আপডেট সময় :
০৩:১৪:৪৭ অপরাহ্ণ, মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারি ২০২৫
৭৫৪
বার পড়া হয়েছে
মেরাজ শব্দের অর্থ হলো ঊর্ধ্বগমন। শবেমেরাজ মানে ঊর্ধ্বগমনের রাত। শব শব্দটি ফারসি যার অর্থ রাত। আরবিতে বলা হয় লাইলাতুল মেরাজ।
মেরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ (সা) দেখতে পেলেন আদম (আ.)-কে ঘিরে আছে অনেক লোক। তিনি ডানে তাকালে হাসছেন আর বামে তাকালে কাঁদছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ সম্পর্কে জানতে চাইলে, বলা হলো ‘এরা সবাই আদমের বংশধর। আদম (আ) তার নেক বংশধরদের দেখলে হাসতেন আর অসত্ বংশদরদের দেখলে কাঁদতেন। এরপর নবী (সা) কে বিস্তারিত দেখার জন্যে সুযোগ করে দেওয়া হয়।
১. এক স্থানে তিনি দেখলেন কিছু লোক ফসল কাটছে, যত কাটছে ততই বাড়ছে। মহানবী (সা.) জিব্রাইল (আ.)-কে প্রশ্ন করলেন ভাই এরা কারা? এ প্রশ্নের জবাবে জিব্রাইল (আ.) বলেন, এরা আল্লাহর পথে জিহাদকারী।
২. এরপর দেখলেন কিছু লোকের মাথা পাথর মেরে চূর্ণ করা হচ্ছে। এদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হল এরা ওইসব লোক যাদের অনিহা ও অসনে্তাষ তাদের নামাজের জন্যে উঠতে দিত না।
৩. এরপর তিনি এমন কিছু লোক দেখতে পেলেন, যাদের কাপড়ের আগে পিছে তালি দেওয়া। আর তারা পশুর মত ঘাস খাচ্ছে। এদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হলো, এরা তাদের সম্পদের জাকাত আদায় করত না, দান খয়রাতও করত না।
৪. এরপর তিনি এমন একজন লোক দেখলেন, যে ব্যক্তি কাঠ জমা করে বোঝা হিসাবে উঠাবার চষ্টো করে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও আরো বেশি কাঠ তার বোঝার সাথে যোগ করছে। এই লোকটির পরিচয় জানতে চেয়ে উত্তর পেলেন, এ ব্যক্তিটির ওপর এত বেশি দায়িত্বের বোঝা ছিল যে, সে বহন করতে পারতো না। তা সত্ত্বেও বোঝা কামানোর পরিবর্তে আরো অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিত।
৫. এর পরের দৃশ্যে তিনি দেখলেন, কিছু লোকের ঠোট ও জিহ্বা কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। এদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলা হলো, এরা ছিল কান্ডজ্ঞানহীন বক্তা। মুখে যা আসতো তাই বলতো। এই সমাজে ফেত্না সৃষ্টি করতো।
৬. তারপর একস্থানে একটি পাথর দেখা গেল, যার মধ্যে ছিল সামান্য ফাটল। তার মধ্য থেকে একটা মোটাসোটা বলদ বেরিয়ে এলো। পরে এর মধ্যে ঢুকতে চেয়ে পারল না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বলা হল, এটা হলো এমন দায়িত্বহীন ব্যক্তির দৃষ্টাস্ত যে ফেত্না সৃষ্টি করার মত উক্তি করে লজ্জিত হয়ে প্রতিকার করতে চায়, কিন্তু পারে না।
৭. এক স্থানে রাসুলুল্লাহ (সা.) দেখলেন, কিছু লোক তাদের নিজেদের গোশত কেটে কেটে খাচ্ছে। তাদের পরিচয় বলা হল, এরা অন্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা দোষারোপ ও কটূক্তি করতো।
৮. তাদের পাশেই এমন কিছু লোক ছিল, যাদের হাতে নক ছিল তামার তৈরি তা দিয়ে তারা তাদের মুখ ও বুক আঁচড়াচ্ছিল। এদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হল, এরা মানুষের অসাক্ষাতে তাদের নিন্দা চর্চা করতো। তাদের সম্মানে আঘাত করতো।
৯. কিছু লোকের ঠোট দেখা গেল উঠের ঠোঁটের মত এবং তারা আগুন খাচ্ছে। তাদের সম্পর্কে বলা হল, এরা ইয়াতিমের মাল সম্পদ ভক্ষন করতো।
১০. এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন কিছু লোক দেখতে পেলেন, যাদের পেট ছিল অসম্ভব বড়ো এবং বিষাক্ত সাপে পরিপূর্ণ। লোকজন তাদের দলিত মথিত করে তাদের ওপর দিয়ে যাতায়াত করছে। কিন্তু তারা কিছু করতে পারছে না। এদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হল এরা ছিল সুদখোর।
১১. এরপর আল্লাহর নবী এমন কিছু লোক দেখলেন, যাদের একদিকে রাখা ছিল ভাল গোশত। অপর দিকে রাখাছিল পচা দুর্গন্ধযুক্ত গোশত। তারা ভাল গোশত রেখে পঁচা গোশত খাচ্ছিল। তাদের পরিচয়ে বলা হল, এরা ছিল এমন লোক যারা নিজেদের হালাল স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অবৈধভাবে যেৌন বাসনা চরিতার্থ করতো।
১২. সেই সাথে এমন কিছু স্ত্রী লোক দেখলেন যারা তাদের স্তনের সাহায্যে লটকে ছিল। তাদের সম্পর্কে বলা হল যে, এরা ছিল এমন স্ত্রী লোক, যারা তাদের স্বামীর ঔরসজাত নয় এমন সস্তানকেও স্বামীর ঔরসজাত হিসেবে দাবি করতো।
এসব দৃশ্যাবলী পর্যবেক্ষণকালে নবী (সা.)-এর সাক্ষাৎ হয় এমন এক ফেরেশতার সাথে যাকে রুক্ষ এবং কাটখোট্টা মেজাজের মনে হচ্ছিল। নবী (সা.) জিব্রাইল (আ.)-এর জিজ্ঞেস করলেন এতক্ষণ যত ফেরেশতার সাথে দেখা হল, সবাইকে তো খোশ মেজাজে দেখলাম। ইনি এমন কেন? জিব্রাইল (আ.) বলেন এর হাসি-খুশির কোনো কারবার নেই। এ যে জাহান্নামের দারোগা। একথা শুনে আল্লাহর রাসুলুল্লাহ (সা.) জাহান্নাম দেখতে চাইলেন, তাৎক্ষণিকভাবে তার দৃষ্টির পথ থেকে পর্দা উঠিয়ে দেওয়া হলো এবং জাহান্নাম তার ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হলো।
সপ্ত আসমান অতিক্রম করে আরশে আজিম সফর
প্রথম আসমানে আদম (আ.)-এর সাথে সাক্ষাত্ হয়। আদম (আ.) নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে সাদর অভ্যর্থনা জানান। এ সময় গোটা নভোমন্ডল থেকে ধ্বনি উঠে মারহাবা মারহাবা। এ স্তর পার হয়ে তিনি দ্বিতীয় আসমানে পেৌছলেন। এখানে পরিচয় হল ইয়াহইয়া (আ.) ও ঈসা (আ.)-এর সাথে। তৃতীয় আসমানে ইউসুফ আ., চতুর্থ আসমানে ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে মুসা (আ.)-এর সাথে সাক্ষাত্ হলো। সপ্তম আসমানে পেৌছে একটি আজিমুশান মহল বায়তুল মামুর দেখলেন। এখানে অসংখ্য ফেরেশতা আসছিল-যাচ্ছিল। এখানে তার এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের সাথে সাক্ষাৎ হলো, যার সাথে তার সাদৃশ্য ছিল। পরিচয় জানতে পারলেন ইনি হলেন ইব্রাহিম (আ.)। এরপর আরো উপরে উঠতে শুরু করলেন। উঠতে উঠতে তিনি সিদরাতুল মুনতাহা পৌঁছে গেলেন। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, সিদরাতুল মুনতাহার কাছে। যার নিকট অবস্থিত বাসোদ্যান। (সুরা নাজম, আয়াত : ১৪, ১৫)
পরে তার জন্যে রফরফ চলে আসলো, সেখানে আরোহণ করে আরশে আজিমে রওয়ানা হলেন একাকি। তিনি উপরে উঠতে উঠতে এত উপরে উঠলেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, অর্থাৎ তখন সে ঊর্ধ্ব দিগন্তে। অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইলো অথবা তারও কম। (সুরা নাজম, আয়াত : ৭,৮,৯)
সেখানে তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে আরো অনেক কথা বলার সেৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। যেসব কথাবার্তা হয়েছিল আল্লাহ তাআলার সাথে তার দু-একটি তুলে ধরা হলো।
১. বান্দার শিরক ছাড়া অন্য যেকোন গুনাহ মাফ করে দেয়ার সম্ভাবনা প্রকাশ করা হয়েছে।
২. সুরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
৩. যে ব্যক্তি নেক কাজের ইচ্ছা প্রকাশ করে, তার জন্যে একটি নেকি লেখা হয়। আর যখন সে বাস্তবে আমল করে তখন ১০টি নেকি লেখা হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি পাপ কাজ করার ইচ্ছা করে তার বিরুদ্ধে কিছু লেখা হয় না। আর যখন সে তা বাস্তবে করে তখন তার জন্য একটি মাত্র পাপ লেখা হয়।
৪. প্রতিদিন ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয় যা পরবর্তীতে কমিয়ে ৫ ওয়াক্ত করা হয় এবং ঘোষণা দেয়া হয়। ‘মা ইউবাদ্দালুল কাওলু লাদায়্যা ওয়ামা আনা বিজল্লামিন লিল আবিদি’ অর্থাৎ হে নবী (সা.)! আমার মহান সত্বার পক্ষ থেকে কোন কথা পরিবর্তন করা হয় না এবং আমি আমার বান্দাদের ওপর বেশি কষ্ট দিতে চাই না। তাই আপনি এবং আপনার উম্মতকে দৈনিক পাচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে পাঁচ-এর পরিবর্তে ৫০ ওয়াক্তই লেখা হবে। যেমন মহান আল্লাহ সুরা আনআমে এ ইরশাদ করেছেন, ‘মান জাআ বিলহাসানাতি ফালাহু আশারা আমছালিহা।’
অর্থাৎ : হে নবী! যে আমার নৈকট্যের জন্য একটি নেকের কাজ করবে তার জন্য এক নেকির পরিবর্তে ১০ নেকি লেখা হবে। (সুবহানাল্লাহ)
আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ শেষ করে বিদায় নিয়ে চলে আসেন সিদরাতুল মুনতাহায়। সিদরাতুল মুনতাহা থেকে জিব্রাইল (আ.)সহ বোরাক যোগে বাইতুল মুকাদ্দাসে আসলেন। তারপর আবার বোরাকে আরোহণ করে মক্কায় চলে আসলেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে মেরাজ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক, বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরীন।