বিশ্বব্যাপী আজ শনিবার (৭ জুন) পালিত হচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহা। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মহাসমারোহে চলছে পশু কোরবানি। যদিও দীর্ঘ ৮০ বছর আগেও বাংলার মুসলিমদের এ অধিকার ছিল না।
কোরবানির প্রশ্ন এলেই নানা ঘটনায় তটস্থ থাকতে হতো তাদের। ঝামেলা এড়াতে অধিকাংশ মুসলমান ছাগল বা খাসি কোরবানি দিতেন।
আজ যেভাবে বাংলাদেশের মুসলমানরা কোরবানির আনন্দে মাতোয়ারা সেই অধিকার তাদের বাবা-দাদাদের লড়াই করে আদায় করতে হয়েছে। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ‘বাংলাদেশের উৎসব’ নামক বইয়ে এমনটাই লিখেছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘আজকে আমরা ঈদ-উল-আজহায় অনায়াসে গরু কিনে এনে সহজেই কোরবানি দিয়ে ফেলি। আশি-একশো দূরে থাকুক পঞ্চাশ বছর আগেও তা তেমন সহজসাধ্য ছিল না। আজকের প্রজন্ম হয়তো অবাক হবে যে, এ নিয়ে সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর বিতর্ক চলেছে এবং কোরবানি বিশেষ করে গরু কোরবানি দেওয়ার অধিকার আমাদের বাপ-দাদাদের লড়াই করে আদায় করতে হয়েছে।’
এই পরিস্থিতি কেন হয়েছিল সে প্রসঙ্গে অধ্যাপক মামুন বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় যারা হিন্দু জমিদার ছিলেন, তারা গরু কোরবানি নিষিদ্ধ করা শুরু করলেন। অন্যদিকে গরু বেশি প্রচলিত না থাকার আরেকটি কারণ ছিল আর্থিক দৈন্য। বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক দৈন্য এতটাই প্রবল ছিল যে, একটা গরু কিনে কোরবানি দেওয়া তাদের পক্ষে খুব দুরূহ ছিল।’
এমনকি উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের সময়ও এই অঞ্চলে গরু কোরবানি খুব একটা প্রচলিত ছিল না। মুঘল আমলে এই অঞ্চলে অনেক হিন্দু জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। যে কারণে মুঘল সম্রাট আকবরের সময়েও গরু কোরবানিতে নানা বিধি-নিষেধের বিষয়গুলো চলে আসে।
অধ্যাপক আতাউর রহমান মিয়াজীর মতে, মুঘল আমলে আকবর যখন সম্রাট হলেন। দীনে এলাহী যখন প্রচলিত হলো ওই সময়ে ঐতিহাসিক আবুল ফজলসহ অনেকে পরামর্শ দিলেন গরুটা যেন জবেহ করা না হয়। কারণ ওই সময়ে এ অঞ্চলে ৯৫ শতাংশই হিন্দুদের বসবাস ছিল। সঙ্গত কারণে এটা জবাই করা মানে হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া। কোরবানি করলে তখন সাধারণ হিন্দুদের মনে ধর্মীয় অনুভূতির ক্ষেত্রে বিরূপ চিন্তা আসবে।
অধ্যাপক মামুনের মতে, ১৯৪০-এর দিকে গরু কোরবানিটা বেশি শুরু হয়। তখন এ অঞ্চলের পাট চাষিদের হাতে কিছু টাকা আসতে শুরু করল। তখন কিছু কিছু জায়গায় নিজেদের স্ট্যাটাস দেখানোর জন্যও গরু কোরবানি দেওয়া শুরু হলো।
বাংলাদেশ ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর গরু কোরবানির ওপর বিধিনিষেধ বা অজানা ভয় দূর হয়। এরপর দিন দিন গরু কোরবানির পরিমাণ বাড়তে থাকে। তখন কোরবানির আমেজে মাততে থাকেন মুসলমানরা। তারা প্রকাশ্যে গরু কিনে হৈ-হুল্লোড় করে জবাই দিতে শুরু করেন।
আর্থিক দৈন্যের কারণে তখন ঢাকায় অধিকাংশ গরু কোরবানি হতো। গ্রামের বিত্তশালী মাতবর ঘরানার লোকজন গরু কোরবানি করতে পারতেন। অন্যরা ছাগল বা খাসি কোরবানি দিতেন। দেশ স্বাধীনের পর মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে।
এ ছাড়া ভাগে গরু কোরবানি দেওয়ার রীতি জনপ্রিয় হয়। ধীরে ধীরে ঈদুল আজহা উপলক্ষে গরু কেনার হার বাড়ে। সে সঙ্গে নতুন এলাকায় বসতে থাকে পশুর হাট। এক পর্যায়ে গরু কোরবানি ঈদুল আজহার অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। পশুর হাটের নাম লোকমুখে হয়ে যায় ‘গরুর হাট’।