ইসলামে রোজা (সিয়াম) শুধু একটি ধর্মীয় অনুশীলন নয়, এটি মানুষের শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও পুষ্টিবিদ্যা অনুযায়ী, ইসলামী রোজার সঙ্গে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংয়ের (Intermittent Fasting-IF) বেশ কিছু মিল আছে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং জনপ্রিয় হচ্ছে, বিশেষ করে ওজন কমানো, বিপাকক্রিয়া উন্নয়ন, হূদরোগ প্রতিরোধ এবং দীর্ঘায়ু বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতার জন্য। ইসলামী রোজাও একইভাবে স্বাস্থ্যগত ও আত্মিক উন্নয়নে সহায়ক বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে আমরা ইসলামের রোজা এবং আধুনিক ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংয়ের মধ্যে সাদৃশ্য, পার্থক্য এবং এ দুটির স্বাস্থ্যগত উপকারিতা নিয়ে গভীর বিশে্লষণ করব।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং (IF) কী?
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং হলো নির্দিষ্ট সময় খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকার একটি পদ্ধতি, যা দেহের বিপাকক্রিয়া উন্নত করে, ওজন কমাতে সহায়তা করে এবং কোষীয় পুনর্গঠন (cell regeneration) প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এটি কয়েকটি জনপ্রিয় পদ্ধতিতে করা হয় ১. ১৬/৮ পদ্ধতি দিনে ১৬ ঘণ্টা না খেয়ে থাকা এবং ৮ ঘণ্টার মধ্যে খাবার গ্রহণ। ২. ২০/৪ পদ্ধতি ২০ ঘণ্টা উপবাস এবং ৪ ঘণ্টার মধ্যে খাবার গ্রহণ। ৩. ৫:২ পদ্ধতি সপ্তাহে ৫ দিন স্বাভাবিক খাদ্যগ্রহণ এবং ২ দিন ৫০০-৬০০ ক্যালরি গ্রহণ করা। ৪. ওএমএড (OMAD – One Meal A Day) দিনে মাত্র একবার খাবার গ্রহণ।
ইসলামে রোজার সংজ্ঞা ও নিয়ম : ইসলামে রোজা পালনের মূলনীতি হলো সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের খাদ্য-পানীয় এবং যৌনাচার থেকে বিরত থাকা। কোরআনে বলা হয়েছে : ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘রোজা রাখো, সুস্থ থাকবে।’ (ইবনে মাজাহ)
এই হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায়, রোজা শুধু আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য নয়, এটি শারীরিক সুস্থতার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলামী রোজা ও ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংয়ের মিল : ইসলামের রোজা এবং ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংয়ের মধ্যে বেশ কিছু মিল আছে : ১. উভয় পদ্ধতিতেই নির্দিষ্ট সময় উপবাস থাকতে হয় রোজায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস থাকতে হয়, যা ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংয়ের ১৬/৮ বা ২০/৪ পদ্ধতির সঙ্গে মিলে যায়। ২. দেহের বিপাকক্রিয়া উন্নত হয়। রোজা ও IF উভয়ই ইনসুলিনের মাত্রা কমিয়ে শরীরকে ফ্যাট বার্নিং মোডে প্রবেশ করতে সহায়তা করে।
৩. মানসিক প্রশান্ত ও আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখায় উভয় পদ্ধতিই ধৈর্যশীলতা ও আত্মসংযম শেখায়, যা মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। ৪. হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে, রোজা ও ওঋ হরমোন নিঃসরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, যা দীর্ঘায়ু ও স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক। ৫. শরীর ডিটক্স করে, রোজা ও IF অটোফেজি (Autophagy) প্রক্রিয়া সক্রিয় করে, যা কোষের ময়লা দূর করে এবং নতুন কোষ তৈরিতে সাহায্য করে।
রোজা ও ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিংয়ের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা
ওজন কমানো ও বিপাকক্রিয়া উন্নয়ন : উভয় পদ্ধতিই শরীরের ইনসুলিন মাত্রা কমিয়ে ফ্যাট বার্নিং প্রক্রিয়া বাড়িয়ে দেয়, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। ২. কোষ পুনর্জীবন ও ডিটক্সিফিকেশন: ২০১৬ সালে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহসুমি দেখান যে রোজা বা উপবাস কোষের পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে (Autophagy) সক্রিয় করে, যা শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন দূর করে।
হূদরোগ ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধ : রোজা ও ওঋ উভয়ই কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং রক্তচাপ কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি : উপবাস ব্রেন-ডেরাইভড নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর (BDNF) বাড়িয়ে মসি্তষ্কের নিউরন সংযোগ শক্তিশালী করে, যা স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ বাড়ায়।
দীর্ঘায়ু বৃদ্ধি ও বার্ধক্য প্রতিরোধ : IF ও রোজা শরীরের কোষ পুনর্গঠন করে, যা বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ধীর করে এবং আয়ু বাড়াতে সহায়তা করে।
মানসিক প্রশান্ত ও আত্মনিয়ন্ত্রণ : রোজার সময় কর্টিসল হরমোনের মাত্রা কমে, যা স্ট্রেস ও উদ্বেগ কমায় এবং মানসিক প্রশান্ত প্রদান করে।
ডিহাইড্রেশন এড়ানোর উপায় : প্রয়োজনীয় টিপস
রমজান মাসে রোজা পালন মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পানাহার থেকে বিরত থাকার কারণে শরীরে পানির ঘাটতি বা ডিহাইড্রেশন (Dehydration) হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, বিশেষত গরমের সময়। ডিহাইড্রেশন হলে মাথাব্যথা, ক্লান্ত, দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, মনোযোগের অভাব এবং প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যেতে পারে। তাই রোজা রাখার সময় শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা অত্যন্ত জরুরি।
ডিহাইড্রেশন কী এবং কেন এটি হয়?
ডিহাইড্রেশন তখনই ঘটে যখন শরীর প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি হারায় এবং যথেষ্ট পরিমাণ পানি না পাওয়া যায়। রোজার সময় দীর্ঘক্ষণ পানি না খাওয়ার কারণে শরীর পানির ঘাটতির শিকার হতে পারে।
ডিহাইড্রেশনের লক্ষণসমূহ : তীব্র তৃষ্ঞা লাগা, মাথাব্যথা ও মাথা ঘোরা, ক্লান্ত ও দুর্বলতা, প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হয়ে যাওয়া, মুখ ও ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, গরম আবহাওয়া এবং অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে ডিহাইড্রেশনের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। তবে কিছু সহজ নিয়ম মেনে চললে রোজার সময়ও শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা সম্ভব।
ডিহাইড্রেশন এড়ানোর জন্য কার্যকর টিপস
১. সাহরিতে প্রচুর পানি পান করুন : সাহরিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে একসঙ্গে অনেক পানি পান না করে ধীরে ধীরে ২-৩ গ্লাস পানি পান করুন, যাতে শরীর ভালোভাবে এটি শোষণ করতে পারে। পানির পাশাপাশি যা খাবেন: ডাবের পানি: এটি প্রাকৃতিক ইলেক্ট্রোলাইটসমৃদ্ধ, যা শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে। শসা, তরমুজ, কমলা, লাউ ইত্যাদি পানিযুক্ত ফল ও সবজি খান। দই ও লাবান (ছাছ) পান করুন, যা হাইড্রেশন বজায় রাখতে সহায়ক।
যা এড়িয়ে চলবেন : অতিরিক্ত চা বা কফি : এগুলো মূত্রবর্ধক (Diuretic) হিসেবে কাজ করে এবং শরীর থেকে বেশি পানি বের করে দেয়। অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার: যেমন ভাজাপোড়া, চিপস বা প্রক্রিয়াজাত খাবার।
ইফতারে দ্রুত পানি পান করবেন না, বরং ধীরে ধীরে পান করুন : অনেক সময় রোজা ভাঙার পরপরই বেশি পানি পান করলে পেট ভারী হয়ে যায় এবং হজমের সমস্যা দেখা দেয়। তাই ধীরে ধীরে পানি পান করুন এবং ইফতার শুরু করুন খেজুর ও হালকা পানীয় দিয়ে।
ইফতারে কী ধরনের পানীয় গ্রহণ করা উচিত? : সাধারণ পানি (কোনো সংযোজন ছাড়া) ডাবের পানি, লেবু-পানি, তাজা ফলের রস (চিনি ছাড়া), সু্যপ বা ঝোলযুক্ত খাবার।
যা এড়িয়ে চলবেন : অতিরিক্ত মিষ্টি শরবত, কোল্ড ড্রিংক বা সফট ড্রিংক, অতিরিক্ত আইসক্রিম ও মিষ্টান্ন
পানিযুক্ত খাবার ও ফলমূল বেশি খান : সাহরি ও ইফতারে এমন খাবার বেছে নিন, যা শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক। যেসব খাবার পানির পরিমাণ বেশি: এই ফলগুলো রোজাদারদের জন্য উপকারী, কারণ এগুলো দীর্ঘসময় শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে।
অতিরিক্ত লবণ ও মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন : লবণ শরীরের পানিশূন্যতা বাড়িয়ে দেয় এবং তৃষ্ঞা বাড়ায়। তাই সাহরি ও ইফতারে অতিরিক্ত লবণ ও ঝালযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। যে ধরনের খাবার পরিহার করবেন: অতিরিক্ত ভাজাপোড়া ও ফাস্টফুড, অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার (আচার, চিপস, প্রক্রিয়াজাত খাবার), গাঢ় মসলাযুক্ত ও ঝাল খাবার।
উপসংহার : আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে রোজা ও ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং উভয়ই স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তাই রোজা কেবল আত্মিক উন্নতির মাধ্যম নয়, এটি সুস্থ ও দীর্ঘায়ু জীবনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও
প্রভাষক, রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ।