পবিত্র কোরআনে বর্ণিত ঘটনাবলীর অন্যতম লোকমান হাকিম (রহ.)-এর ঘটনা বিশেষ তাত্পর্য বহন করে। কেননা এতে একজন পিতার ভাষ্যে পুত্রকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। পিতা কর্তৃক পুত্রকে উপদেশ দেওয়া একটি চিরায়ত বিষয়। সৃষ্টির সূচনা থেকেই পিতারা শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে পুত্রদেরকে আগামীর জন্য প্রস্তুত করেন। কোরআনে বর্ণিত পিতা-পুত্রের এই কথোপকথনে ধর্মীয় ও পার্থিব শিক্ষার অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। যা আদর্শ জীবন গঠনে অপরিহার্য।
লোকমান (রহ.) ও তাঁর প্রজ্ঞা
বিশুদ্ধ মতানুসারে লোকমান (রহ.) আল্লাহর নবী ছিলেন না, বরং একজন প্রজ্ঞাবান নেককার মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে পাণ্ডিত্য দান করেছিলেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি লোকমানকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা।’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১২)
মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ‘প্রজ্ঞা হলো সত্য চেনা ও সে অনুসারে আমল করা, কথা ও কাজে সঠিক হওয়া।’ আর আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, যথা সময়ে, যথা পদ্ধতিতে যথাযথ কাজটি করাকে হিকমাহ বলে। (মাদারিজুস সালিকিন : ৩/২৯৪)
ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার সমন্বয়
লোকমান (রহ.) তাঁর সন্তানকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তাকে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ নিহিত ছিল। তিনি এমন উপদেশ দিয়েছিলেন যাতে মানুষের পরকালীন জীবনের মতো পার্থিব জীবনও সুন্দর হয়। যেমন—
১. শিরক না করা : ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ কোরো, যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলেছিল, হে ছেলে! আল্লাহর কোনো শরিক কোরো না। নিশ্চয়ই শিরক চরম জুলুম।’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৩)
শিরকমুক্ত জীবনের সুফল হলো দুনিয়া ও আখেরাতে উত্তম জীবন লাভ করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সত্কাজ করবে তাকে আমি নিশ্চয়ই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কাজের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৯৭)
২. মা-বাবার সঙ্গে সদাচার : ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। …আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন আমারই কাছে।’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৪)
পূর্বের আয়াতে শিরক না করার যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাতে যেমন পরকালীন কল্যাণ প্রত্যক্ষ ছিল এবং ইহকালীন কল্যাণ পরোক্ষ ছিল। আলোচ্য আয়াতে ইহকালীন কল্যাণ প্রত্যক্ষ এবং এর পরকালীন কল্যাণ পরোক্ষ। ইহকালীন কল্যাণ হলো পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা। পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনে ধৈর্য্য, আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতার তালিম দেওয়া।
৩. মুমিন পরকালকেই প্রাধান্য দেবে : ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সমকক্ষ দাঁড় করাতে যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মেনো না, তবে পৃথিবীতে তাদের সঙ্গে বসবাস করবে সদ্ভাবে।…’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৫)
আল্লাহর আনুগত্যই মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি ও সাফল্য নিশ্চিত করতে পারে। তাই মানুষ কখনো আল্লাহর অবাধ্য হয়ে মানুষের আনুগত্য করবে না। আবার আনুগত্য পরিহারের সময় এমন আচরণ করবে না পার্থিব শিষ্টাচার ও শৃঙ্খলার পরিপন্থী।
৪. আল্লাহকে ভয় করা : ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বত্স! ক্ষুদ্র বস্তুটি যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা যদি থাকে শিলাগর্ভে অথবা আকাশে বা মাটির নিচে, আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবগত।’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৬)
আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর কুদরত ও ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার মাধ্যমে বান্দার অন্তরে তাঁর ভয় জাগ্রত করেছেন। আর আল্লাহর ভয় মানুষকে অন্যায়, অপরাধ ও পাপ থেকে বিরত রাখার মক্ষম উপায়।
৫. শিষ্টের লালন, দুষ্টের দমন : ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ছেলে! নামাজ কায়েম কোরো, সত্কাজের নির্দেশ দাও আর অসৎ কাজ থেকে নিষেধ কোরো এবং বিপদে ধৈর্যধারণ কোরো। এটাই দৃঢ়সংকল্পের কাজ।’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৬)
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ সমাজ ও সভ্যতা রক্ষার কয়েকটি চাবিকাঠি বর্ণনা করেছেন। কেননা সত্কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধের ওপর শুধু সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিহিত নয়, বরং এর ওপর মানুষের ধর্মীয় জীবনের নিরাপত্তা এখানে নিহিত। কেননা সমাজে অন্যায়ের প্রসার ঘটলে মানুষ সবদিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একইভাবে ধৈর্য্য ইহকাল ও পরকাল উভয়ে জগতের কল্যাণ নিশ্চিত করে।
৬. ব্যক্তিগত জীবনের শিষ্টাচার : ইরশাদ হয়েছে, ‘অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কোরো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ কোরো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো উদ্ধত, অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। তুমি পদক্ষেপ কোরো সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু কোরো; নিশ্চয়ই সুরের মধ্যে গাধার সুরই সবচেয়ে অপ্রীতিকর।’ (সুরা লোকমান, আয়াত : ১৮-১৯)
আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তাআলা দৈনন্দিন জীবনের কয়েকটি শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন। যার মূলত কথা জীবনে বিনয়ী ও নম্র হওয়া। আর মুমিন যখন আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বন করে। তখন আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তাঁর মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লহার জন্য বিনয় অবলম্বন করবে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৮)
লোকমান (রহ.) অনুসরণীয়
মহান আল্লাহ লোকমান (রহ.)-এর বর্ণনা অনর্থক দেননি, বরং তিনি শিশু ও সন্তানের শিক্ষাদানে লোকমান (রহ.)-কে পরবর্তী মানুষের জন্য অনুসরণীয় করেছেন। তিনি তাঁকে জ্ঞান নামক কল্যাণ দান করেছিলেন। আর ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমত প্রদান করেন। আর যাকে হিকমত প্রদান করা হয় তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়। এবং বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল শিক্ষা গ্রহণ করে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৬৯)
আল্লাহ সবাইকে দ্বিনের সঠিক জ্ঞান দান করুন। আমিন।