ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা কেবল আত্মিক ও নৈতিক উন্নতির দিশা দেয় না, বরং রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে। আত্মরক্ষা ও উম্মাহর স্বাধীনতা রক্ষার্থে সামরিক শক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম কখনো আক্রমণাত্মক আগ্রাসনের পক্ষে নয়, তবে ইসলাম আত্মরক্ষার জন্য শক্তিশালী সামরিক কাঠামো গড়ে তোলা অপরিহার্য বলে মনে করে।
পবিত্র কোরআনে সামরিক শক্তির নির্দেশনা:
সুরা আনফালের ৬০ নং আয়াতে সরাসরি সামরিক প্রস্তুতির আদেশ দিয়ে বলা হয়েছে: ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য শক্তি ও যুদ্ধঘোড়া প্রস্তুত রাখো, যার দ্বারা আল্লাহর ও তোমাদের শত্রুদের ভয়ভীতি দেখাতে পারো।’ তাফসিরে ইবন কাসীরে এ আয়াত ব্যাখ্যায় লেখা হয়েছে- ‘শক্তি বলতে এমন সকল উপাদান বোঝানো হয়েছে যা দ্বারা আল্লাহর ও মুসলমানদের শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গঠন করা যায়।’ (তাফসির ইবন কাসীর, আনফাল :৬০)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবি বলেন, ‘এই আয়াতে স্পষ্টভাবে প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির নির্দেশ রয়েছে, এবং যুদ্ধশিল্প ও সমর কৌশল শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে।’
হাদিসের আলোকে সামরিক প্রস্তুতি:
রাসুল (সা.) নিজ হাতে একাধিক যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন এবং সাহাবিদের সর্বোচ্চ সামরিক প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন। ধন-সম্পদ ব্যয় করে শক্তি অর্জনের উত্সাহ দিয়ে তিনি বলেছেন: ‘জেনে রাখো, শক্তি হলো তীর নিক্ষেপ; জেনে রাখো, শক্তি হলো তীর নিক্ষেপ; জেনে রাখো, শক্তি হলো তীর নিক্ষেপ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯১৭)
এই হাদিস থেকে স্পষ্ট হয় যে, রাসুল (সা.) যেকোনো সময় শত্রুর মোকাবিলা করতে প্রস্তুত থাকার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। যুদ্ধবিদ্যার রপ্ত করার ব্যাপারে তিনি বলেছেন: ‘যে তীর-ধনুক চালানো শিখে তা ভুলে যায়, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৯১৯)
এই হাদিস সামরিক কলাকৌশলের গুরুত্ব এবং তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট করে।
সামরিক শক্তির ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টিভঙ্গি:
খালিদ ইবন ওয়ালিদ (রা.) যাকে ‘সাইফুল্লাহ’ বা আল্লাহর তরবারি বলা হতো। তিনি যুদ্ধ প্রস্তুতিকে কেবল সামরিক কার্যকলাপ হিসেবে নয়, বরং ঈমানী কর্তব্য হিসেবেও দেখতেন। তিনি বলতেন, ‘আমি এমন রাতে ঘুমাই না যখন আমার তরবারি আমার বালিশের নিচে না থাকে।’ (হুসায়ন হায়কাল রচিত হায়াতে খালিদ ইবন ওয়ালিদ)
অর্ধ পৃথিবীর শাসনকারী দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলতেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাঁতার, তীরন্দাজি ও ঘোড়ায় চড়ার শিক্ষা দাও।’ (ইবনুল কাইয়্যিম জাযিয়্যাহ রচিত তুহফাতুল মাউদুল বি আহকামিল মাওলুদ, পৃ ২২)
উমার (রা.) এর কথাটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ভবিষ্যত্ গঠনে প্রাথমিক পর্যায়ে সামরিক প্রস্তুতির প্রতি দিক নির্দেশ করে।
ইতিহাস বলে খিলাফতের সোনালী যুগে মুসলিম সেনাবাহিনী ছিল সময়ের সবচেয়ে প্রশিক্ষিত ও শৃঙ্খলিত বাহিনী। খলিফা হারুনুর রশীদ তাঁর সেনাবাহিনীকে এতোটাই আধুনিক করেছিলেন যে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যও তার ভয়ে তটস্ত থাকতো।
সমকালীন আলেমদের ভাষ্য:
বিগত শতাব্দির বিশ্বনন্দিত মুসলিম স্কলার শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) বলেন, ‘উম্মাহর দুর্বলতা কেবল আধ্যাত্মিক বা নৈতিক নয়; সামরিক ও কৌশলগত প্রস্তুতির ঘাটতিই তার পতনের মূল কারণ।’ (নাজরাতুন ফি তারীখিল ইসলাম)
মিশরের আল আযহার থেকে শিক্ষা নিয়ে বের হয়ে সারা বিশ্বের মুসলিম সমাজের কণ্ঠ হয়ে ওঠা ব্যক্তিত্ব ড. ইউসুফ আল-কারাযাভী (রহ.) বলেন, ‘প্রতিরক্ষা খাতে দুর্বলতা মানেই পুরো মুসলিম বিশ্বকে শত্রুদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া।’ (আল-ইসলাম ওয়া আত-তাহাদ্দিয়াত আল-মুআসিরাহ, পৃ: ১২৯)
আজকের বিশ্বে সামরিক শক্তি কেবল অস্ত্রভিত্তিক নয়; বরং প্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা, গোয়েন্দা শক্তি ও মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সক্ষমতাও এর অন্তর্ভুক্ত। ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের উচিত আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সামরিক প্রস্তুতি নেওয়া। প্রতিরক্ষা খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করা। যৌথ মুসলিম প্রতিরক্ষা জোট গঠন করা। নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক ভিত দৃঢ়করণে মনোযোগী হওয়া।
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের ২০২৪ সালের তথ্য মতে সামরিক শক্তিতে শীর্ষ পাঁচ মুসলিম দেশ:
তুরষ্ক: বৈশ্বিক সামরিক র্যাংকে অস্টম, বার্ষিক সামরিক বাজেট ২৬ বিলিয়ন ডলার, সেনাবাহিনীর আকার আট লাখের বেশি, তাদের নিজস্ব ড্রোন প্রযুক্তিসহ নেটোর সদস্যপদ রয়েছে।
পাকিস্তান: বৈশ্বিক সামরিক র্যাংকে নবম, বার্ষিক সামরিক বাজেট ১০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, সেনাবাহিনীর আকার দশ লাখের বেশি, তারা পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার পাশাপামি নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি রয়েছে।
ইরান: বৈশ্বিক সামরিক র্যাংকে চৌদ্দতম, বার্ষিক সামরিক বাজেট ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, সেনাবাহিনীর আকার দশ লাখের বেশি, তাদের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক মিলিশিয়া সমর্থন রয়েছে।
মিশর: বৈশ্বিক সামরিক র্যাংকে পনেরতম, বার্ষিক সামরিক বাজেট ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, সেনাবাহিনীর আকার নয় লাখের বেশি, তাদের সুয়েজ ক্যানালের কৌশলগত শক্তি রয়েছে।
সৌদি আরব: বৈশ্বিক সামরিক র্যাংকে বাইশতম, বার্ষিক সামরিক বাজেট ৬৯ বিলিয়ন ডলার, সেনাবাহিনীর আকার ২ লাখের বেশি, তাদের বিশাল সামরিক বাজেটের পাশাপাশি আমেরিকান অস্ত্রের সংগ্রহশালা থাকলেও নিজেদের আধুনিক বাহিনী হিসেবে এখনো প্রস্তুত করতে পারেনি।
কোরআন-হাদিস, সাহাবায়ে কেরাম ও ইসলামী ইতিহাসের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করা শুধু সাময়িক প্রয়োজন নয়, বরং এটি একটি কোরআন নির্দেশিত চিরন্তন কর্তব্যও বটে। তাই মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জন্য সামরিক শক্তি অর্জনের মাধ্যমে কোরআনের এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করা এবং বিশ্বে শান্তি ও ন্যায়ভিত্তিক ভারসাম্য রক্ষা করণে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
লেখক- প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস
saifpas352@gmail.com