শিরোনাম :
Logo আসছে সিফাত নুসরাতের নতুন বই “অগ্নিকন্যা” Logo সনদ ইস্যুসহ দুই দফা দাবিতে ইবি উপাচার্যকে ছাত্রদলের স্মারকলিপি Logo ‘নুরুল হুদার সঙ্গে মব জাস্টিসে দলের কেউ জড়ি‌ত থাকলে ব্যবস্থা নেবে বিএনপি’ Logo জুবাইদা রহমান ভোটার হচ্ছেন, তথ্য সংগ্রহ করেছে ইসি Logo জুলাই বিপ্লবে স্কাউট সদস্যের আত্মাহুতি, এমন নজির বিশ্বে আর নেই: প্রধান উপদেষ্টা Logo সাবেক সিইসিসহ আ. লীগের ৮ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানালো ডিএমপি Logo মব সৃষ্টিতে পুলিশের ভুল থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Logo কচুয়ায় নিন্দপুর মহীউদ্দীন খান আলমগীর হাই স্কুল এন্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান Logo রাবিতে ঐতিহাসিক পলাশী দিবস পালন Logo শেরপুর সরকারি কলেজে এইচএসসি ২০২৫ পরীক্ষার্থীদের বিদায় ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত

‘কুইক রেন্টাল’, বিপুর সোনার ডিম পাড়া হাঁস

  • নীলকন্ঠ অনলাইন নীলকন্ঠ অনলাইন
  • আপডেট সময় : ১১:১২:১২ পূর্বাহ্ণ, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫
  • ৭০৮ বার পড়া হয়েছে

বিপুর লুটের স্থায়ী ব্যবস্থা ছিল কুইক রেন্টাল। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদ্যুৎ খাতে চিরস্থায়ী লুটপাটের জন্যই চালু করা হয় ‘কুইক রেন্টাল’। কুইক রেন্টাল আইনে অদ্ভুত ধারা ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন হোক না হোক, এসব ব্যক্তি মালিকানাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে মাসে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে অর্থ দিতে হবে। এই অর্থ আবার দিতে হতো বৈদেশিক মুদ্রায়।

লুণ্ঠনের টাকা বিদেশে পাচারের জন্যই এ রকম ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এসব কুইক রেন্টাল থেকে প্রতি মাসে নিয়মিত টাকা পেতেন দুর্নীতির বরপুত্র নসরুল হামিদ বিপু। নিজেই বলতেন, ‘কুইক রেন্টাল হলো আমার সোনার ডিম পাড়া হাঁস।’ নসরুল হামিদ রাজত্বে কোনো দরপত্র ছাড়াই বেসরকারি খাতে শতাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।

এর বেশির ভাগই কোনো কাজে আসেনি। সরকারি হিসাবে উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট বলা হলেও লোডশেডিং থেকে মুক্তি মেলেনি। এমনকি দেশে বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা কত, তারও সঠিক কোনো হিসাব নেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে। প্রাপ্ত হিসাবে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে বিদ্যুৎ খাতে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার।

বর্তমান বিনিময় হার বিবেচনায় (১ ডলার সমান ১২৫ টাকা) বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। একই সময় শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামেই লুটপাট হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে শুধু সক্ষমতা দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ এ টাকা নিয়ে গেছে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। এসব কেন্দ্রের বেশির ভাগের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা কিংবা তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। এ ক্যাপাসিটি চার্জ লুণ্ঠনের আবিষ্কারক অবশ্য ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন আমলা আবুল কালাম আজাদ।

কিন্তু ২০১৪ সালের পর এ কুইক রেন্টালের চাবি চলে যায় নসরুল হামিদ বিপুর হাতে। কুইক রেন্টাল মানেই ‘কুইক মানি’। বিদ্যুৎ খাতে লুটপাট যেন নিশ্চিন্তে করা যায় এজন্যই করা হয় দায়মুক্তির আইন। অর্থাৎ কোনো লুটের বিচার হবে না। করা যাবে না কোনো প্রশ্ন। বিপুকে কমিশন দিলেই মিলত কুইক রেন্টালের অনুমতি। আওয়ামী লীগের নেতা, পাতি নেতা অনুগত ব্যবসায়ীরা পেয়েছেন কুইক রেন্টালের লাইসেন্স। এমনকি আসবাবপত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান অটবিকেও দেওয়া হয় বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমতি। আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, ওমর ফারুক চৌধুরী, আলাউদ্দিন নাছিম চৌধুরী, প্রয়াত আসলাম উল হকসহ ৬৩ জন নেতা-কর্মী কুইক রেন্টাল স্থাপনের অনুমতি পান। অনুমতি পেয়েই কোটি কোটি টাকা দিয়ে তারা কাগজ বিক্রি করে দেন। প্রত্যেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৩ থেকে ৪ বার হাত বদল হয়েছে। একই বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিক্রি হয়েছে একাধিকবার। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানককে দেওয়া হয় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাইসেন্স। ৫ কোটি টাকায় তিনি তা বিক্রি করেন আসলাম হকের কাছে। আসলাম হক আবার এটি বিক্রি করেন সিকদার গ্রুপের কাছে। নসরুল হামিদের ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু পান দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ ছাড়া শরীয়তপুরের সাবেক এমপি নাহিম রাজ্জাক, বিসিবির (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) সাবেক পরিচালক জালাল ইউনুস, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ছোট ভাই, আবদুস সালাম, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, টাঙ্গাইলের সাবেক এমপি তানভীর হাসান (ছোট মনির), সাবেক ধর্মমন্ত্রী ফরিদুর রহমান, সিলেটের হাবিবুর রহমান এমপি ও রাজশাহী অঞ্চলের এমপি এনামুল হক, প্রত্যেকে একটি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পান। কুইক রেন্টালের নাম চিরস্থায়ী লুটপাটের ব্যবস্থা করা হয় আইন করে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলুক না চলুক, সরকারকে নিয়মিত দিতে হবে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’। এই লুটের টাকা তিন ভাগ হয়েছে। একটি ভাগ পেতেন নসরুল হামিদ বিপু। তার পক্ষে এ টাকা তুলতেন তার ক্যারিয়ার ভাই অপু।

২০০৮-০৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে ১৪ বছরে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার) কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দেওয়া হয়েছে ৮৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। গত বছরের জুলাইয়ে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ১৪ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে সরকার ৯০ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে। পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাব যোগ করলে তা ১ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, ওই সময়ে সামিটকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ১২ শতাংশ। সামিটের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। জয়ের কারণেই বিদ্যুৎ খাতে ‘ডন’ হয়ে ওঠে সামিট গ্রুপ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। কোম্পানিটিকে দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল আসলে রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে লুট করে। এগ্রিকোর লুটের বেশির ভাগ টাকা পেতেন ববি। এগ্রিকোর বাংলাদেশে ছায়া এজেন্ট ছিল এস আলম। ৭ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে চীনা কোম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংস। এরদা পাওয়ারের বাংলাদেশে অঘোষিত এজেন্ট ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। চতুর্থ স্থানে থাকা দেশি কোম্পানি ইউনাইটেড গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। পঞ্চম স্থানে থাকা রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে (আরপিসিএল) দেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বাংলা ক্যাট গ্রুপ নিয়েছে ৫ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। মাত্র তিন বছর আগে উৎপাদন শুরু হওয়া বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে গড়ে ওঠা পায়রা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পেয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। অপর একটি গ্রুপকে ৪ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা এবং খুলনা পাওয়ার কোম্পানিকে (কেপিসিএল) ৪ হাজার ৫৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানির ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিট গ্রুপের কাছে ও ৩৫ শতাংশ ইউনাইটেড গ্রুপের কাছে। বাকি ৩০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। ফলে খুলনা পাওয়ারের ক্যাপাসিটি চার্জের বড় অংশই গেছে সামিট ও ইউনাইটেডের কাছে। কুইক রেন্টাল ছাড়াও বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন নির্মাণে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হয়েছে। মিটার কেনাকাটা হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের জন্য সারা দেশে বিদ্যুৎ সুবিধা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে কূপ খননের নামে বাড়তি টাকায় প্রকল্প করা হয়েছে। এসবের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। ২০টি কূপের খননকাজ রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে দেওয়া হয়েছে প্রতিটি ২ কোটি ডলারের বেশি দামে। অথচ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) এটি ১ কোটি ডলারে করতে পারে। যথাযথভাবে বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে, অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগও তুলেছে সরকার কর্তৃক গঠিত দুর্নীতির শ্বেতপত্র কমিটি। তাদের প্রতিবেদন বলছে, একই গোষ্ঠীর বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে প্রতিযোগিতার নামে দরপত্র ডেকে কাজ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে সাবকন্ট্রাক্ট (কাজ পাওয়া ঠিকাদার নিজে কাজ না করে ছোট ঠিকাদারকে দিয়ে করায়) হিসেবে। এই লুটপাটের টাকার বেশির ভাগ নিতেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। বিপুর কিছু টাকা ব্যয় হতো ববির সিআরআই পরিচালনার জন্য।

নসরুল হামিদের ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের এক ভাতিজা ও কেরানীগঞ্জের শাহীন চেয়ারম্যান মিলে গড়ে তুলেছিলেন একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে জোট করে কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয়। এমনই একটি প্রকল্প হলো ডিপিডিসি, পিডিবি, ডেসকো, আরইবি ও নেসকোর অ্যাডভান্স মিটারিং, মিটার স্থাপন, বিলিং প্রকল্প ও নেটওয়ার্ক সিকিউরিটি-সংক্রান্ত প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প।

একইভাবে পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি কোম্পানি বিদেশি দুটি কোম্পানির সঙ্গে একটি এলপিজি প্রকল্পের কাজ পায়। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। অভিযোগ আছে, পাওয়ারকোর প্রধান শেয়ারধারী কামরুজ্জামান চৌধুরী সম্পর্কে নসরুল হামিদের মামা।

বিদ্যুতের লুটের টাকা বিনিয়োগের জন্য নসরুল হামিদ বিপু প্রায়ই বিদেশে যেতেন। বিপু বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ১০ বছরের বেশি সময়। এ সময়ের মধ্যে বিপু মোট ৩৮ বার বিদেশ যান। মজার ব্যাপার হলো যতবারই তিনি বিদেশে গেছেন ততবারই তিনি দুবাইতে থেকেছেন অন্তত দুই দিন। এখানেই লুটের টাকা গ্রহণ হতো।

 

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

আসছে সিফাত নুসরাতের নতুন বই “অগ্নিকন্যা”

‘কুইক রেন্টাল’, বিপুর সোনার ডিম পাড়া হাঁস

আপডেট সময় : ১১:১২:১২ পূর্বাহ্ণ, সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫

বিপুর লুটের স্থায়ী ব্যবস্থা ছিল কুইক রেন্টাল। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদ্যুৎ খাতে চিরস্থায়ী লুটপাটের জন্যই চালু করা হয় ‘কুইক রেন্টাল’। কুইক রেন্টাল আইনে অদ্ভুত ধারা ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন হোক না হোক, এসব ব্যক্তি মালিকানাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে মাসে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে অর্থ দিতে হবে। এই অর্থ আবার দিতে হতো বৈদেশিক মুদ্রায়।

লুণ্ঠনের টাকা বিদেশে পাচারের জন্যই এ রকম ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এসব কুইক রেন্টাল থেকে প্রতি মাসে নিয়মিত টাকা পেতেন দুর্নীতির বরপুত্র নসরুল হামিদ বিপু। নিজেই বলতেন, ‘কুইক রেন্টাল হলো আমার সোনার ডিম পাড়া হাঁস।’ নসরুল হামিদ রাজত্বে কোনো দরপত্র ছাড়াই বেসরকারি খাতে শতাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।

এর বেশির ভাগই কোনো কাজে আসেনি। সরকারি হিসাবে উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট বলা হলেও লোডশেডিং থেকে মুক্তি মেলেনি। এমনকি দেশে বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা কত, তারও সঠিক কোনো হিসাব নেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে। প্রাপ্ত হিসাবে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে বিদ্যুৎ খাতে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার।

বর্তমান বিনিময় হার বিবেচনায় (১ ডলার সমান ১২৫ টাকা) বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। একই সময় শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামেই লুটপাট হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে শুধু সক্ষমতা দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ এ টাকা নিয়ে গেছে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। এসব কেন্দ্রের বেশির ভাগের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা কিংবা তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। এ ক্যাপাসিটি চার্জ লুণ্ঠনের আবিষ্কারক অবশ্য ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন আমলা আবুল কালাম আজাদ।

কিন্তু ২০১৪ সালের পর এ কুইক রেন্টালের চাবি চলে যায় নসরুল হামিদ বিপুর হাতে। কুইক রেন্টাল মানেই ‘কুইক মানি’। বিদ্যুৎ খাতে লুটপাট যেন নিশ্চিন্তে করা যায় এজন্যই করা হয় দায়মুক্তির আইন। অর্থাৎ কোনো লুটের বিচার হবে না। করা যাবে না কোনো প্রশ্ন। বিপুকে কমিশন দিলেই মিলত কুইক রেন্টালের অনুমতি। আওয়ামী লীগের নেতা, পাতি নেতা অনুগত ব্যবসায়ীরা পেয়েছেন কুইক রেন্টালের লাইসেন্স। এমনকি আসবাবপত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান অটবিকেও দেওয়া হয় বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমতি। আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, ওমর ফারুক চৌধুরী, আলাউদ্দিন নাছিম চৌধুরী, প্রয়াত আসলাম উল হকসহ ৬৩ জন নেতা-কর্মী কুইক রেন্টাল স্থাপনের অনুমতি পান। অনুমতি পেয়েই কোটি কোটি টাকা দিয়ে তারা কাগজ বিক্রি করে দেন। প্রত্যেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৩ থেকে ৪ বার হাত বদল হয়েছে। একই বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিক্রি হয়েছে একাধিকবার। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানককে দেওয়া হয় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাইসেন্স। ৫ কোটি টাকায় তিনি তা বিক্রি করেন আসলাম হকের কাছে। আসলাম হক আবার এটি বিক্রি করেন সিকদার গ্রুপের কাছে। নসরুল হামিদের ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু পান দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ ছাড়া শরীয়তপুরের সাবেক এমপি নাহিম রাজ্জাক, বিসিবির (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) সাবেক পরিচালক জালাল ইউনুস, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ছোট ভাই, আবদুস সালাম, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, টাঙ্গাইলের সাবেক এমপি তানভীর হাসান (ছোট মনির), সাবেক ধর্মমন্ত্রী ফরিদুর রহমান, সিলেটের হাবিবুর রহমান এমপি ও রাজশাহী অঞ্চলের এমপি এনামুল হক, প্রত্যেকে একটি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পান। কুইক রেন্টালের নাম চিরস্থায়ী লুটপাটের ব্যবস্থা করা হয় আইন করে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলুক না চলুক, সরকারকে নিয়মিত দিতে হবে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’। এই লুটের টাকা তিন ভাগ হয়েছে। একটি ভাগ পেতেন নসরুল হামিদ বিপু। তার পক্ষে এ টাকা তুলতেন তার ক্যারিয়ার ভাই অপু।

২০০৮-০৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে ১৪ বছরে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার) কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দেওয়া হয়েছে ৮৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। গত বছরের জুলাইয়ে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ১৪ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে সরকার ৯০ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে। পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাব যোগ করলে তা ১ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, ওই সময়ে সামিটকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ১২ শতাংশ। সামিটের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। জয়ের কারণেই বিদ্যুৎ খাতে ‘ডন’ হয়ে ওঠে সামিট গ্রুপ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। কোম্পানিটিকে দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল আসলে রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে লুট করে। এগ্রিকোর লুটের বেশির ভাগ টাকা পেতেন ববি। এগ্রিকোর বাংলাদেশে ছায়া এজেন্ট ছিল এস আলম। ৭ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে চীনা কোম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংস। এরদা পাওয়ারের বাংলাদেশে অঘোষিত এজেন্ট ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। চতুর্থ স্থানে থাকা দেশি কোম্পানি ইউনাইটেড গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। পঞ্চম স্থানে থাকা রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে (আরপিসিএল) দেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বাংলা ক্যাট গ্রুপ নিয়েছে ৫ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। মাত্র তিন বছর আগে উৎপাদন শুরু হওয়া বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে গড়ে ওঠা পায়রা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পেয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। অপর একটি গ্রুপকে ৪ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা এবং খুলনা পাওয়ার কোম্পানিকে (কেপিসিএল) ৪ হাজার ৫৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ কোম্পানির ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিট গ্রুপের কাছে ও ৩৫ শতাংশ ইউনাইটেড গ্রুপের কাছে। বাকি ৩০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। ফলে খুলনা পাওয়ারের ক্যাপাসিটি চার্জের বড় অংশই গেছে সামিট ও ইউনাইটেডের কাছে। কুইক রেন্টাল ছাড়াও বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন নির্মাণে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হয়েছে। মিটার কেনাকাটা হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের জন্য সারা দেশে বিদ্যুৎ সুবিধা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে কূপ খননের নামে বাড়তি টাকায় প্রকল্প করা হয়েছে। এসবের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। ২০টি কূপের খননকাজ রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে দেওয়া হয়েছে প্রতিটি ২ কোটি ডলারের বেশি দামে। অথচ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) এটি ১ কোটি ডলারে করতে পারে। যথাযথভাবে বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে, অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগও তুলেছে সরকার কর্তৃক গঠিত দুর্নীতির শ্বেতপত্র কমিটি। তাদের প্রতিবেদন বলছে, একই গোষ্ঠীর বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে প্রতিযোগিতার নামে দরপত্র ডেকে কাজ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে সাবকন্ট্রাক্ট (কাজ পাওয়া ঠিকাদার নিজে কাজ না করে ছোট ঠিকাদারকে দিয়ে করায়) হিসেবে। এই লুটপাটের টাকার বেশির ভাগ নিতেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। বিপুর কিছু টাকা ব্যয় হতো ববির সিআরআই পরিচালনার জন্য।

নসরুল হামিদের ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের এক ভাতিজা ও কেরানীগঞ্জের শাহীন চেয়ারম্যান মিলে গড়ে তুলেছিলেন একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে জোট করে কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেয়। এমনই একটি প্রকল্প হলো ডিপিডিসি, পিডিবি, ডেসকো, আরইবি ও নেসকোর অ্যাডভান্স মিটারিং, মিটার স্থাপন, বিলিং প্রকল্প ও নেটওয়ার্ক সিকিউরিটি-সংক্রান্ত প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প।

একইভাবে পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি কোম্পানি বিদেশি দুটি কোম্পানির সঙ্গে একটি এলপিজি প্রকল্পের কাজ পায়। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। অভিযোগ আছে, পাওয়ারকোর প্রধান শেয়ারধারী কামরুজ্জামান চৌধুরী সম্পর্কে নসরুল হামিদের মামা।

বিদ্যুতের লুটের টাকা বিনিয়োগের জন্য নসরুল হামিদ বিপু প্রায়ই বিদেশে যেতেন। বিপু বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ১০ বছরের বেশি সময়। এ সময়ের মধ্যে বিপু মোট ৩৮ বার বিদেশ যান। মজার ব্যাপার হলো যতবারই তিনি বিদেশে গেছেন ততবারই তিনি দুবাইতে থেকেছেন অন্তত দুই দিন। এখানেই লুটের টাকা গ্রহণ হতো।