নিউজ ডেস্ক:চুয়াডাঙ্গা শহরের সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ মাধ্যমিক স্তরের অপর তিনটি বালিকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্যানিটেশন ব্যবস্থা বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। এ সকল বিদ্যালয়গুলোতে চাহিদার তুলনায় টয়লেট সংখ্যা অনেক কম থাকায় বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে ছাত্রীদের। এছাড়া বিদ্যালয়ে যে টয়লেটগুলো আছে তাতে ময়লা দূর্গন্ধ জমে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরী হয়েছে। টয়লেটে নেই হাত ধোয়ার জন্য সাবানের ব্যবস্থা। অধিকাংশ টয়লেট স্যাঁতসেতে ও ময়লা পানি আটকে থাকাসহ নিয়মিত পরিস্কার না করায়, এগুলো ব্যবহার তো দূরের কথা, এর পাশদিয়ে চলাচল করাও প্রায় অসম্ভব। ফলে ঋতুকালীন সময়সহ স্বাভাবিক অবস্থায়ও টয়লেট ব্যবহার না করায় চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে এ সকল স্কুলের কোমলমতি বালিকা শিক্ষার্থীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋতুকালীন সময়সহ স্বাভাবিক অবস্থায়, ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘক্ষণ টয়লেটে না যাওয়ায়, নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এরপরেও স্কুলগুলোর কর্তৃপক্ষ মেয়েদের ব্যবহারের টয়লেটগুলোর দূরাবস্থার বিষয়ে মোটেও সচেতন হচ্ছে না।
এ সব স্কুলের মেয়েরা অভিযোগ করে বলেন, তাদের স্কুলে টয়লেটের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আবার যেগুলো আছে তার অধিকাংশই ব্যবহারের উপযোগী না। ময়লা দুর্গন্ধ ও স্যাঁতসেতেসহ ঠিকমত পরিস্কার না করায় টয়লেটগুলোর পাশে গেলেই বমি চলে আসে। কিছু টয়লেট কোনো রকম ভালো পরিবেশ থাকলেও সেগুলোতে নেই লাইট, পরিস্কার পানি, হাত ধোয়ার জন্য সাবানের ব্যবস্থা। ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই দীর্ঘসময় প্রয়োজনে টয়লেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকছে শিক্ষার্থীরা। তারা আরও অভিযোগ করে বলেন, তাদের টয়লেটগুলোর অবস্থা এমন হলেও, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টয়লেটগুলো ঠিকই ব্যবহার উপযোগী। তাদের টয়লেটগুলোতে লাইট, পরিস্কার পানি, হাত পরিস্কার করার জন্য সাবানের ব্যবস্থাসহ সকল রকম সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, আদর্শ গালর্স ও রাহেলা খাতুন গালর্স স্কুলের মেয়েদের টয়লেট দেখে বিস্মিত হতে হয়েছে। এরমধ্যে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের টয়লেটের অবস্থা খুব ভয়াবহ। ্য সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই শিফ্ট মিলে ছাত্রী সংখ্যা ২ হাজার ১৩৬ জন। এ স্কুলের টয়লেট আছে ১২টি। তার মধ্যে ৪টি টয়লেট প্যানে পানিতে ভরে ময়লা ভাসছে। বাকি ৮টিতে ময়লা, দুর্গন্ধ, স্যাঁতসেতেভাবসহ নেই লাইট, হাত পরিস্কার করার জন্য সাবানের ব্যবস্থা।
এদিকে, ঝিনুক বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা ৮শ’ হলেও টয়লেট আছে ৪টি। এরমধ্যে দুটি বিদ্যালয়ের পাশে ফাঁকাস্থানে আর অপর দুটি স্কুলের মধ্যে অবস্থিত। মেয়েরা স্বভাবত ফাকাস্থানের টয়লেট ব্যবহার করে না। তাছাড়া টয়লেট দুটি ব্যবহারের উপযোগীও নয়। এছাড়া বিদ্যালয়ের ভিতরে অবস্থিত আরো দুটি টয়লেট থাকলেও সেই টয়লেটে ছাত্রীরা যেতে পারে না, কারণ বিদ্যালয়ের আশপাশের দোকানদাররাসহ আদালত চত্বরে আসা মানুষেরা প্রকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে এই প্রতিনিয়ত এই টয়লেট ব্যবহার করছে। ফলে ৪টি টয়লেটের একটিতেও কোনোভাবেই মেয়েরা ব্যবহার করতে পারছে না। তাই এই বিদ্যালয় দুটির টয়লেটগুলোকে কোনোভাবেই মেয়ে বান্ধব টয়লেট বলা যায় না।
অন্যদিকে, আদর্শ গালর্স হাইস্কুলের ছাত্রী সংখ্যা সাড়ে ৪শ’ হলেও টয়লেট আছে ২টি, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তবে এ সকল স্কুলগুলোর মধ্যে রাহেলা খাতুন স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা সাড়ে ৪শ’ হলেও টয়লেট আছে ৬টি। এই স্কুলের টয়লেটগুলোর অবস্থা ভালো হলেও শিক্ষার্থীদের দাবি সাবানসহ পরিচ্ছন্ন কর্মীরা নিয়মিত টয়লেটগুলো পরিস্কার করলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।
এ বিষয়ে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, আদর্শ গালর্স ও রাহেলা খাতুন গালর্স স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বললে তারা জানান, শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছে অসাস্থ্যকর টয়লেটের ব্যাপারে কোন অভিযোগ দেয় না। তারপরেও আমরা চেষ্টা করি টয়লেটের পরিবেশ ভালো রাখতে। কিন্তু পরিচ্ছন্ন কর্মিদের গাফতলিতে সমসময় সেটা সম্ভব হয়না। তবে এ বিষয়ে এখন থেকে আরো সর্তক থাকবেন বলেও তারা জানান।
এ বিষয়ে এক নারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘মাসিক’ বা ‘পিরিয়ড’ কিশোরীদের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে খুব অল্প সংখ্যক ছাত্রী মাসিক বা পিরিয়ড সম্পর্কে স্কুল থেকে জানতে পারে। কেবল ১১ শতাংশ স্কুলে ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেট আছে। কিন্তু মাসিক ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা আছে মাত্র ৩ শতাংশ স্কুলে। তাই ৮৬ শতাংশ ছাত্রীরা মাসিকের সময় স্কুলে আসতে চায় না। ৪০ শতাংশ ছাত্রী মাসিকের সময় গড়ে তিন দিন পর্যন্ত স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। স্কুলের টয়লেটগুলো নারী বান্ধব না হওয়ার কারণে স্কুলে যাওয়ার সময় পানিও কম খায় মেয়েরা। দীর্ঘ সময় স্কুলে থাকলেও টয়লেটে যাওয়া থেকে বিরত থাকে তারা। আর চাহিদা মত পানি না খাওয়ার কারণে মেয়েদের ইউরিন ইনফেকশন সমস্যাটা এখন কমন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া এখনও অনেক নারী শিক্ষার্থী পিরিয়ডের সময় স্বাস্থ্যসম্মত সেনেটারী ন্যাপকিনের পরিবর্তে কাপড় ব্যবহার করে। ফলে নারী বান্ধব টয়লেট কম হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া মাসিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি কারিকুলামে আছে। কিন্তু শিক্ষকেরা এটি এড়িয়ে যাচ্ছেন। হাত ধোয়ার উপকরণ ও টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য সরকারের দিক থেকে অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। স্কুল শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে এ বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, এক গবেষণায় দেখা গেছে, টয়লেটের পর ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী সাবান দিয়ে হাত পরিস্কার করে না। আর আমাদের মতো ছোট শহরসহ গ্রামাঞ্চলে এ সমস্যার পরিমাণ প্রায় শতভাগ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট না থাকার ফলে, আবার টয়লেট করার পর হাত না ধোয়ার ফলে অনেক শিক্ষার্থী নিজের অজানতেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। যার কারণে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকেন।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলেন, স্কুল স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় নারী স্বাস্থ্য উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এটা পারিবারিক ও জাতীয় উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সামগ্রিক স্কুল স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নয়নের বিষয়টিকে সামনে আনতে হবে। একই সাথে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করাসহ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে নারী শিক্ষার্থীরা ব্যাপক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে।
তবে এ সকল স্কুলে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের সাথে কথা হলে প্রায় সকলেই অভিযোগ করে বলেন, প্রতিটা স্কুলের একই অবস্থা। স্কুলের টয়লেটে যাওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে কম পরিমাণ পানি পান করে স্কুলে যায় মেয়েরা। ফলে প্রতিনিয়ত ডি-হাইড্রেশনে ভোগে তারা। এ সকল স্কুলের টয়লেটগুলো ময়লা, দুর্গন্ধ ও স্যাঁতসেতেভাবসহ নেই লাইট, পরিস্কার পানি, টয়লেটে যাওয়ার পর হাত পরিস্কার করার জন্য সাবান। ফলে প্রয়োজন হলেও মেয়েরা দীর্ঘ সময় টয়লেট ব্যবহার না করায় বিভিন্ন সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। কখনো পেটের ব্যাথা, গ্যাষ্ট্রিকসহ বিভিন্ন শারিরীক সমস্যায় পড়ে তারা। ফলে অসুস্থ হলেই স্কুল বন্ধ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। এভাবে একজন নারী শিক্ষাথীরা পিছিয়ে পড়ে। তদারকিটা ঠিক মতো হলে আমাদের সন্তানদের স্কুলের টয়লেটের সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে। এ সময় তারা আরও বলেন, এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব দিতে হবে। শিক্ষক শিক্ষার্থী’র সমন্বয়ে প্রতিটা স্কুলে পরিচর্যা বিষয়ক একটি কমিটি এ সকল বিষয়গুলো তদারকি করলে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের সমস্যা অনেকটা কমে যাবে।
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন খাইরুল আলমের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, প্রতিটা স্কুলে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের অভাব রয়েছে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় কম সংখ্যক টয়লেট থাকলেও এ সকল স্কুলের টয়লেট ব্যবহারের পর হাত ধোয়ার উপকরণ ও টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে এ সকল স্কুলের টয়লেটগুলো আনহাইজেনিক হওয়ার কারণে প্রয়োজনে দীর্ঘ সময় টয়লেট ব্যবহার না করার কারণে (ইউটিএ) ইউরিন ইনফেকশন, (ড্রিবলিং), (হাইড্রোন এপ্রোসিস) অর্থাৎ ব্যাক-ফ্লু হতে পারে। আর এর কারণে প্রসাব ব্যাক-ফ্লু হয়ে কিডনি বড় হয়ে যাওয়া, সময়মত পায়খানা না করলে, মলদার সংকোচন প্রোসরণসহ এ্যাবডোনাল পেইন হতে পারে। পিরিয়ডকালীন সময় প্রয়োজনে টয়লেট ব্যবহার না করলে মুত্রথলী ইনফেকশনসহ জরায়ুর ইনফেশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে প্রতিটা স্কুলের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা যাতে স্কুলের টয়লেটগুলো নিয়মিত পরিস্কার রাখে সে বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষের নিশ্চিত করা প্রয়োজন।