নিউজ ডেস্ক:
নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে এক মাসের মধ্যে ৩১টি রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এখন তিনি কী সিদ্ধান্ত দেন, সেদিকেই তাকিয়ে আছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোসহ সাধারণ জনগণ।
অতীতে ইসি গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ এবং মতানৈক্যের কারণে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত মেনে নেবে বলে জানালেও বিএনপি হুমকি দিয়ে রেখেছে, সার্চ কমিটিতে নিরপেক্ষ লোক না এলে এবং ইসি গঠন ‘দলীয় অনুগত’দের দিয়ে হলে তা মানবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী যদি নির্বাচন কমিশন গঠন না হয়, তাহলে বোঝা যাবে যে, এই সরকার আগের খেলায় রয়েছে। সরকারের ওই রকম খায়েশ থাকলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আমরা রাস্তায় নামব। আমরা দেখতে চাই যে, মহামান্য রাষ্ট্রপতি কী করেন?’
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, পাঁচ বছর মেয়াদি নির্বাচন কমিশন গঠনের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, “প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন।”
সংবিধানের আলোকে সেই আইন এখন পর্যন্ত না হওয়ায় প্রতিবারই নির্বাচন কমিশন গঠনে জটিলতা দেখা দেয়। গতবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সার্চ কমিটি গঠনের একটি পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। এবারও একইভাবে সংলাপের আয়োজন করে ইসি গঠন করতে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে শেষ হচ্ছে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। নতুন যে নির্বাচন কমিশন হবে তাদের অধীনেই হবে একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
নতুন ইসি গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিতে গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে বঙ্গভবনে আলোচনা শুরু করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। এই সংলাপে প্রথম দফায় ২৩টি দলের সঙ্গে আলোচনা করেন তিনি। এই পর্বে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), সাম্যবাদী দল, বিকল্পধারা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), জাসদ (আম্বিয়া), বাসদ, ইসলামী আন্দোলন, গণতন্ত্রী পার্টি, গণফোরাম, খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
দ্বিতীয় পর্বে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, গণফ্রন্ট, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) ও জাকের পার্টি- এই আটটি দলের সঙ্গে সংলাপ করেন রাষ্ট্রপতি।
বুধবার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষ করেন রাষ্ট্রপতি। এখন দলগুলোর প্রস্তাব ও সুপারিশ পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি।
রাষ্ট্রপতির পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে তার প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন জানান, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপ শেষ করেছেন। এখন তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া প্রস্তাব ও সুপারিশ পর্যালোচনা করবেন। এরপরে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে উদ্যোগ নেবেন।
এদিকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনাকালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চার দফা প্রস্তাব ও ১১টি সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। আর বিএনপি আলোচনা সাপেক্ষে ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের ১৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনার হতে পারেন এমন ১০ সদস্যের নাম প্রস্তাবের পাশাপাশি সার্চ কমিটিতে কারা থাকবেন, তাদের নামও রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়েছে দলটি। এতে প্রাক্তন বিচারপতি ও শিক্ষাবিদদের প্রাধান্য রয়েছে বলে দলটির সূত্র জানিয়েছে। ইসিতে একজন নারী সদস্য নিয়োগেরও প্রস্তাব এবং নির্বাচনকালীন একটি ‘সহায়ক সরকার’ গঠনের দাবিও তুলেছে বিএনপি।
অন্যদিকে ইসি গঠনের আইন প্রণয়নসহ পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠনে সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরে। রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত আইন তৈরি ও সে অনুযায়ী সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে। সংলাপে নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়ন করে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব ও হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন, শক্তিশালী ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম।
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা সাত দফা প্রস্তাব দিয়েছে। ইসি গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আইন প্রণয়নসহ ১৭ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছে কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)।
তবে বর্তমান সংসদের অধীনে নতুন ইসি গঠনের আইন করার বিষয়ে বিরোধিতা করেছে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার আগে ‘সংবিধানের শর্ত মোতাবেক’ পার্লামেন্টে এ বিষয়ে স্থায়ী একটি আইন পাস করার কথা বলেছে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা বিবেচনা করে নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার চাইছেন জেএসডির নেতারা।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া, নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) নিবন্ধিত সব দলের একজন করে প্রতিনিধি এবং অনিবন্ধিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দলের ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতিনিধি এবং আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির সমন্বয়ে সার্চ বা সিলেক্ট কমিটি গঠনসহ পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছে।
এছাড়া অন্য দলগুলো ইসি গঠনে একটি স্থায়ী আইন, নিরপেক্ষ কমিশন গঠন, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, নারী কমিশনার নিয়োগসহ নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণে বেশকিছু প্রস্তাব ও সুপারিশ তুলে ধরেছে।
ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এটিএম শামসুল হুদা বলেন, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি খুবই ভালো কাজ করছেন। অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। জাতি কৃতজ্ঞ থাকবে যদি উনি ভালো কমিশন দিতে পারেন।’
তিনি বলেন, ‘কমিশনারদের ব্যাকগ্রাউন্ড খুব ইমপর্টেন্ট। তারা দলের কি না, অফিস বেয়ারার ছিলেন কি না, কোনো সময় নির্বাচন করেছেন কি না- এগুলো দেখতে হবে।’
ইসি গঠনে আইন করার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে শামসুল হুদা বলেন, ‘এখন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ডায়ালগ (গোলটেবিল আলোচনা) করার সময় নেই। একটা (আইন) করতে হবে, পরে দেখা যাবে সেখানে কী নেই। আগে একটা আসুক। তার পর সময় হবে… দেখা যাবে।’
প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন কমিশনের বদলে কমিশন গঠনের সার্চ কমিটির আকার বড় করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘সার্চ কমিটি এনলার্জ করা উচিত, ৩-৪ জন নয়। তাহলে এটা আরো ট্রান্সপারেন্ট হবে।’
এদিকে বিএনপি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করলেও দলটির সন্দেহ, নতুন যে নির্বাচন কমিশন গঠন হবে সেখানে সরকারের হস্তক্ষেপ ঘটবে। তবে দলটি চাইছে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ইসি গঠনে ঐকমত্য।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে সরকারি দল আলোচনা করতে চায় না। তাহলে রাষ্ট্রপতি ডাকলেন কেন? এর মধ্যে কোনো ছলচাতুরী আছে কি না জানি না।’
‘তবে আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে, আন্তরিকতার সঙ্গেই রাষ্ট্রপতি ডেকেছেন এবং আন্তরিকতার সঙ্গেই একটি নিরপেক্ষ সার্চ কমিটি গঠন করবেন, যার মাধ্যমে নিরপেক্ষ ইসি গঠন করা হবে। তা না হলে আগের মতো আবার মেরুদণ্ডহীন সরকারের বশংবদ ইসি গঠন করা হবে, যা কোনো দিনই এ দেশের মানুষ মেনে নেবে না’, বলেন বিএনপির এই নেতা।
বিএনপির আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান চায় জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, আলোচনা চাই, সংলাপ চাই এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হোক।