নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বিজয়া দশমী ও প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। ঘট-দর্পণ বিসর্জনের পর গতকাল রবিবার বিকালে বিদায় জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। বিকেল ৪টা থেকে শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জন। এর আগে চুয়াডাঙ্গার সবকটি মণ্ডপে সিঁদূর খেলা ও দেবী দর্শন করেন ভক্ত-অনুরাগীরা। আনন্দ আয়োজনের মধ্যেই বিদায়ের করুণ সুর বাজতে থাকে মন্দিরে মন্দিরে। চোখের জলে পূজার্থীদের ছলছল মলিন চেহারায় ‘সামনে বছর আবার হবে’- এমন আত্মবিশ্বাস ফুটে ওঠে।। বিসর্জন উপলক্ষে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, র্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও আনসার সদস্যসহ স্বেচ্ছাসেবকরা ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহন করে।
গতকাল দুপুরের পর থেকে বিভিন্ন মন্দির থেকে বের করা হয় বর্ণাঢ্য বিজয়া শোভাযাত্রা। বিজয়া শোভাযাত্রা ও প্রতিমা বিসর্জনে অংশ নিতে বিকেল গড়াতেই ভক্তরা পূজামণ্ডপ থেকে ট্রাক, আলমসাধু ও ভ্যানযোগে প্রতিমা নিয়ে সমবেত হতে শুরু করেন মাথাভাঙ্গা নদীর পাড়ে। রাস্তায় রাস্তায় সতর্কাবস্থায় ছিল পুলিশ, র্যাব, ফায়ার সার্ভিস, আনসার সদস্য ও সাদা পোষাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। রাস্তার পাশে দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
শহরের বড় বাজারের সার্বজনীন দুর্গা মন্দিরের প্রতীমা বিসর্জন দেয়া হয় মাষ্টার পাড়ার শিশু পার্কের পিছনের মাথাভাঙ্গা নদীতে। বাকি মন্দিরের প্রতীমা নেয়া হয় মাথাভাঙ্গা ব্রীজের নিচে। সন্ধ্যা নাগাদ চলে দুর্গতিনাশিনীর বিদায় আচার।
প্রথা অনুযায়ী প্রতিমা বিসর্জনের পর সেখান থেকে শান্তিজল মঙ্গলঘটে নিয়ে তা আবার হৃদয়ে ধারণ করা হয়। আগামী বছর আবার এ শান্তিজল হৃদয় থেকে ঘটে, ঘট থেকে প্রতিমায় রেখে পূজা করা হবে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মানুষের মনের আসুরিক প্রবৃত্তি, কাম, ক্রোধ, হিংসা, লালসা বিসর্জন দেওয়াই মূলত বিজয়া দশমীর মূল তাৎপর্য। এ প্রবৃত্তিগুলোকে বিসর্জন দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই এ আয়োজনের উদ্দেশ্য।
চণ্ডীপাঠ, বোধন ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে ষষ্ঠী তিথিতে “আনন্দময়ীর” আগমনে গত ৯ অক্টোবর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। পরবর্তী ৫ দিন চুয়াডাঙ্গা জেলাজুড়ে পূজামণ্ডপগুলোতে পূজা-অর্চনার মধ্যদিয়ে ভক্তরা দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে উৎসবের শেষ হয়।
এ বছর দেবী দুর্গার আগমন হয় দোলায় বা পালকিতে। দেবীর এই আগমনের ফলাফল হবে মড়ক। যা শুভ ইঙ্গিত নয়। এছাড়াও দেবী স্বর্গে গমন করবেন ঘোটকে বা ঘোড়ায়। শাস্ত্রমতে দেবীর গমন বা আগমন ঘোটকে হলে ফলাফল ছত্রভঙ্গ হয়। শাস্ত্রমতে এই ঘোটকে গমনের ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খল অবস্থাকে ইঙ্গিত করে। এটি যুদ্ধ, বিগ্রহ, অশান্তি, বিপ্লবের ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবী ফিরে যান স্বর্গলোকের কৈলাসে স্বামীর ঘরে। পরের বছর শরতে আবার তিনি আসবেন এই ধরণীতে যা তার বাবার গৃহ।
চুয়াডাঙ্গায় এ বছর ১০৪টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এসব মণ্ডপে শারদীয় উৎসব নির্বিঘ্নে উদযাপন করার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি পূজা উদযাপন কমিটিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। প্রতিটি মণ্ডপে মণ্ডপে লাগানো হয় সিসিটিভি ক্যামেরা এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি করা হয় মণ্ডপ পাহারার জন্য।
দর্শনা :
কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে গতকাল রবিবার বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সব থেকে বড় উৎসব দুর্গা পূজা। দর্শনা পৌরসভার ৫টি ও পারকৃষ্ণপুরের ১টি সহ মোট ৬টি পূজা মন্ডপে লাইট আর ভিন্ন রকম আবহে জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বড় উৎসব শারদীয় দুর্গা পূজা সম্পন্ন হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে প্রতি বছর দর্শনা কেরুজ পূজা মন্দির, আমতলা পূজা মন্দির, পুরাতন বাজার পূজা মন্দির, রামনগর দাসপাড়া পূজা মন্দির, রামনগর মুচিপাড়া পূজা মন্দির ও পারকৃষ্ণপুর হালদার পাড়া পূজা মন্দিরে তাদের এই উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও তারা এই উৎসব শেষ করে দর্শনা মেমনগরে মাথাভাঙ্গা নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে সমাপ্তি করে। এসময় সূধীজনদের উপস্থিতিতে ও দর্শনা থানা পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, আনসার বাহিনীসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শেষ হয় দশমী অর্থাৎ প্রতিমা বিসর্জন। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল বেশ কঠোর।
এ বিষয়ে দর্শনা থানার ওসি তিতুমীর বলেন, আমরা সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছি। আমাদের সঙ্গে সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস এবং আনসার বাহিনীর সদস্যরাও যুক্ত আছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে দিয়ে প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ দামুড়হুদা উপজেলার সভাপতি উত্তম রঞ্জন দেবনাথ বলেন, আমরা প্রতিবছর চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনায় মাথাভাঙ্গা নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে থাকি। এবারও আমরা একই জায়গায় প্রতিমা বিসর্জন দিয়েছি। অন্যন্য বছরের তুলনায় এ বছর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল বেশ কঠোর। আমাদের অনুষ্ঠানটি খুব সুন্দরভাবে সম্পূর্ণ করতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত। এসময় প্রতিমা বিসর্জনের স্থানে হাজার হাজার মানুষের জনসমাগম ছিলো।
জীবননগর :
গতকাল রবিবার জীবননগরের ২৫টি মণ্ডপে শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন হয়েছে। সকাল থেকে মণ্ডপে মণ্ডপে শুরু হয়েছে সিঁদুর খেলা। এরপর আরতি, শোভাযাত্রাসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।
গত ৯ অক্টোবর বুধবার ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয়, মহানবমীতে শনিবারই পূজা শেষ হয়।
রোববার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এবছরের পূজার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। প্রতিবছরের মতো এবারও এ উপজেলায় শান্তিপূর্ণভাবে দেবী দুর্গা বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। বিকাল থেকে পৌর শহরের পদ্মাগঙ্গা বিলে ও উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের মণ্ডপ থেকে নিজ নিজ এলাকার বিল-খালে প্রতিমা বির্সজন দেওয়া হয়। দেবী দুর্গা বিদায়ের ক্ষণে বিভিন্ন মন্ডপে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ছিল উপচে পড়া ভিড়। উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণ ভাবে বিসর্জন সম্পন্ন হওয়ায় দুর্গাপূজা উদযাপন কমিটির সদস্যরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।