সরকার ও আইনের উদাসীনতায় বাড়ছে নারী ধর্ষণ ও সহিংসতা

নারীর প্রতি সহিংসতা সমাজের দীর্ঘদিনের একটি ভয়াবহ ব্যাধি। যুগ যুগ ধরে এই সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সরকার, মানবাধিকার সংগঠনসহ নানা পক্ষ কাজ করলেও পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। বরং নারীদের প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ, সাইবার বুলিং, ব্ল্যাকমেইল, এমনকি বৃদ্ধ ও শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে।

বিগত বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা স্পষ্ট হয়। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন ২০২৪’ অনুযায়ী, ওই বছর দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ১,১৫১টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৮১ জন নারী ও ৩৩১ জন কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮২ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৭ জন, ধর্ষণের চেষ্টার শিকার ১০৮ জন এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ১৩৮ জন। এছাড়া, প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬২ জন এবং অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ৯ জন। ২০২৩ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৫০৭ জন নারী।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসে দেশে ৩৮৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ১১৫ জন, যার মধ্যে ৭২ জন কন্যাশিশু। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৩১ জন নারী ও শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে এবং ধর্ষণের চেষ্টাও চালানো হয়েছে ২ জনের ওপর।

পরিবার থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সর্বত্র নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু ঘটনার তুলনায় মামলার সংখ্যা কম, আর মামলার তুলনায় বিচারের সংখ্যা আরও নগণ্য। পরিসংখ্যান বলছে, ধর্ষণের মামলায় ৯৭% ক্ষেত্রেই অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো, আমাদের দেশে ধর্ষকদের পক্ষেও আইনজীবী লড়াই করে তাদের নিরপরাধ প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকেন।

এই বিষয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগের শিক্ষার্থী মোছা: উম্মে মাহিমা হিমা বলেন, ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের পেছনের সরকার বা আইনের উদাসীনতা রয়েছে। কারণ অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয় না৷ ধর্ষকের চেয়ে যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে তার পরিচয় আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো বেশি প্রচার করে থাকে৷ যদি মিডিয়াগুলো ধর্ষকের নাম, ছবিসহ পরিচয় প্রচার করে এবং সরকার কঠোর আইন করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে তাহলে আমার মনে হয় ধর্ষকরা ভয় পাবে৷ কঠোর আইনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া উচিত৷ আমাদের দেশে এই আইন থাকলেও তা আসলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্যকর হয় না৷ অধিকাংশ অপরাধী জামিন নিয়ে বের হয়ে আসে৷

তিনি আরো বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে যে হারে প্রতিদিন ধর্ষণের ঘটণা ঘটছে তাতে মেয়েরা সব সময় একটা আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে৷ বর্তমান সরকারের উচিত এই বিষয়ে আরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা৷ যাতে ধর্ষকের ধর্ষণ করার কথা মাথায় আনতেও অন্তত ১০ বার ভাবে৷

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী নাদিম মাহমুদ- সরকার অথবা আইনের উদাসীনতায় ধর্ষণ/নারীর উপর সহিংসতার উর্ধ্বগতির কারণ প্রসঙ্গে বলেন, ৫ই আগষ্ট, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই সারাদেশেই আইন শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি হয়, এতে পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যক্রম অকেজো হয়ে পড়ে, কিন্তু তখনও এতো বেশি নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা শোনা যায় নি, যতটা না এই ৭ মাস পরে এসে বিভিন্ন গনমাধ্যমের সুত্রে জানা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নারীর প্রতি সহিংসতার অবশ্যই অন্যতম একটি কারণ, তবে একমাত্র কারণ নয়। সমাজের অবক্ষয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মৌলবাদীদের তৎপরতা, নারীবিদ্বেষী মনোভাব সামষ্টিক কারণ, এছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের ষড়যন্ত্রের অংশও এই সহিংসতার নেপথ্যে রয়েছে বলে আমি মনে করি।

ধর্ষকের বিচার সম্পর্কে তিনি বলেন, আইনের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি আইনের প্রতি সদা শ্রদ্ধাশীল এবং ডু-প্রসেসের মাধ্যমে বিচার হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি অর্থাৎ প্রচলিত যে বিচারের নিয়ম সেই অনুযায়ী ধর্ষণের অভিযুক্তদের বিচার করতে হবে, আইনের যে জেনারেল প্রিন্সিপাল সেটা লঙ্ঘন করা যাবে না। তদন্ত, তথ্য প্রমান সাপেক্ষে উভয়পক্ষের জবানবন্দি এবং সাক্ষীর জবানবন্দি সাপেক্ষে অভিযুক্তের বিচার করতে হবে।
অবশ্যই ধর্ষকের অভিযুক্তের অপরাধ প্রমানিত হলে তাকে শাস্তি দিতে হবে, এক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ও দন্ডবিধির অধীনে মৃত্যুদন্ডের ও অন্যান্য শাস্তির বিধান রয়েছে৷

পরিশেষে তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি ৯ মার্চ সরকারের আইন উপদেষ্টা যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে অর্থাৎ ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন এবং ৯০ দিনের মধ্যে বিচার নিষ্পত্তি এটা বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা এটা নিয়ে ভাবতে হবে, এছাড়া এই অপরাধকে জামিন অযোগ্য করার কারণে অনেক নিরপরাধ মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে অবিচারের স্বীকার হবে, প্রয়োজন পাশাপাশি আইন ও বিচার শালিশ কেন্দ্র এবং লিগ্যাল এইড এর মাধ্যমে কোন ক্ষেত্রে নারী সহিংসতার স্বীকার হয়েও বিচার পাচ্ছে নাহ বা অভিযোগ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে হওয়ায় কোন কথা বলতে পারছে নাহ এরকম জরিপ চালানো , তাদেরকে আইনি সহায়তা দেওয়া, সেই মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা উচিত, ধর্ষণ সহ যেকোন সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যাপক সরকারি ভাবে ক্যাম্পেইন করতে হবে, টিভিতে বা সরকারি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ফেসবুক পেইজেও ব্যাপক প্রচারণা করলে এই ধরনের নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা কমানো সম্ভব।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নূপুর সরকার বলেন, ধর্ষণ/নারী সহিংসতা উর্ধ্বগতির পেছনে সরকার, আইনের উদাসীনতা রয়েছে। অপরাধী ধরা পড়েও টাকা দিয়ে জামিনে বেশ ঘুরছে ফিরছে। তাছাড়া দেখা যায়, একজন ধর্ষক প্রমাণিত হওয়ার পরেই তার বিচার কাজ সম্পন্ন করতে অনেকদিন লেগে যায়। এতে করে অন্য আরেকজন ধর্ষককে ধর্ষণ করার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে আমি মনে করি। তবে সবকিছু সরকারকে দোষ দিলেই হবে না আমরা মানুষ যদি আমাদের দৃষ্টি সংযত না করে, মনুষ্যত্ববোধ, দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন যদি না থাকে প্রত্যেকের মাঝে তাহলে পুরো সমাজ সরকার আইন ব্যবস্থা কোনো কিছু দিয়েই হবে না। এরজন্য আমাদের সকলকেই আগে মানুষ হতে হবে।

তিনি আরো বলেন, একজন ধর্ষককের জনসমক্ষে নির্মম মৃত্যু হওয়া উচিত যাতে করে আরো চার পাঁচটা এমন মস্তিষ্কের মানুষ দেখে ভয় পায়। তবেই এই ধর্ষণের পরিমাণ কমে আসবে বলে আশা করি। এছাড়াও কয়দিনে যে হারে ধর্ষণ/নারী নির্যাতন বেড়েছে সরকারের উচিত তাই দেশের আইন ব্যবস্থা আরো সক্রিয় করা, দেখা যায় যে অনেক ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যায় যাতে অপ্রকাশিত না থাকে যথাযথ শাস্তি পায় সেজন্য আইন, মিডিয়া এগুলোর এক্টিভিটি বাড়ানো।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল্ ফিক অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী অপু মিয়া বলেন, বর্তমানে ধর্ষণ, নারী সহিংসতা উর্ধ্বগতির পেছনে সরকারের অদূরদর্শিতা ও প্রশাসনের তৎপরতার অভাব রয়েছে। সরকারের উচিত যেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো আমলে নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে অতি দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা। কিন্তু অবশ্যই সেটি নারী ও শিশু নির্যাতন আইন অনুসারে যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ইসলামি আইনে ধর্ষণ (জিনা বিল-ইকরাহ) একটি গুরুতর অপরাধ এবং এর জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। ধর্ষক প্রমাণিত হলে শরিয়া অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড বা পাথর নিক্ষেপ মৃত্যু কার্যকর করার বিধান হয়েছে। যদি বিবাহিত ব্যক্তি ধর্ষণ করে, তাহলে পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড (রজম) দেওয়া হয়। আর যদি অবিবাহিত ব্যক্তি ধর্ষণ করে, তাহলে ১০০ বেত্রাঘাত এবং এক বছর নির্বাসন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এছাড়াও তিনি ধর্ষকদের পক্ষে আইনজীবী দাঁড়ানোর বিষয়ে বলেন, আইনি সহায়তা পাওয়ার সকলের অধিকার রয়েছে। সে একজন ধর্ষক হোক বা খুনি। কারণ আইনজীবী শুধু তার মক্কেলের কথা গুলোই আইনের ভাষায় আদালতে উপস্থাপন করে। আইনজীবী তার মক্কেলকে নির্দোষ প্রমাণিত করার চেষ্টা করে তা নয় সে দোষী প্রমাণিত হলেও কিভাবে তার একটু শাস্তি কমানো যায় সেই জন্য অপরাধী পক্ষেও আইনজীবী দাঁড় করানো হয়। পরিশেষে বলেন, অনেক সময় মিথ্যা ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয় সেই জন্য সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধী সনাক্ত করে দ্রুততার সহিত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং জনগণকে নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে‌। ধর্ষণের মতো জঘন্য অমানবিক অপরাধ থেকে রেহাই পেতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সতর্কতা অত্যন্ত প্রয়োজন।

সবশেষে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রেখা রানী বলেন, নারী সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও রাষ্ট্রের উদাসীনতা বড় কারণ। কঠোর শাস্তি ও সচেতনতা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ কমিয়ে আনতে কেবল আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়; আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, দ্রুত বিচার, নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, এ ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

সরকার ও আইনের উদাসীনতায় বাড়ছে নারী ধর্ষণ ও সহিংসতা

আপডেট সময় : ০৫:১৫:২৪ অপরাহ্ণ, বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫

নারীর প্রতি সহিংসতা সমাজের দীর্ঘদিনের একটি ভয়াবহ ব্যাধি। যুগ যুগ ধরে এই সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সরকার, মানবাধিকার সংগঠনসহ নানা পক্ষ কাজ করলেও পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। বরং নারীদের প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ, সাইবার বুলিং, ব্ল্যাকমেইল, এমনকি বৃদ্ধ ও শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে।

বিগত বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা স্পষ্ট হয়। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) ‘মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন ২০২৪’ অনুযায়ী, ওই বছর দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ১,১৫১টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৮১ জন নারী ও ৩৩১ জন কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮২ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ৭ জন, ধর্ষণের চেষ্টার শিকার ১০৮ জন এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ১৩৮ জন। এছাড়া, প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬২ জন এবং অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ৯ জন। ২০২৩ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৫০৭ জন নারী।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসে দেশে ৩৮৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ১১৫ জন, যার মধ্যে ৭২ জন কন্যাশিশু। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৩১ জন নারী ও শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে এবং ধর্ষণের চেষ্টাও চালানো হয়েছে ২ জনের ওপর।

পরিবার থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সর্বত্র নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু ঘটনার তুলনায় মামলার সংখ্যা কম, আর মামলার তুলনায় বিচারের সংখ্যা আরও নগণ্য। পরিসংখ্যান বলছে, ধর্ষণের মামলায় ৯৭% ক্ষেত্রেই অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো, আমাদের দেশে ধর্ষকদের পক্ষেও আইনজীবী লড়াই করে তাদের নিরপরাধ প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকেন।

এই বিষয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগের শিক্ষার্থী মোছা: উম্মে মাহিমা হিমা বলেন, ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের পেছনের সরকার বা আইনের উদাসীনতা রয়েছে। কারণ অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয় না৷ ধর্ষকের চেয়ে যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে তার পরিচয় আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো বেশি প্রচার করে থাকে৷ যদি মিডিয়াগুলো ধর্ষকের নাম, ছবিসহ পরিচয় প্রচার করে এবং সরকার কঠোর আইন করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে তাহলে আমার মনে হয় ধর্ষকরা ভয় পাবে৷ কঠোর আইনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া উচিত৷ আমাদের দেশে এই আইন থাকলেও তা আসলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্যকর হয় না৷ অধিকাংশ অপরাধী জামিন নিয়ে বের হয়ে আসে৷

তিনি আরো বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে যে হারে প্রতিদিন ধর্ষণের ঘটণা ঘটছে তাতে মেয়েরা সব সময় একটা আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে৷ বর্তমান সরকারের উচিত এই বিষয়ে আরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা৷ যাতে ধর্ষকের ধর্ষণ করার কথা মাথায় আনতেও অন্তত ১০ বার ভাবে৷

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী নাদিম মাহমুদ- সরকার অথবা আইনের উদাসীনতায় ধর্ষণ/নারীর উপর সহিংসতার উর্ধ্বগতির কারণ প্রসঙ্গে বলেন, ৫ই আগষ্ট, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই সারাদেশেই আইন শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি হয়, এতে পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কার্যক্রম অকেজো হয়ে পড়ে, কিন্তু তখনও এতো বেশি নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা শোনা যায় নি, যতটা না এই ৭ মাস পরে এসে বিভিন্ন গনমাধ্যমের সুত্রে জানা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নারীর প্রতি সহিংসতার অবশ্যই অন্যতম একটি কারণ, তবে একমাত্র কারণ নয়। সমাজের অবক্ষয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মৌলবাদীদের তৎপরতা, নারীবিদ্বেষী মনোভাব সামষ্টিক কারণ, এছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের ষড়যন্ত্রের অংশও এই সহিংসতার নেপথ্যে রয়েছে বলে আমি মনে করি।

ধর্ষকের বিচার সম্পর্কে তিনি বলেন, আইনের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি আইনের প্রতি সদা শ্রদ্ধাশীল এবং ডু-প্রসেসের মাধ্যমে বিচার হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি অর্থাৎ প্রচলিত যে বিচারের নিয়ম সেই অনুযায়ী ধর্ষণের অভিযুক্তদের বিচার করতে হবে, আইনের যে জেনারেল প্রিন্সিপাল সেটা লঙ্ঘন করা যাবে না। তদন্ত, তথ্য প্রমান সাপেক্ষে উভয়পক্ষের জবানবন্দি এবং সাক্ষীর জবানবন্দি সাপেক্ষে অভিযুক্তের বিচার করতে হবে।
অবশ্যই ধর্ষকের অভিযুক্তের অপরাধ প্রমানিত হলে তাকে শাস্তি দিতে হবে, এক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ও দন্ডবিধির অধীনে মৃত্যুদন্ডের ও অন্যান্য শাস্তির বিধান রয়েছে৷

পরিশেষে তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি ৯ মার্চ সরকারের আইন উপদেষ্টা যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে অর্থাৎ ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন এবং ৯০ দিনের মধ্যে বিচার নিষ্পত্তি এটা বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা এটা নিয়ে ভাবতে হবে, এছাড়া এই অপরাধকে জামিন অযোগ্য করার কারণে অনেক নিরপরাধ মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে অবিচারের স্বীকার হবে, প্রয়োজন পাশাপাশি আইন ও বিচার শালিশ কেন্দ্র এবং লিগ্যাল এইড এর মাধ্যমে কোন ক্ষেত্রে নারী সহিংসতার স্বীকার হয়েও বিচার পাচ্ছে নাহ বা অভিযোগ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে হওয়ায় কোন কথা বলতে পারছে নাহ এরকম জরিপ চালানো , তাদেরকে আইনি সহায়তা দেওয়া, সেই মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা উচিত, ধর্ষণ সহ যেকোন সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যাপক সরকারি ভাবে ক্যাম্পেইন করতে হবে, টিভিতে বা সরকারি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ফেসবুক পেইজেও ব্যাপক প্রচারণা করলে এই ধরনের নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা কমানো সম্ভব।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নূপুর সরকার বলেন, ধর্ষণ/নারী সহিংসতা উর্ধ্বগতির পেছনে সরকার, আইনের উদাসীনতা রয়েছে। অপরাধী ধরা পড়েও টাকা দিয়ে জামিনে বেশ ঘুরছে ফিরছে। তাছাড়া দেখা যায়, একজন ধর্ষক প্রমাণিত হওয়ার পরেই তার বিচার কাজ সম্পন্ন করতে অনেকদিন লেগে যায়। এতে করে অন্য আরেকজন ধর্ষককে ধর্ষণ করার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে আমি মনে করি। তবে সবকিছু সরকারকে দোষ দিলেই হবে না আমরা মানুষ যদি আমাদের দৃষ্টি সংযত না করে, মনুষ্যত্ববোধ, দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন যদি না থাকে প্রত্যেকের মাঝে তাহলে পুরো সমাজ সরকার আইন ব্যবস্থা কোনো কিছু দিয়েই হবে না। এরজন্য আমাদের সকলকেই আগে মানুষ হতে হবে।

তিনি আরো বলেন, একজন ধর্ষককের জনসমক্ষে নির্মম মৃত্যু হওয়া উচিত যাতে করে আরো চার পাঁচটা এমন মস্তিষ্কের মানুষ দেখে ভয় পায়। তবেই এই ধর্ষণের পরিমাণ কমে আসবে বলে আশা করি। এছাড়াও কয়দিনে যে হারে ধর্ষণ/নারী নির্যাতন বেড়েছে সরকারের উচিত তাই দেশের আইন ব্যবস্থা আরো সক্রিয় করা, দেখা যায় যে অনেক ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যায় যাতে অপ্রকাশিত না থাকে যথাযথ শাস্তি পায় সেজন্য আইন, মিডিয়া এগুলোর এক্টিভিটি বাড়ানো।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল্ ফিক অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী অপু মিয়া বলেন, বর্তমানে ধর্ষণ, নারী সহিংসতা উর্ধ্বগতির পেছনে সরকারের অদূরদর্শিতা ও প্রশাসনের তৎপরতার অভাব রয়েছে। সরকারের উচিত যেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো আমলে নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে অতি দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা। কিন্তু অবশ্যই সেটি নারী ও শিশু নির্যাতন আইন অনুসারে যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ইসলামি আইনে ধর্ষণ (জিনা বিল-ইকরাহ) একটি গুরুতর অপরাধ এবং এর জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। ধর্ষক প্রমাণিত হলে শরিয়া অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড বা পাথর নিক্ষেপ মৃত্যু কার্যকর করার বিধান হয়েছে। যদি বিবাহিত ব্যক্তি ধর্ষণ করে, তাহলে পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড (রজম) দেওয়া হয়। আর যদি অবিবাহিত ব্যক্তি ধর্ষণ করে, তাহলে ১০০ বেত্রাঘাত এবং এক বছর নির্বাসন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এছাড়াও তিনি ধর্ষকদের পক্ষে আইনজীবী দাঁড়ানোর বিষয়ে বলেন, আইনি সহায়তা পাওয়ার সকলের অধিকার রয়েছে। সে একজন ধর্ষক হোক বা খুনি। কারণ আইনজীবী শুধু তার মক্কেলের কথা গুলোই আইনের ভাষায় আদালতে উপস্থাপন করে। আইনজীবী তার মক্কেলকে নির্দোষ প্রমাণিত করার চেষ্টা করে তা নয় সে দোষী প্রমাণিত হলেও কিভাবে তার একটু শাস্তি কমানো যায় সেই জন্য অপরাধী পক্ষেও আইনজীবী দাঁড় করানো হয়। পরিশেষে বলেন, অনেক সময় মিথ্যা ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয় সেই জন্য সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধী সনাক্ত করে দ্রুততার সহিত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং জনগণকে নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে‌। ধর্ষণের মতো জঘন্য অমানবিক অপরাধ থেকে রেহাই পেতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সতর্কতা অত্যন্ত প্রয়োজন।

সবশেষে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রেখা রানী বলেন, নারী সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও রাষ্ট্রের উদাসীনতা বড় কারণ। কঠোর শাস্তি ও সচেতনতা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ কমিয়ে আনতে কেবল আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়; আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, দ্রুত বিচার, নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, এ ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।