স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)’-এ প্রায় ২ মাস আগে নয়নের সকল তথ্য ভেরিফাইড করা হয়েছিল। নয়নের প্রতারণায় বিভ্রান্ত হয়ে সিভিল সার্জন অফিসও এমআইএস-এ তার নাম প্রকৃত আহত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। তবে, জুলাই ফাউন্ডেশনের ভেরিফিকেশন সেলের তৎপরতায় এই প্রতারক ধরা পড়ে।
জুলাই অভ্যুত্থানে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে বর্বরতা চালানো হয়, যেখানে ফ্যাসিবাদী সরকারের বাহিনীর গুলির মুখে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময় সহস্রাধিক মানুষ প্রাণ হারান এবং ২২ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন। শহীদ পরিবার এবং আহতদের সহায়তায় গঠন করা হয় জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশন, যা সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। এই ফাউন্ডেশন শহীদ পরিবারদের অর্থ সহায়তা ও আহতদের চিকিৎসা খরচ প্রদান করছে। তবে, মানবিক কাজের এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার একটি চক্র সক্রিয় হয়েছে। এখনও পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন ভুয়া তথ্য দিয়ে ফাউন্ডেশন থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের শনাক্ত করে ইতোমধ্যে অর্থ ফেরত চাওয়া হয়েছে এবং তিনজনের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে। এই তিনজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে, বাড়িতে মারামারি করে আহত হওয়া কিংবা স্বামী-স্ত্রীর মারামারিতে আহত হওয়ার পরেও ফাউন্ডেশন থেকে সাহায্য নেওয়ার ঘটনা ধরা পড়েছে তাদের যাচাইয়ের মাধ্যমে।
রুনা আক্তার নামের একজন নারী ফাউন্ডেশনে এসে আন্দোলনে আহতদের তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করেন। তিনি পারিবারিক ঝগড়ায় ঠোঁট ফেটে গিয়ে আহত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন এবং ওই চিকিৎসা সনদ নিয়ে আন্দোলনে আহত হওয়ার দাবি করেন। তবে, ফাউন্ডেশন তার আবেদন যাচাই করে সত্যতা না পেয়ে তাকে কোনো সহায়তা দেয়নি।
যেহেতু বেলাল একটি পা হারিয়েছেন এবং আর্থিকভাবে তেমন সচ্ছল নন, ফাউন্ডেশন মানবিক কারণে তার নামে প্রতারণার মামলা দায়ের না করলেও, টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য তাকে মুচলেকা দিতে হয়েছে।
জুনায়েদ নামের এক প্রতারক দেশের বিভিন্ন স্থানে আহতদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রলোভন দেখাত। তিনি আহতদের নানা মিথ্যা তথ্য দিয়ে বলতেন, ‘ইতিমধ্যে জুলাই ফাউন্ডেশনের বরাদ্দকৃত টাকা দেওয়া শেষ। যেহেতু আপনারা এখনও এমআইএস-এ নাম অন্তর্ভুক্তি করেননি, আপনি আর টাকা পাবেন না। তবে আমার কাছে লোক আছে, আমি আপনার নাম এমআইএস-এ যোগ করে দেবো, বিনিময়ে ফাউন্ডেশন থেকে পাওয়া টাকার অর্ধেক আমাকে দিতে হবে।’ এর মাধ্যমে সে সফলও হয়েছিল। পঙ্গু হাসপাতালের এক আহতের বাবার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে নেয় সে। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জুনায়েদকে ফাউন্ডেশনের অফিসে ডেকে আনা হয়। জুনায়েদ তার অপরাধ স্বীকার করলে ফাউন্ডেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়ের করা মামলায় তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
জুলাই ফাউন্ডেশনের ভেরিফিকেশন সেলের সমন্বয়ক সাইদুর রহমান শাহীদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা জুলাই আন্দোলনের প্রকৃত আহতদের সেবা দিতে কাজ করে যাচ্ছি। আহতদের নাম তালিকাভুক্তির জন্য আমরা মূলত মেডিকেল সার্টিফিকেটগুলো বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা করি। এছাড়া, আহত ব্যক্তি কখন আন্দোলনে গিয়েছিল, কীভাবে আহত হয়েছিল এবং তার দেয়া তথ্য বিভিন্নভাবে যাচাই করি। আমরা স্থানীয় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করে তারপর আহতদের নাম তালিকাভুক্ত করি। তবে পঙ্গু হাসপাতালে একসঙ্গে অনেক লোক ভর্তি থাকায় কিছু ভুয়া ব্যক্তি আহত সেজে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে। তবে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসব ভুয়া আহতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
প্রতারণার মাধ্যমে আহত সেজে টাকা নেয়ার গুরুতর অভিযোগে জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে রাজধানীর রমনা থানায় দায়ের করা ২টি মামলায় ৩ জন জেলহাজতে আছেন। প্রায় ৫০ জনের অধিক প্রতারক ফাউন্ডেশনের কাছে মুচলেকা দিয়ে টাকা ফেরত দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। যদি তারা সময়মতো টাকা না দেয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
এছাড়া, যেসব আহত কিংবা নিহতদের পরিবারের সদস্য এককভাবে বরাদ্দকৃত টাকা তুলে নিয়েছে এবং অন্য অংশীদারদের বঞ্চিত করেছে, তাদের নোটিশের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানানো হয়েছে। যদি তা কার্যকর না হয়, তবে পরবর্তীতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জুলাই ফাউন্ডেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন তিনটি উইংয়ে কাজ করছে। যদি কেউ ভুল তথ্য দিয়ে ফাউন্ডেশন থেকে টাকা নিয়ে নেয় অথবা নেয়ার চেষ্টা করে, আমরা তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’