নিউজ ডেস্ক:
সাধারণত যারা রাজনৈতিক নেতা, সরকারের মন্ত্রী বা বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি হন, তারা সব শ্রেণীর জনমানব থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকেন। তারা এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে, তাদের দিকে মনোযোগ দেয়ার সময় সুযোগ ও মানসিক চিন্তাচেতনা কোনো কিছু থাকে না। তাদের ভাব-গম্ভীর চেহেরা দেখে কোনো সাধারণ মানুষ তাদের ধারে-কাছে যাওয়ার সাহস করেন না; কিন্তু রাসূলুল্লাহর সা: আকাশচুম্বী মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ও পৃথিবীর প্রবল স্রোত পরিবর্তনকারী বিশ্ববিজয়ী নেতা হয়েও তিনি সমাজের সর্বস্তরের জন-মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। কখনো একাকী, কখনো দলবদ্ধ অর্থাৎ স্থান, কাল ও পরিবেশ অনুযায়ী তিনি সর্বস্তরের জনগণের কাছে ছুটে যেতেন। এই যোগাযোগ ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ থেকে শুরু করে ছোট ছোট কোনো বিষয় বাদ যেত না। সমাজের নিম্নস্তর যেখানে সাধারণত কারো নজর পড়ে না, রাসূল সা: সেখানেও নির্দ্বিধায় পৌঁছে যেতেন। ইতিহাসের পাতায় অসংখ্য এ ধরনের যোগাযোগের উদাহরণ রয়েছে।
রাসূল সা.-এর যোগাযোগের রীতি
রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে যার দেখা হতো তিনি প্রথমে সালাম দিতেন। কাউকে খবর দিলে সালাম পাঠাতে ভুলতেন না। কেউ সালাম পৌঁছালে সালামের প্রেরক ও বাহক উভয়কে পৃথকভাবে সালাম দিতেন। শিশু, মহিলা, বন্ধু-বান্ধব ও পরিবার-পরিজন সবাইকে সালাম দিতেন। সবার সাথে হাত মেলাতেন. আলিঙ্গন করতেন।
কোনো অবাঞ্ছিত লোক তার কাছে এলে হাসিমুখে তাকে স্বাগত জানাতেন। একবার এমন এক ব্যক্তি তার কাছে এলো, যাকে তিনি সংশ্লিষ্ট গোত্রের নিকৃষ্টতম ব্যক্তি বলে জানতেন। কিন্তু তিনি তার সাথে মনোযোগের সাথে অমায়িকভাবে কথাবার্তা বললেন। এটা দেখে হজরত আয়েশা রা: বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘আল্লাহর কসম যে ব্যক্তির দুর্ব্যবহারের ভয়ে লোকেরা তার সাথে মেলামেশাই বন্ধ করে দেয়, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি বলে গণ্য হবে।’
কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে দরজার ডান বা বাম দিকে একটু সরে গিয়ে নিজের উপস্থিতির জানান দিতেন। ভেতরে প্রবেশের অনুমতির জন্য তিনবার সালাম দিতেন। সালামের উত্তর না পেলে কোনো প্রকার বিরক্তি ছাড়াই ফিরে যেতেন। রাতে সাক্ষাতে গেলে এমন আওয়াজে সালাম দিতেন যাতে সজাগ থাকলে শুনতে পায় আর ঘুমিয়ে থাকলে যাতে তার ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। কেউ ডাক দিলে ‘লাব্বাইক’ বলে ডাক শুনতেন। খারাপ ব্যবহারের উত্তর তিনি খারাপ ব্যবহারের মাধ্যমে দিতেন না। বরং তিনি ক্ষমা করতেন। অন্যদের অপরাধ ক্ষমার প্রতীক হিসেবে তিনি তাদের জন্য উপহার পাঠাতেন।
তিনি রোগী দেখতে যেতেন। শিয়রে বসে জিজ্ঞেস করতেন, তুমি কেমন আছো? কপালে ও ধমনীতে হাত রাখতেন। কখনোবা বুকে পেটে ও মুখমণ্ডলে স্নেহে হাত বুলাতেন। সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলতেন, ‘ চিন্তার কোনো কারণ নেই, ইনশাআল্লাহ অচিরেই তুমি রোগমুক্ত হবে। রোগমুক্তির জন্য দোয়া করতেন। হজরত সাদের জন্য তিনবার দোয়া করেছিলেন। মোশরেক চাচাদেরও রোগব্যাধি হলে দেখতে যেতেন। একজন ইহুদি শিশুকে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন (শিশুটি পরে ঈমান এনেছিল)।
প্রবাস থেকে ফিরে কেউ সাক্ষাতে এলে আলিঙ্গন করতেন, কখনো কখনো কপালে চুমু দিতেন। প্রবাসে যাওয়ার সময় তাকে অনুরোধ করতেন : দোয়া করার সময় আমাদের কথা মনে রেখ। স্নেহ ও ভালোবাসার আতিশয্যে কারো কারো সাথে এতটাই অমায়িক হয়ে যেতেন যে, তাদের সংক্ষেপ নামে ডাকতেন।
শিশুদের প্রতি ছিল তাঁর অত্যধিক দুর্বলতা। তাদের কাছে পেলে কোলে তুলে নিতেন, তার মাথায় হাত বুলাতেন, আদর করতেন, দোয়া করতেন। শিশুদের মন ভুলানোর জন্য চমক লাগানো কথা বলতেন। যেমন বলতেন, ‘টিকটিকিরা ভাই রাতে মশার চোখে ঘা মারে দাঁতে।’ একবার এক শিশুকে চুমু খেতে খেতে বলেছিলেন : শিশুরা আল্লাহর বাগানের ফুল। শিশুদের নাম রাখতেন। কখনো কখনো শিশুদের লাইনে দাঁড় করিয়ে পুরস্কারের ভিত্তিতে দৌড়ের প্রতিযোগিতা করাতেন যে, দেখব কে আগে আমাকে ছুঁতে পারে। শিশুরা দৌড়ে আসত, কেউ তার পেটের ওপর, কেউ বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ত। তাদের সাথে হাসি তামাশা করতেন। যেমন হজরত আনাসকে কখনো কখনো বলতেন, ‘ও দুই কান ওয়ালা!’
বুড়োদের তিনি খুবই শ্রদ্ধা করতেন। মক্কা বিজয়ের সময় হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা: নিজের অন্ধ প্রবীণ পিতাকে ইসলাম গ্রহণের জন্য যখন রাসূল সা:-এর কাছে নিয়ে এলেন, তখন তিনি বললেন : ওঁকে কষ্ট দিয়েছ কেন? আমি নিজেই তাঁর কাছে চলে যেতাম।
তিনি বিভিন্ন আলাপ আলোচনায়ও অংশগ্রহণ করতেন। চাই তা দুনিয়াবি হোক বা আখিরাত কেন্দ্রিক। এমনকি খানা-পিনার আলোচনায়ও অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও রাসূল সা: কসম খেয়ে বলেছেন, আমার মুখ দিয়ে সত্য কথা ও ন্যায্য কথা ছাড়া আর কিছুই বের হয়নি। কুরআন সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, ‘তিনি মনগড়া কিছু বলেন না।’ উম্মে মাবাদ তাঁর প্রশংসায় বলেছেন, তাঁর কথা যেন মুক্তোর মতো। প্রয়োজনের চেয়ে কথা বেশিও বলতেন না, কমও বলতেন না। অশোভন, অশ্লীল ও নিলর্জ্জ ধরনের কথাবার্তাকে ঘৃণা করতেন। কথাবার্তার সাথে সাধারণত একটি মুচকি হাসি উপহার দিতেন।