পরিবহনের মাফিয়া এনায়েত লুটেছেন হাজার কোটি টাকা

  • নীলকন্ঠ অনলাইন নীলকন্ঠ অনলাইন
  • আপডেট সময় : ০৮:৫৩:০১ পূর্বাহ্ণ, সোমবার, ৫ মে ২০২৫
  • ৭০৭ বার পড়া হয়েছে

পরিবহন সেক্টরের একচ্ছত্র মাফিয়া সম্রাট এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে। পুরো চাঁদাবাজিতে এনায়েত উল্লাহ ‘ক্যাশিয়ারের’ ভূমিকায় থাকলেও তার হাত ধরেই ভাগ পেয়েছেন বিগত সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা।

গত ১৫ বছর দেশের অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়ক তার দখলে থাকলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রয়েছেন পলাতক। সর্বশেষ ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।

অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ৪০টি ব্যাংক হিসাবে ১২৫ কোটি ৭২ লাখ ২৯ হাজার ২৮০ টাকা জমা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যার অধিকাংশই তার ব্যক্তিগত সঞ্চয় হিসাব বলে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি।

এদিকে গতকাল রোববার (৪ মে) খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, তার পরিবারের সদস্য ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে নিবন্ধিত ১৯০টি গাড়ি জব্দের আদেশ দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। এসব গাড়ি খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, তার স্ত্রী নার্গিস সামসাদ, ছেলে রিদওয়ানুল আশিক নিলয়, মেয়ে চামশে জাহান নিশি এবং তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের নামে রয়েছে। স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এনা পরিবহন ও স্টারলাইন স্পেশাল লিমিটেডের নাম রয়েছে। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন এনায়েত উল্লাহর নামে ৭০টি, স্ত্রী নার্গিস সামসাদের নামে ১০টি, মেয়ে চাশমে জাহান নিশির নামের তিনটি এবং এনা ট্রান্সপোর্ট নামের ১৫২টি পরিবহনসহ মোট ২৩৫টি বাসের মালিকানার দালিলিক প্রমাণ পেয়েছে। যেগুলো বিক্রি করে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছিল বলেও দুদকের গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে।

দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, অনুসন্ধান শুরুর পর থেকে দুদকের হাতে বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য আসতে শুরু করে। আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত বর্তমানে দুদকের হাতে রয়েছে। ইতিমধ্যে পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন পলাতক।

বর্তমানে পরিবার নিয়ে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন এনায়েত উল্লাহ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তার ব্যবসা বড় হতে শুরু করে। তবে ১/১১-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় দেশ ছেড়ে ভারত চলে যান তিনি। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আবারও দেশে ফিরে পরিবহন সমিতির নেতৃত্বে বসেন। সেখান থেকে শুধু সামনেই এগিয়ে গেছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তিনি নৌকার টিকিট নিয়ে সংসদে পর্যন্ত যেতে চেয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-৫ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আশা করে দলীয় আবেদনপত্র সংগ্রহ করেন। কিন্তু তখন তাকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।

দুদক সূত্র জানায়, ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এনায়েত উল্লাহ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়া এবং অর্থ পাচারের অভিযোগের বিপরীতে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তিনি পার পেয়ে যান। যদিও দুদকের অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক সত্যতা মেলে। যে কারণে ২০২১ সালের ১৪ জুন সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ পাঠায় দুদক। ঐ বছরের অক্টোবরে সম্পদের হিসাব জমা দেন এনায়েত উল্লাহ। যেখানে তিনি ২১৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দেন। সম্পদ অর্জনের উৎস হিসেবে এনা ট্রান্সপোর্ট (প্রা.) লিমিটেড, সোলার এন্টারপ্রাইজ, এনা শিপিং, এনা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানির নাম উল্লেখ করেন।

সর্বশেষ পাওয়া তথ্যানুসারে, খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ৪০টি ব্যাংক হিসাবে ১২৫ কোটি ৭২ লাখ ২৯ হাজার ২৮০ টাকা জমার তথ্য মিলেছে। যার মধ্যে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের বিএসএমএমইউ শাখায় ৩ কোটি ৯২ লাখ ৮৮ হাজার ৬৪০ টাকা, সিটি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় ৫৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকা, একই ব্যাংকের পল্লবী শাখায় ১৪ লাখ ৭ হাজার টাকা, ব্র্যাক ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে ১০ কোটি ২০ লাখ ২৫ হাজার টাকা, একই হিসাবের বিপরীতে ৫ কোটি ৩৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকার এফডিআর, ব্র্যাক ব্যাংকের তিন হিসাবে প্রায় ১৬ কোটি ২০ লাখ টাকার এফডিআর, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ৩৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার এফডিআর, সাউথইস্ট ব্যাংকে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং এনআরবিসি ব্যাংকে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা জমার তথ্য মিলেছে।

এছাড়া এনা মোটরস নামে ব্যাংক আল-ফালাহর ধানমন্ডি শাখায় ২১ কোটি ২৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকা, একই প্রতিষ্ঠানের নামে অপর হিসাবে ১৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, একই ব্যাংকের আরেক হিসাবে ৭ কোটি ৬৬ লাখ ৮৯ হাজার টাকা এবং এনা এন্টারপ্রাইজ নামে ব্যাংক আল ফালাহর ধানমন্ডি শাখায় ২ কোটি ৪৯ লাখ ৭১ হাজার টাকা থাকার তথ্য মিলেছে।

দুদকের আবেদনে বলা হয়, খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস থেকে দৈনিক ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। এছাড়া তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে অবৈধ আয়ে কৃষি জমি, ফ্ল্যাট, প্লট ক্রয়সহ বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন। তাদের নামে বিপুল পরিমাণ অস্থাবর সম্পদ রয়েছে বলেও জানা গেছে। এর আগে দুদকে জমা দেওয়া সম্পদের বিবরণীতে এনায়েত উল্লাহ স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে মোট ১৫০ কোটি ৮৭ লাখ টাকার সম্পদের হিসাব দেন।

এনায়েত উল্লাহর সম্পদের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর মিরপুরে ৮ দশমিক ২৫ বিঘা জমিতে ছয়তলা বাড়ি, মিরপুরের মনিপুর পাড়ায় ৮ শতাংশ জমিতে ছয়তলা বাড়ি, ধানমন্ডির ১১ নম্বর রোডের ৬২ নম্বর বাড়ির ৪/এ নম্বরে ৩ হাজার ৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, বসুন্ধরা সিটিতে ১৫১ বর্গফুটের একটি দোকান, দক্ষিণখানে দুই জায়গায় যথাক্রমে ৭৮ শতাংশ ও ১০ শতাংশ জমি, কেরানীগঞ্জে ৪০ কাঠা ও রূপগঞ্জে ১০ কাঠা জমি। এছাড়া গাজীপুরের দনুয়ায় ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার জমি এবং ফেনীতে ১২ শতাংশ জমি থাকার তথ্য উল্লেখ করেন তিনি।

১৯০ গাড়ি জব্দের আদেশ: দুদকের আবেদনে বলা হয়, অভিযুক্ত খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস থেকে দৈনিক ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগটি অনুসন্ধানে তিন সদস্যবিশিষ্ট টিম গঠন করা হয়েছে। অভিযোগটি অনুসন্ধানকালে এনায়েত উল্লাহ, তার স্ত্রী নার্গিস সামসাদ, ছেলে রিদওয়ানুল আশিক নিলয়, মেয়ে চামশে জাহান নিশি এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের নামে এসব রেজিস্ট্রেশনভুক্ত যানবাহন বা মোটরযানসমূহের তথ্য পাওয়া যায়। অভিযুক্তরা এসব যানবাহন বা মোটরযানসমূহের মালিকানা হস্তান্তর করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন মর্মে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। অভিযোগটি সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে এসব যানবাহন জব্দ করার আদেশ দেওয়া প্রয়োজন। আদালত শুনানির পর এনায়েত উল্লাহর এনা ও স্টার লাইনের ১৯০টি গাড়ি জব্দের আদেশ দেন।

পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি নিয়ে গত বছরের শেষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি) একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে।

সংগঠনটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। আর এ চাঁদার ভাগ পায় দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক সংগঠন, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা। এছাড়া দেশের বৃহত বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশ মালিকই রাজনীতিবিদ। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই যখন যারা ক্ষমতায় থাকে ঐ সব দলের সমর্থনপুষ্ট। জানা যায়, চাঁদাবাজি না থাকলে যাত্রীদের ৬০ শতাংশ ভাড়া কমে যেত।

ট্যাগস :

পরিবহনের মাফিয়া এনায়েত লুটেছেন হাজার কোটি টাকা

আপডেট সময় : ০৮:৫৩:০১ পূর্বাহ্ণ, সোমবার, ৫ মে ২০২৫

পরিবহন সেক্টরের একচ্ছত্র মাফিয়া সম্রাট এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে। পুরো চাঁদাবাজিতে এনায়েত উল্লাহ ‘ক্যাশিয়ারের’ ভূমিকায় থাকলেও তার হাত ধরেই ভাগ পেয়েছেন বিগত সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা।

গত ১৫ বছর দেশের অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়ক তার দখলে থাকলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রয়েছেন পলাতক। সর্বশেষ ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।

অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ৪০টি ব্যাংক হিসাবে ১২৫ কোটি ৭২ লাখ ২৯ হাজার ২৮০ টাকা জমা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যার অধিকাংশই তার ব্যক্তিগত সঞ্চয় হিসাব বলে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি।

এদিকে গতকাল রোববার (৪ মে) খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, তার পরিবারের সদস্য ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে নিবন্ধিত ১৯০টি গাড়ি জব্দের আদেশ দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। এসব গাড়ি খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, তার স্ত্রী নার্গিস সামসাদ, ছেলে রিদওয়ানুল আশিক নিলয়, মেয়ে চামশে জাহান নিশি এবং তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের নামে রয়েছে। স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এনা পরিবহন ও স্টারলাইন স্পেশাল লিমিটেডের নাম রয়েছে। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব এ আদেশ দেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন এনায়েত উল্লাহর নামে ৭০টি, স্ত্রী নার্গিস সামসাদের নামে ১০টি, মেয়ে চাশমে জাহান নিশির নামের তিনটি এবং এনা ট্রান্সপোর্ট নামের ১৫২টি পরিবহনসহ মোট ২৩৫টি বাসের মালিকানার দালিলিক প্রমাণ পেয়েছে। যেগুলো বিক্রি করে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছিল বলেও দুদকের গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে।

দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, অনুসন্ধান শুরুর পর থেকে দুদকের হাতে বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য আসতে শুরু করে। আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত বর্তমানে দুদকের হাতে রয়েছে। ইতিমধ্যে পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন পলাতক।

বর্তমানে পরিবার নিয়ে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন এনায়েত উল্লাহ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তার ব্যবসা বড় হতে শুরু করে। তবে ১/১১-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় দেশ ছেড়ে ভারত চলে যান তিনি। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আবারও দেশে ফিরে পরিবহন সমিতির নেতৃত্বে বসেন। সেখান থেকে শুধু সামনেই এগিয়ে গেছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তিনি নৌকার টিকিট নিয়ে সংসদে পর্যন্ত যেতে চেয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-৫ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আশা করে দলীয় আবেদনপত্র সংগ্রহ করেন। কিন্তু তখন তাকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।

দুদক সূত্র জানায়, ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এনায়েত উল্লাহ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়া এবং অর্থ পাচারের অভিযোগের বিপরীতে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তিনি পার পেয়ে যান। যদিও দুদকের অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক সত্যতা মেলে। যে কারণে ২০২১ সালের ১৪ জুন সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ পাঠায় দুদক। ঐ বছরের অক্টোবরে সম্পদের হিসাব জমা দেন এনায়েত উল্লাহ। যেখানে তিনি ২১৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের ঘোষণা দেন। সম্পদ অর্জনের উৎস হিসেবে এনা ট্রান্সপোর্ট (প্রা.) লিমিটেড, সোলার এন্টারপ্রাইজ, এনা শিপিং, এনা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানির নাম উল্লেখ করেন।

সর্বশেষ পাওয়া তথ্যানুসারে, খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ৪০টি ব্যাংক হিসাবে ১২৫ কোটি ৭২ লাখ ২৯ হাজার ২৮০ টাকা জমার তথ্য মিলেছে। যার মধ্যে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের বিএসএমএমইউ শাখায় ৩ কোটি ৯২ লাখ ৮৮ হাজার ৬৪০ টাকা, সিটি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় ৫৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকা, একই ব্যাংকের পল্লবী শাখায় ১৪ লাখ ৭ হাজার টাকা, ব্র্যাক ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবে ১০ কোটি ২০ লাখ ২৫ হাজার টাকা, একই হিসাবের বিপরীতে ৫ কোটি ৩৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকার এফডিআর, ব্র্যাক ব্যাংকের তিন হিসাবে প্রায় ১৬ কোটি ২০ লাখ টাকার এফডিআর, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ৩৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার এফডিআর, সাউথইস্ট ব্যাংকে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং এনআরবিসি ব্যাংকে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা জমার তথ্য মিলেছে।

এছাড়া এনা মোটরস নামে ব্যাংক আল-ফালাহর ধানমন্ডি শাখায় ২১ কোটি ২৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকা, একই প্রতিষ্ঠানের নামে অপর হিসাবে ১৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, একই ব্যাংকের আরেক হিসাবে ৭ কোটি ৬৬ লাখ ৮৯ হাজার টাকা এবং এনা এন্টারপ্রাইজ নামে ব্যাংক আল ফালাহর ধানমন্ডি শাখায় ২ কোটি ৪৯ লাখ ৭১ হাজার টাকা থাকার তথ্য মিলেছে।

দুদকের আবেদনে বলা হয়, খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস থেকে দৈনিক ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। এছাড়া তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে অবৈধ আয়ে কৃষি জমি, ফ্ল্যাট, প্লট ক্রয়সহ বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন। তাদের নামে বিপুল পরিমাণ অস্থাবর সম্পদ রয়েছে বলেও জানা গেছে। এর আগে দুদকে জমা দেওয়া সম্পদের বিবরণীতে এনায়েত উল্লাহ স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে মোট ১৫০ কোটি ৮৭ লাখ টাকার সম্পদের হিসাব দেন।

এনায়েত উল্লাহর সম্পদের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর মিরপুরে ৮ দশমিক ২৫ বিঘা জমিতে ছয়তলা বাড়ি, মিরপুরের মনিপুর পাড়ায় ৮ শতাংশ জমিতে ছয়তলা বাড়ি, ধানমন্ডির ১১ নম্বর রোডের ৬২ নম্বর বাড়ির ৪/এ নম্বরে ৩ হাজার ৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, বসুন্ধরা সিটিতে ১৫১ বর্গফুটের একটি দোকান, দক্ষিণখানে দুই জায়গায় যথাক্রমে ৭৮ শতাংশ ও ১০ শতাংশ জমি, কেরানীগঞ্জে ৪০ কাঠা ও রূপগঞ্জে ১০ কাঠা জমি। এছাড়া গাজীপুরের দনুয়ায় ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার জমি এবং ফেনীতে ১২ শতাংশ জমি থাকার তথ্য উল্লেখ করেন তিনি।

১৯০ গাড়ি জব্দের আদেশ: দুদকের আবেদনে বলা হয়, অভিযুক্ত খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস থেকে দৈনিক ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগটি অনুসন্ধানে তিন সদস্যবিশিষ্ট টিম গঠন করা হয়েছে। অভিযোগটি অনুসন্ধানকালে এনায়েত উল্লাহ, তার স্ত্রী নার্গিস সামসাদ, ছেলে রিদওয়ানুল আশিক নিলয়, মেয়ে চামশে জাহান নিশি এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের নামে এসব রেজিস্ট্রেশনভুক্ত যানবাহন বা মোটরযানসমূহের তথ্য পাওয়া যায়। অভিযুক্তরা এসব যানবাহন বা মোটরযানসমূহের মালিকানা হস্তান্তর করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন মর্মে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। অভিযোগটি সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে এসব যানবাহন জব্দ করার আদেশ দেওয়া প্রয়োজন। আদালত শুনানির পর এনায়েত উল্লাহর এনা ও স্টার লাইনের ১৯০টি গাড়ি জব্দের আদেশ দেন।

পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি নিয়ে গত বছরের শেষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি) একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে।

সংগঠনটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। আর এ চাঁদার ভাগ পায় দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক সংগঠন, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা। এছাড়া দেশের বৃহত বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশ মালিকই রাজনীতিবিদ। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই যখন যারা ক্ষমতায় থাকে ঐ সব দলের সমর্থনপুষ্ট। জানা যায়, চাঁদাবাজি না থাকলে যাত্রীদের ৬০ শতাংশ ভাড়া কমে যেত।