত।

ত্রাউরের সেই বক্তব্যগুলো যেন পশ্চিমাদের মুখে স্পষ্ট চপেটাঘাত। বার্তাটি খুবই সরল—‘বুরকিনা ফাসো আর কারও পদলেহন করবে না।’

তবে এই অবস্থান তাকে রাজনৈতিকভাবে নিরঙ্কুশ নিরাপত্তা দেয়নি। সম্প্রতি তার সরকারের বিরুদ্ধে আরও একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে, আফ্রিকায় মার্কিন সামরিক শাখার প্রধান জেনারেল মাইকেল ল্যাংলে সরাসরি অভিযোগ করেছেন, ক্ষমতায় এসে ত্রাউরে দেশের সোনার মজুত নিয়ে স্বচ্ছ নন, করছেন টালবাহানা।

এই অভিযোগের পরপরই গত এপ্রিল মাসে রাজধানী ওয়াগাডুগুর রাস্তায় নেমে আসে হাজারো মানুষ। তারা একজোট হয়ে জানিয়ে দেয়, দেশের সর্বোচ্চ নেতার পাশে তারা অটল। স্লোগান ওঠে—‘কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে, ইব্রাহিম, তুমি এগিয়ে যাও। আমরা তোমার সঙ্গে আছি।’

২০২২ সালের অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় এসে ত্রাউরে দেশটির কয়েক দশক ধরে চলা মারাত্মক নিরাপত্তা সংকটের অবসান ঘটানোর এবং এর সমৃদ্ধ খনিজ সম্পদকে ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য কাজে লাগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অভ্যুত্থানে জর্জরিত দেশ নাইজার ও মালির মতো আঞ্চলিক জোট ইসিওডব্লিউএএস থেকে বেরিয়ে আসে বুরকিনা ফাসো। অনেক তরুণ সমালোচনা করে বলছেন, এই জোট আফ্রিকান নাগরিকদের নয় বরং নেতাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী। সেই সাথে ফ্রান্সের মতো দীর্ঘস্থায়ী পশ্চিমা মিত্রের পক্ষ হয়ে কাজ করে।

বিশ্লেষক ও স্থানীয়রা বলছে, এই পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব ও তারুণ্য ইব্রাহিমকে তরুণদের নেতায় পরিণত করেছে। বুরকিনা ফাসো সীমান্তের কাছে বসবাসকারী ঘানার রিচার্ড আলানডু বলছেন, ‘দেশ-বিদেশে আফ্রিকান তরুণদের মধ্যে এই চেতনা ক্রমেই বাড়ছে যে, তাদের মহাদেশের অগ্রগতিতে বাধা সম্পর্কে কিছু করা দরকার। মনে হচ্ছে ত্রাউরে সেই চেতনার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছেন।’

ইব্রাহিম ত্রাউরের অবস্থান এখন কেমন

গবেষকদের বিভিন্ন তথ্যের বরাতে সংবাদ সংস্থা এপি বলছে, যে নিরাপত্তা সংকটের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি ত্রাউরে দিয়েছিলেন, তা আরও ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। আর সেটি প্রভাব ফেলছে দেশের অর্থনীতিতে। এখনো বুরকিনা ফাসোর বেশির ভাগ নাগরিক খনিজ সম্পদ থেকে কোনো লাভই পাচ্ছে না। পশ্চিম আফ্রিকা নিয়ে কাজ করা নাইজেরিয়ার বেজ ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং নিরাপত্তা অধ্যয়নের অধ্যাপক গাবারা আওয়ানেন বলেন, ‘বুরকিনা ফাসোতে আসলে উন্নতি এখনো হয়নি। চারপাশে যা বলা হচ্ছে, তা কেবল প্রচারণার অংশ।’

আমেরিকাভিত্তিক আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্ট এসিএলইডির তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের অভ্যুত্থানের আগের বছরে সরকার এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী উভয়ের হাতেই ২ হাজার ৮৯৪ জন নিহত হয়েছিল। গত বছরে এই সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে কমপক্ষে ৭ হাজার ২০০ জনে দাঁড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, হামলার তীব্রতা এতটাই বেড়েছে যে, ওয়াগাডুগু এখন ক্রমেই হুমকির মুখে।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশটির ৬০ শতাংশের বেশি এলাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সহিংসতার ফলে কমপক্ষে ২১ লাখ মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে এবং প্রায় ৬৫ ​​লাখ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। সেনেগালভিত্তিক টিমবুকতু ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো বাবাকার এনডিয়ায়ে বলছেন, ‘রুশ প্রচারণার অংশ হিসেবে ত্রাউরেকে এভাবে  প্রশংসায় ভাসানো হচ্ছে। বুরকিনা ফাসোর ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা সংকট সত্ত্বেও ত্রাউরে এখনও কেবলমাত্র প্রচারণার কারণে জনমনে এত আগ্রহ তৈরি করছেন এবং আলোড়ন তুলে যাচ্ছেন। আফ্রিকাতে বিভিন্ন নেতৃত্বের প্রতি গভীর হতাশা রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব এখন বলির পাঁঠা। সেই অবস্থায় আলোচনা ত্রাউরেকে নিয়ে হওয়াটাই স্বাভাবিক।’

পশ্চিম আফ্রিকায় তরুণদের ক্ষমতা দখলের ইতিহাস রয়েছে। যেমনটি ১৯৮০-এর দশকে ঘানায় জন জেরি রাওলিংস, লাইবেরিয়ার স্যামুয়েল ডো এবং বুরকিনা ফাসোতে থমাস সাঙ্কারাকে দেখা যায়। আফ্রিকায় পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সেই ইতিহাস ত্রাউরের মতো ব্যক্তিদের ‘আদর্শ’ হিসেবে গড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করে। তবুও, আফ্রিকার কনিষ্ঠ শাসককে ঘিরে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তাকে কেবল ‘প্রচারণার ম্যাজিক’ বলে ব্যাখ্যা করা যায় না। আফ্রিকার বিশ্লেষক এবং টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চিডি ওডিনকালুর মতে, ‘ত্রাউরে একটি বিপ্লবী বার্তা প্রকাশ করেছেন, যা তাদের দেশে গণতন্ত্র হারিয়ে যাওয়ার কারণে হতাশ তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে বেশ আগ্রহ তৈরি করেছে।’

পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ বুরকিনা ফাসো গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক সংকট, নিরাপত্তাহীনতা ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পটভূমিতেই উঠে আসেন তরুণ সাহসী নেতা ইব্রাহিম ত্রাউরে। বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, তিনি দেশের তরুণদের আশার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

বুরকিনা ফাসোর সেনাবাহিনীর ছোট একটি বিদ্রোহী অংশের নেতৃত্ব দেওয়া ত্রাউরে দেশটির সাবেক জান্তা শাসক লে. কর্নেল পল–হেনরি সান্দাওগো দামিবাকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির ক্ষমতা দখল করেন। পল–হেনরি সান্দাওগোও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বুরকিনা ফাসোর ক্ষমতা দখল করেন। অভ্যুত্থানের পর নিজেকে বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন ত্রাউরে। তিনি ওই ঘোষণায় দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং রাষ্ট্রীয় বিধি–বিধান জারি রাখার প্রতিশ্রুতি দেন।

ত্রাউরের কথা শুধু বুরকিনা ফাসোতেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে গোটা আফ্রিকায়, এমনকি আফ্রিকার বাইরেও। অনেকেই মনে করেন, তিনি আফ্রিকার বীরদের পথেই হাঁটছেন। ভক্তরা তাঁকে তুলনা করেন বুরকিনা ফাসোরই আরেক কিংবদন্তি নেতা টমাস সাঙ্কারার সঙ্গে, যিনি ছিলেন একজন মার্কসবাদী বিপ্লবী এবং অনেকের চোখে ‘আফ্রিকার চে গুয়েভারা’।

আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কন্ট্রোল রিস্কসের জ্যেষ্ঠ গবেষক বেভারলি ওচেং ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেন, ‘ত্রাউরের প্রভাব অনেক। আমি এমনকি কেনিয়া থেকেও রাজনীতিক ও লেখকদের বলতে শুনেছি—এই তো সেই মানুষ, যাকে আমরা খুঁজছিলাম।’

২০২২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর ক্যাপ্টেন ত্রাউরে ফ্রান্সের সঙ্গে পুরোনো ঔপনিবেশিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এর বদলে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ জোট গড়ে তোলেন—যার অংশ হিসেবে একটি রুশ প্যারামিলিটারি বাহিনীও বুরকিনা ফাসোতে মোতায়েন করা হয়। একইসঙ্গে তাঁর সরকার বাম ঘরানার অর্থনৈতিক নীতির পথে হাঁটে। এই নীতির আওতায় গঠন করা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত খনি প্রতিষ্ঠান। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দেশটিতে ব্যবসা করতে চাইলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারকে ১৫ শতাংশ অংশীদারত্ব দিতে হবে। শুধু তাই নয়, তাদের শিখিয়ে দিতে হবে সেসব প্রযুক্তি ও দক্ষতা, যাতে দেশের লোকজন নিজেরাই একদিন সবকিছু পরিচালনা করতে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকার ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের গবেষক এনোক র‍্যান্ডি আইকিনস বিবিসিকে বলেন, ত্রাউরের এই সংস্কার আফ্রিকাজুড়ে তার জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়েছে। তার মতে, ত্রাউরে এখন সম্ভবত আফ্রিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রপ্রধান। তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। এতে অবশ্য অনেক ভুয়া তথ্য বা পোস্ট ছড়ানো হচ্ছে। এসব পোস্ট মূলত তাঁর বিপ্লবী ইমেজকে শক্তিশালী করার জন্যই তৈরি।

বক্তব্য দিতে বেশ পটু ত্রাউরে। তার এই গুণের কারণে সমর্থনও বাড়ছে। বক্তৃতায় পশ্চিমাদের তুলোধুনো করেন এই তরুণ নেতা, যা জনমনে এক ধরনের মানসিক শান্তি দেয়। তারা ভাবতে থাকে, এই বুঝি আফ্রিকার ত্রাণকর্তা ধরায় এসে পড়েছেন।

তবে ২০২২ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইব্রাহিম ত্রাউরের নেতৃত্বে বুরকিনা ফাসোতে বড় কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতির খবর মেলেনি। বরং দেশটির রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দৃশ্যপটে রাশিয়ার প্রভাব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ত্রাউরে এখন প্রায় পুরোপুরি রুশ বলয়ের অংশ হয়ে উঠেছেন।

তবে তিনি যেই বলয়ের সঙ্গেই থাকুন না কেন, বুরকিনা ফাসোর সাধারণ মানুষ এখনো তাকিয়ে আছেন সত্যিকারের মুক্তির পথে। তাদের স্বপ্ন—একটি নিরাপদ দেশ, যেখানে দিনে-দুপুরে রাস্তায় বের হলে জীবনের শঙ্কা থাকবে না। প্রশ্ন উঠছে, ইব্রাহিম ত্রাউরে কি সত্যিই পারবেন সেই প্রতিশ্রুত সুদিন এনে দিতে?