নিউজ ডেস্ক:
নীল তিমিকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী। এর সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। বিশাল এই প্রাণীর জীবনাচরণ আজো মানুষের মধ্যে বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটায়। এরা মাছের মতো ফুলকা দিয়ে নিঃশ্বাস নেয়, আবার ডিমও পাড়ে না। অক্সিজেন নেয় মানুষের মতো ফুসফুস দিয়ে। আবার বসবাস করে পানিতে। নীল তিমিরা পানিতেই শিশু তিমিকে দুধ খাওয়ায়। সমুদ্রে রাজত্ব করে বেড়ানো এই তিমি লম্বায় ১০০ ফুট হয়। যা কিনা সবচেয়ে বড় ডাইনোসরের দ্বিগুণ।
এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, একটি স্পার্ম হোয়েল বছরে প্রায় ৫০ টন মলত্যাগ করে। আবার একটি তিমি যে পরিমাণ কার্বন পরিবেশে ত্যাগ করে তার দ্বিগুণ পরিমাণ কার্বন তার মল দ্বারা শোষিত হয়। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ মহাসাগরে তিমির সংখ্যা ছিল ১২ হাজার, যা প্রায় চার লাখ টন কার্বন শোষণ করেছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, স্পার্ম হোয়েল তাদের অগোচরেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে।
নীল তিমির জীবনধারণ পদ্ধতি বেশ রহস্যময়। তাদের গড় আয়ু ৮০ থেকে ৯০ বছর। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বয়স্ক যে নীল তিমি খুঁজে পাওয়া গেছে, তার বয়স ১১০ বছর। পৃথিবীর প্রায় সব মহাসাগরেই নীল তিমি রাজত্ব করে বেড়ায়। এর মধ্যে- অ্যান্টার্কটিকা মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের নিউ ফান্ড ল্যান্ড, নোভা স্কশিয়া, গ্রিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডে দেখা যায় নীল তিমি। প্রশান্ত মহাসাগরে কোরিয়ান কিছু উপদ্বীপের কাছে দেখা যায়। আবার দক্ষিণ গোলার্ধে অ্যান্টার্কটিকা, ওশেনিয়া মহাদেশেও দেখা যায় তাদের। অতিরিক্ত শিকারের কারণে বিশ্বব্যাপী নীল তিমির সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে কয়েক বছর ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন পরিবেশবাদীরা।
নীল তিমির সাধারণত দুটি মৌসুম থাকে। খাওয়ার মৌসুম ও প্রজনন মৌসুম। খাওয়ার মৌসুম সাধারণত শুরু হয় গ্রীষ্মকালে। উত্তর মেরুতে যখন শীতকাল, দক্ষিণ মেরুতে তখন গ্রীষ্মকাল। মেরু অঞ্চলে যখন শীত থাকে, সেই পুরো সময়টা তখন বিষুবরেখার কাছাকাছি উষ্ণ সাগর অঞ্চলে কাটিয়ে দেয় নীল তিমি। উত্তর ও দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের সাগরে গ্রীষ্মকালে কোটি কোটি ক্রিল থাকে।
এ সময় তারা প্রচুর পরিমাণে ‘ক্রিল’ খায় এবং প্রজনন মৌসুমের জন্য শক্তি জমা করে শরীরে। কারণ শীতকালে তারা খুব কম খাদ্য গ্রহণ করে। এ সময় তাদের শরীরে পুরু চর্বির আস্তরণ তৈরি হয়। শরৎকালের শেষ দিক থেকে সাধারণত তারা তাদের সঙ্গী খুঁজতে থাকে এবং মিলিত হয়। এর পরের এই মৌসুম থাকে শীত পর্যন্ত। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে তারা নতুন বাসস্থানের খোঁজে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়। এ সময়ই সঙ্গীর দেখা পায় তারা। এরপর তারা আবার গ্রীষ্মকালে উষ্ণ সাগরে ফিরে যায় সন্তান জন্ম দিতে।
রহস্যময় নীল তিমি অনেকটা জেগে থেকেই ঘুমায়। তারা পুরোপুরি ঘুমায় না। তাদের মস্তিষ্কের অর্ধেক ঘুমায়, বাকি অর্ধেক জেগে থাকে। কারণ হিসেবে মনে করা হয়, তিমি যদি ঘুমিয়ে পড়ে এবং সময়মতো না জাগে, তাহলে দম আটকে মারাও যেতে পারে। তাই তাদের অর্ধেক মস্তিষ্ক সব সময় জেগে থাকে, যাতে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ঘুমের মধ্যেও ভেসে উঠতে পারে। ঘুমের এ বিষয়টি বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রাফির (ইইজি) মাধ্যমে।
১৯ শতকের প্রথম দিকে প্রায় প্রত্যেক মহাসাগরে নীল তিমি দেখা যেত। এক শতকের ব্যবধানে শিকারিদের উৎপাতে এই প্রাণীটি এখন বিলুপ্তির পথে। ১৯০০ সালের দিকে নীল তিমির তেল সংগ্রহে মানুষের আগ্রহের কারণে বিপুলসংখ্যক নীল তিমি নিধন করা হয়। ১৯০০ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার তিমি শিকারিদের হাতে মারা যায়। এরপর আন্তর্জাতিক তিমি কমিশন বাণিজ্যিকভাবে নীল তিমি শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সম্প্রতি, আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা আইইউসিএন নীল তিমিকে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
শিকার ছাড়াও জেলেদের হাতে তিমি নিধন হয়। তিমি জেলেদের জালে আটকা পড়ে ডুবে যায় অথবা অভুক্ত থেকে শেষে মারা যায়। সমুদ্রে জাহাজ যাতায়াত বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্রুতগামী জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েও অনেক তিমি মারা যায়। ২০০২ সালের এক হিসাব মতে, সারা বিশ্বে অন্তত ১২ হাজার নীল তিমি রয়েছে। আইইউসিএন ধারণা করছে, বর্তমানে এর সংখ্যা হতে পারে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার।