পুরুষের সমান কাজ করেও কম মজুরি পাই আমরা। একসঙ্গেই কাজে আসি। দিনশেষে পুরুষরা মজুরি পায় ৫শ থেকে ৬শ টাকা আর আমরা পাই ৩শ। কাজ তো আর কম করি না। সংসারে আমার আর কেউ কামাই রোজগার করে না, পাঁচজন খাওয়ার মানুষ। দিন চলা খুব জুলুম। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের ছোট গজনীর কৃষি শ্রমিক মালতী কোচ।
শুধু মালতী-ই নন। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে চাতাল মিল, ইট ভাটা, বন্দরে পাথর ভাঙ্গা, হোটেলে রান্নায় সহায়তা, হিমাগারে আলু বাছাই, নার্সারিতে মাটির কাজসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিকের কাজ করেন এমন অংসখ্য নারী। পরিবারের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন খাতে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন শেরপুরের নারী শ্রমিকরা। কিন্তু একজন পুরুষ শ্রমিকের সমান কাজ করেও সমান বেতন পান না তারা। দিনভর হাড়-ভাঙা খাটুনির পর যে মজুরি পান তা দিয়ে সংসার চালানো দায়। দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অথবা এনজিও থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে চলতে হয় তাদের। বছরের পর বছর এভাবে চললেও মজুরির কোন পরিবর্তন হয় না। তাই নারী নেত্রীরা দাবি তুলেছেন, নারীর অধিকার, মজুরিসহ নানা বিষয়ে সমঅধিকার নিশ্চিতের।
নারী শ্রমিকরা বলছেন, একই সময়ে কাজে এসে পুরুষের পরে কাজ থেকে ফিরলেও তারা মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। পুরুষেরা যেখানে ৫শ থেকে ৬শ পান, সেখানে দিন-রাত পরিশ্রম করেও নারীরা পান আড়াইশ থেকে ৩শ টাকা। অথচ সমান কাজ করেন তারা। সময়ও সমান দিতে হয় তাদের।
চাতাল মিলের শ্রমিক হুজুরা বানু (৪২) বলেন, ‘যেসময় মানুষ ঘর থেকে ছাতা ছাড়া বের হতে পারে না, তখন কাঠফাটা রোদে আমরা ধানের খলায় ধান শুকাই। আবার মেঘের দিন হলে এক কাপড়েই ভিজি, ওই কাপড়েই শুকাই। সকালে আটটা, নয়টার দিকে আসি আর ফিরি সন্ধ্যার আগে। এত কষ্ট করেও টাকা পাই আড়াইশ। আর পুরুষরা পায় ডাবল সাড়ে ৪শ থেকে ৫শ টাকা।
চাতাল মিলের আরেক শ্রমিক জোসনা বেগম বলেন, আমি কুড়া ঝাড়ি। সারাদিনে মাইনা পাই আড়াইশ’ ট্যাহা। আর একই সময় এসে পুরুষ পায় ৫শ টাকা।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চাতাল মালিক বলেন, জেলার প্রায় সবগুলো চাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা যারা দু-একটা চালাচ্ছি তাও লোকসানে। এখন শ্রমিকদের মাইনে কেমনে বাড়াবো। আর কোনও ব্যবসা জানা নেই, তাই লোকসানেও কোনোমতে ধরে রেখেছি।
একই পরিস্থিতি ইটভাটাগুলোতেও। যেখানে নারীরা পান সপ্তাহে খুব বেশি হলে ১৫ শ’ থেকে দুই হাজার টাকা। আর পুরুষদের অগ্রীম টাকা দিয়ে কাজে আনা হয়। বেতন কম, এ নিয়ে সরদারকে অভিযোগ জানালে কাজ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয় বলেও জানান নারী শ্রমিকরা।
নার্সারিতে কাজ করেন শিউলি বেগম জানান, প্রতিদিন প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে কাজে আসেন তিনি। সকাল ৮টায় কাজে এসে যেতে হয় বেলা ডোবার সময়। সারাদিন মাটি কাটেন, মাটি ঝুড়িতে তুলে দেন আবার মাথায় করে মাটি বহনও করতে হয়। মজুরি পান ৩শ’ টাকা, যা দিয়ে তার সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আর সাথে পুরুষ শ্রমিকরা একই সময়ে কাজে এসে মজুরি পান ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা।
ঝিনাইগাতীর ছোট গজনী এলাকার কৃষি শান্তি রানি, মালিনী কোচ, পল্লবী রেমা, সেলচি সাংমা বলেন, আমরা কোনওভাবেই পুরুষের চেয়ে কাজ কম করি না। পুরুষের সমান সমানই কাজ করি। পুরুষদের মতোই আমরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করি। কিন্তু এরপরও আমাদের মজুরি পুরুষের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
সৃষ্টি হিউম্যান রাইটস সোসাইটির চেয়ারম্যান আনোয়ার-ই- তাসলিমা বলেন, অনেক জায়গায় এখনও নারী-পুরুষদের বেতন নিয়ে অসমতা দূর হয়নি। বছরের পর বছর অসমতার শিকার হচ্ছেন তারা। নারী শ্রমিকরা তাদের অধিকার সম্পর্কে কম সচেতন হওয়ায় তাদের দিয়ে কর্তৃপক্ষ সহজেই বেশি কাজ আদায় করে নিতে পারেন। কিন্তু নারীর শ্রম পুরুষের চেয়ে কম না হলেও তাদের বেতনের অসমতা চোখে পড়ার মতো। আর এ ধরণের মানসিকতা থেকে সমাজ মুক্তি পাক। পাশাপাশি সমাজে নারী ও পুরুষের মজুরির অসমতা দূর করে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হোক বলেও দাবি জানান তিনি।
জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা লুৎফুল কবীর বলেন, পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকের মজুরি অর্ধেক হওয়া সত্যি দুঃখজনক। সরকারি কোন দফতরে বেতনে অসমতা নেই, তবে ব্যক্তি মালিকানায় এ বৈষম্য রয়েছে। এই বৈষম্য নিরসনে সচেতনতামূলক সভাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছি। সবার সহযোগিতায় এই অসমতা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।