শিরোনাম :
Logo ইবিতে শুরু হয়েছে গুচ্ছ এ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা Logo অবরুদ্ধ গাজায় একদিনেই নিহত ১০৬ ফিলিস্তিনি Logo ভারতের কাছে পাইলট আটকের প্রমাণ চাইলো পাকিস্তান Logo নিষিদ্ধ হচ্ছে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বললেন আসিফ মাহমুদ Logo খুবি উপাচার্যের এবং বিএনসিসি খুলনা ফ্লোটিলা কমান্ডারের সৌজন্য সাক্ষাৎ  Logo গুচ্ছের ‘এ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা ঘিরে প্রস্তুত ইবি Logo ভারতের ১৫ শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পাকিস্তানের, দাবি দিল্লির Logo জবিতে আবাসন ভাতা ও জকসু নির্বাচনের দাবিতে গণভোট কর্মসূচি Logo রাবি ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ ৫ দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান সোচ্চারের Logo ইউজিসির বাজেট বৈষম্যের অভিযোগ:জবিতে প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

কারাগারে বন্দি সোনালি শৈশব!

  • amzad khan
  • আপডেট সময় : ০৩:১২:৩৩ অপরাহ্ণ, মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর ২০১৬
  • ৭৫৮ বার পড়া হয়েছে

নিউজ ডেস্ক:

শিশুরা কোমলমতি। শিশুদের জন্য কারাগার নয়। মায়ের সঙ্গে কারাগারে যে শিশুরা থাকছে তাদের জায়গা কারাগারে নয় শেল্টার হোমে হওয়া দরকার। হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে কারাগারে কোনো শিশু থাকবে না। -রীতা ভৌমিক

শিশুরা অপরাধী হয়ে জন্মায় না। সামাজিক অব্যবস্থার শিকার হয়ে তারা অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে। অপরাধ জগতে শিশুদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ খুবই অপ্রতুল। বাংলাদেশের অনেক শিশু দরিদ্রতা, বাবা-মায়ের অবহেলা, বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ, যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের নির্যাতন, বৈষম্য, সহিংসতার শিকার হয়ে অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে চুরি, অবৈধ পণ্য বিক্রি, তা একস্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছে দেয়া। এর মধ্যে মাদক বিক্রি, চোরাচালানের কাজেও শিশুদের ব্যবহার করা হয়। ফলে শিশুরা শারীরিক নির্যাতন, আটক, গ্রেফতারসহ নানা আইনি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। ফলে থানা ও কারাগারে আটক শিশুরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। কিশোর বিচার ব্যবস্থায় বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ শিশুদের কারাগারে আটক রাখা হয়। বিচারব্যবস্থা বিলম্বিত হয়, একই সঙ্গে জাতীয় শিশুনীতিতে উল্লিখিত বিচার চলাকালীন শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়ে থাকে। অথচ সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের আওতায় আনার কোনো উদ্যোগ নেই।

কিশোর আদালতে বিচারের জন্য তিন ধরনের কেস লক্ষ্য করা যায়। ১. পুলিশ কেস (জিআর)। পুলিশ কেস আবার দু’ধরনের ক. বিচারাধীন, খ. মেয়াদপ্রাপ্ত। পুলিশ কেস (জিআর) যেসব কিশোর-কিশোরী (১৮ বছরের নিচে) দণ্ডবিধি মোতাবেক ছিনতাই, ফেনসিডিল বিক্রি, রাহাজানি, খুন ইত্যাদি কোনো অপরাধ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হয়ে থাকে। তাদের বিচারও ওই আদালতে সম্পন্ন হয়। এ ছাড়া ২. অভিভাবক কেস ও ৩. প্রবেশনও রয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইজিপি ও ঢাকার সিএমএমের নির্দেশ মোতাবেক গ্রেফতারকৃত শিশু-কিশোর-কিশোরীদের অন্য কোনো আদালতে প্রেরণ না করে থানা থেকে সরাসরি কিশোর আদালতে পাঠানোর নির্দেশ রয়েছে। তাদের কারাগারে না পাঠিয়ে কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রে সংশোধনের জন্য রাখতে হবে। শিশু আইন অনুযায়ী পুলিশ তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তাকে বিভাগীয় সাজা পেতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশ হ্যান্ড বুক ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধি, সাক্ষ্য আইন ও মাইনর অ্যাক্টস একত্রে সপ্তম অধ্যায়ে ‘অপরাধ’ : শাস্তি ও কার্য পদ্ধতি’তে উল্লেখ রয়েছে, ‘কোনো পুলিশ অফিসার যদি তাহার হেফাজতে আটক কোনো ব্যক্তির প্রতি বিনা কারণে জুলুম করে অথবা ভীতি প্রদর্শন করে, অথবা আইন মোতাবেক তাহাকে গ্রেফতার না করিবার প্রতিশ্রুতি দান করে, তবে সে এক বৎসর মেয়াদ পর্যন্ত কারাদণ্ডে অথবা দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা দণ্ডে অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হইবে। কারণ এই আইনের যে বিধান রয়েছে তাতে আইন অপব্যবহার করার ক্ষমতা দেয়া হয় নাই।’

শিশু আইন ২০১৩-এর ৪৪। ধারায় উল্লেখ রয়েছে, ‘গ্রেফতার করিবার পর কোন শিশুকে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি বা রশি লাগানো যাইবে না। উপধারা (৫) সংশ্লিষ্ট থানায় শিশুর জন্য উপযোগী কোন নিরাপদ স্থান না থাকিলে গ্রেফতারের পর হইতে আদালতে হাজির না করা সময় পর্যন্ত শিশুকে নিরাপদ স্থানে আটক রাখিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। তবে শর্ত থাকে যে, নিরাপদ স্থানে আটক রাখিবার ক্ষেত্রে শিশুকে প্রাপ্তবয়স্ক বা ইতোমধ্যেই দোষী সাব্যস্ত হইয়াছে এইরূপ কোন শিশু বা অপরাধী এবং আইনের সংস্পর্শে আসা কোন শিশুর সহিত একত্রে রাখা যাইবে না।’

অভিভাবকহীন, পরিবার বিচ্ছিন্ন ও দরিদ্রতার কারণে গ্রেফতারকৃত শিশুরা প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা বা সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। আইএলও-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৫ লাখ পথশিশুর মধ্যে ১৯.২ শতাংশ শিশু বিভিন্ন অপরাধে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে।

শুধু তাই নয়, কোনো গর্ভবতী কারাগারে সন্তান প্রসব করলে অথবা কারাগারে অবস্থানরত কোনো মায়ের কোলে শিশু থাকলে সেই শিশুদের জায়গাও হয় কারাগারে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি কারাগারে অপরাধী না হয়েও মায়ের অপরাধের কারণে অনেক শিশু মায়ের সঙ্গে কারাজীবন অতিবাহিত করছে। যেখানে দাগি আসামি থেকে বিভিন্ন ধরনের অপরাধীরাও রয়েছে। ফলে এসব শিশু বেড়ে উঠছে অপরাধীদের সংস্পর্শে। কারাগারে অবস্থানরত এ শিশুরা কবে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবে এটা আমরা জানি না।

বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার অ্যাডভোকেট এলিনা খান জানান, হাইকোর্ট একটি রিট করা হয়েছে, কারাগারে কোনো শিশু থাকবে না। সরাসরি থানা অথবা আদালত থেকে সাজাপ্রাপ্ত মায়ের শিশুকে শিশুসদনে নিয়ে যাওয়া হবে। শিশুর আবাস কারাগার হতে পারে না।

কারাগারে দাগি আসামিরাও থাকে। এদের কেউ মহিলা রাইটার, মহিলা হাজতি, মহিলা কয়েদি। কারাগারে আটক মায়েদের অনেকেই দাগি আসামি বা কয়েদিদের সঙ্গে থাকে। তাদের নিজেরাও কেউ দাগি আসামি বা কয়েদি। তাদের আচরণগুলো কারাগারে অবস্থানরত কোমলমতি শিশুদের মনে প্রতিফলিত হয়। ফলে কারাগারের ওই পরিবেশের কারণে তাদের শিশুসুলভ আচরণগুলো লোপ পেতে থাকে। যেসব শিশু স্কুলে যাচ্ছে তারা স্কুলের পর আবার কারাগারের ওই পরিবেশেই ফিরে আসছে। অল্প সময়ের জন্য কারাগারের বাইরে থাকায় তাদের আচরণে তেমন পরিবর্তন হচ্ছে না। এসব শিশুর থাকার জন্য কারাগারের ভেতরে আলাদা শেল্টার হোম দরকার। মায়েরা শেল্টার হোমে এসে তাদের সন্তানের সঙ্গে দেখা করবে।

কারারুদ্ধ পরিবেশে তার শারীরিক আয়তন বৃদ্ধি পেলেও মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটছে না।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের হেড অব সাইকোথেরাপি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এমএ মোহিত বলেন, শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য নিরাপত্তাবোধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন মায়ের সঙ্গে তার শিশুটি কারাগারে থাকলে সে বুঝে যায় তার মা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। ধীরে ধীরে এটা তার মনের ভেতর গেঁথে যায়। পরবর্তী সময়ে তার আচরণে তা প্রকাশ পায়। শৈশবে তারা পরিবারের মধ্যে, স্বাভাবিক পরিবেশে বড় হচ্ছে না। যে পরিবেশে তারা বড় হচ্ছে সেখানে সহিংসতা দেখছে, ধমক দিয়ে কথা বলতে দেখছে। সহিংসতার বৈশিষ্ট্য নিয়ে বড় হওয়ায় অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাদের শিশুসুলভ প্রতিভা। তারা চুপচাপ হয়ে যায়। কারো সঙ্গে কথা বলে না। এর কারণ শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা ওই আচরণগুলো নিজেদের মধ্যে ধারণ করে বড় হচ্ছে। ফলে এ নেতিবাচক দিকগুলো তাদের মনে বিস্তার লাভ করে। এসব কারণে সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতাও এই শিশুদের বাধাগ্রস্ত হয়। মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আত্মবিশ্বাস লোপ পায়। জীবন সম্পর্কে তারা হতাশ হয়ে পড়ে।

মায়ের অপরাধে অপরাধী হয়ে অথবা না জেনে কোনো অপরাধ করে শিশুরা এভাবে কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করবে তা সুস্থ-সুন্দর সমাজ-পরিবেশে কাম্য হতে পারে না। কারাগারের এই বন্দি জীবন থেকে আমাদের শিশুরা কবে মুক্তি পাবে? এসব শিশু সুস্থ জীবন, সুন্দর পরিবেশে কীভাবে বড় করে তোলা যায় এটা নিয়ে ভাববার সময় এখনি।
শিশু অধিকারে নীতি ও আইনে

যা বলা হয়েছে

জাতীয় শিশু সুরক্ষা নীতি ২০১১ এবং শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী শিশুর সুরক্ষা ও আইনি সহায়তা প্রদানে সরকার বদ্ধ পরিকর ও অঙ্গীকারাবদ্ধ। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শিশুর প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধে অধিকার সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। জুভেনাইল জাস্টিসের ব্যাপারে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন। এ ক্ষেত্রে নিগৃহীত ও নির্যাতিত শিশুর সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- ‘শিশু নির্যাতনের ঘটনা যেখানেই ঘটুকনা কেন মামলা নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর তা না করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিশুর পরিবারকে হয়রানি করা যাবে না।’

কোনো শিশু বিভিন্ন অপরাধে পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হলে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা যাবে না। তাকে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রেরণ করতে হবে। শিশু আইন ২০১৩-এর ২৬। ‘(১) বিচারকালীন শিশুকে নিরাপদ হেফাজতে রাখার বিষয়টি সর্বশেষ পন্থা হিসেবে বিবেচনা করিতে হইবে, যাহার মেয়াদ হইবে যথাসম্ভব স্বল্পতম সময়ের জন্য। (৩) শিশুকে নিরাপদ হেফাজতে রাখা একান্ত প্রয়োজন হইলে শিশু আদালত, সংশ্লিষ্ট শিশুকে উক্ত আদালত হইতে যুক্তিসঙ্গত দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত কোন প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করিবার জন্য আদেশ প্রদান করিবে : তবে শর্ত থাকে যে, এই উপ-ধারার অধীনে কোন শিশুকে প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করা হইলে উক্ত প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকারী অধিক বয়স্ক শিশুদের হইতে প্রেরিত শিশুকে পৃথক করিয়া রাখিতে হইবে।’

ধারা ৫৯ । ‘(১) সরকার, বিচার প্রক্রিয়ায় আটকাদেশপ্রাপ্ত শিশু এবং বিচারের আওতাধীন শিশুর আবাসন, সংশোধন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে, লিঙ্গভেদে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণ করিবে।

(২) উপধারা (১)-এর প্রাসঙ্গিকতাকে ক্ষুন্ন না করিয়া সরকার, যে কোন সময়, উহার যে কোন ইন্সটিটিউট বা প্রতিষ্ঠানকে শিশু অপরাধীদেরকে অবস্থানের জন্য উপযুক্ত মর্মে প্রত্যয়ন করিতে পারিবে।

তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত রয়েছে- ধারা ৬৩। ‘(৩) দণ্ডবিধির ধারা ৮২-এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ৯ (নয়) বৎসর বয়সের কম বয়সী কোন শিশুকে কোন প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে রাখা যাইবে না :

তবে শর্ত থাকে যে, কোন কারণে ৯ (নয়) বৎসর বয়সের কম বয়সী অভিভাবকহীন কোন শিশুকে কোথাও পাওয়া গেলে তাহাকে অধিদফতর বা উহার নিকটস্থ কোন কার্যালয়ে প্রেরণ করিতে হইবে এবং অধিদফতর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বোর্ডের গোচরীভূত করতঃ সংশ্লিষ্ট শিশুকে সুবিধাবঞ্চিত শিশু গণ্যে, ক্ষেত্রমত, ধারা ৮৪ বা ধারা ৮৫-এর বিধান অনুযায়ী পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’

ট্যাগস :

ইবিতে শুরু হয়েছে গুচ্ছ এ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা

কারাগারে বন্দি সোনালি শৈশব!

আপডেট সময় : ০৩:১২:৩৩ অপরাহ্ণ, মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর ২০১৬

নিউজ ডেস্ক:

শিশুরা কোমলমতি। শিশুদের জন্য কারাগার নয়। মায়ের সঙ্গে কারাগারে যে শিশুরা থাকছে তাদের জায়গা কারাগারে নয় শেল্টার হোমে হওয়া দরকার। হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে কারাগারে কোনো শিশু থাকবে না। -রীতা ভৌমিক

শিশুরা অপরাধী হয়ে জন্মায় না। সামাজিক অব্যবস্থার শিকার হয়ে তারা অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে। অপরাধ জগতে শিশুদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ খুবই অপ্রতুল। বাংলাদেশের অনেক শিশু দরিদ্রতা, বাবা-মায়ের অবহেলা, বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ, যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের নির্যাতন, বৈষম্য, সহিংসতার শিকার হয়ে অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে চুরি, অবৈধ পণ্য বিক্রি, তা একস্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছে দেয়া। এর মধ্যে মাদক বিক্রি, চোরাচালানের কাজেও শিশুদের ব্যবহার করা হয়। ফলে শিশুরা শারীরিক নির্যাতন, আটক, গ্রেফতারসহ নানা আইনি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। ফলে থানা ও কারাগারে আটক শিশুরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। কিশোর বিচার ব্যবস্থায় বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ শিশুদের কারাগারে আটক রাখা হয়। বিচারব্যবস্থা বিলম্বিত হয়, একই সঙ্গে জাতীয় শিশুনীতিতে উল্লিখিত বিচার চলাকালীন শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়ে থাকে। অথচ সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের আওতায় আনার কোনো উদ্যোগ নেই।

কিশোর আদালতে বিচারের জন্য তিন ধরনের কেস লক্ষ্য করা যায়। ১. পুলিশ কেস (জিআর)। পুলিশ কেস আবার দু’ধরনের ক. বিচারাধীন, খ. মেয়াদপ্রাপ্ত। পুলিশ কেস (জিআর) যেসব কিশোর-কিশোরী (১৮ বছরের নিচে) দণ্ডবিধি মোতাবেক ছিনতাই, ফেনসিডিল বিক্রি, রাহাজানি, খুন ইত্যাদি কোনো অপরাধ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হয়ে থাকে। তাদের বিচারও ওই আদালতে সম্পন্ন হয়। এ ছাড়া ২. অভিভাবক কেস ও ৩. প্রবেশনও রয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইজিপি ও ঢাকার সিএমএমের নির্দেশ মোতাবেক গ্রেফতারকৃত শিশু-কিশোর-কিশোরীদের অন্য কোনো আদালতে প্রেরণ না করে থানা থেকে সরাসরি কিশোর আদালতে পাঠানোর নির্দেশ রয়েছে। তাদের কারাগারে না পাঠিয়ে কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রে সংশোধনের জন্য রাখতে হবে। শিশু আইন অনুযায়ী পুলিশ তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তাকে বিভাগীয় সাজা পেতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশ হ্যান্ড বুক ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধি, সাক্ষ্য আইন ও মাইনর অ্যাক্টস একত্রে সপ্তম অধ্যায়ে ‘অপরাধ’ : শাস্তি ও কার্য পদ্ধতি’তে উল্লেখ রয়েছে, ‘কোনো পুলিশ অফিসার যদি তাহার হেফাজতে আটক কোনো ব্যক্তির প্রতি বিনা কারণে জুলুম করে অথবা ভীতি প্রদর্শন করে, অথবা আইন মোতাবেক তাহাকে গ্রেফতার না করিবার প্রতিশ্রুতি দান করে, তবে সে এক বৎসর মেয়াদ পর্যন্ত কারাদণ্ডে অথবা দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা দণ্ডে অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হইবে। কারণ এই আইনের যে বিধান রয়েছে তাতে আইন অপব্যবহার করার ক্ষমতা দেয়া হয় নাই।’

শিশু আইন ২০১৩-এর ৪৪। ধারায় উল্লেখ রয়েছে, ‘গ্রেফতার করিবার পর কোন শিশুকে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি বা রশি লাগানো যাইবে না। উপধারা (৫) সংশ্লিষ্ট থানায় শিশুর জন্য উপযোগী কোন নিরাপদ স্থান না থাকিলে গ্রেফতারের পর হইতে আদালতে হাজির না করা সময় পর্যন্ত শিশুকে নিরাপদ স্থানে আটক রাখিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। তবে শর্ত থাকে যে, নিরাপদ স্থানে আটক রাখিবার ক্ষেত্রে শিশুকে প্রাপ্তবয়স্ক বা ইতোমধ্যেই দোষী সাব্যস্ত হইয়াছে এইরূপ কোন শিশু বা অপরাধী এবং আইনের সংস্পর্শে আসা কোন শিশুর সহিত একত্রে রাখা যাইবে না।’

অভিভাবকহীন, পরিবার বিচ্ছিন্ন ও দরিদ্রতার কারণে গ্রেফতারকৃত শিশুরা প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা বা সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। আইএলও-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৫ লাখ পথশিশুর মধ্যে ১৯.২ শতাংশ শিশু বিভিন্ন অপরাধে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে।

শুধু তাই নয়, কোনো গর্ভবতী কারাগারে সন্তান প্রসব করলে অথবা কারাগারে অবস্থানরত কোনো মায়ের কোলে শিশু থাকলে সেই শিশুদের জায়গাও হয় কারাগারে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি কারাগারে অপরাধী না হয়েও মায়ের অপরাধের কারণে অনেক শিশু মায়ের সঙ্গে কারাজীবন অতিবাহিত করছে। যেখানে দাগি আসামি থেকে বিভিন্ন ধরনের অপরাধীরাও রয়েছে। ফলে এসব শিশু বেড়ে উঠছে অপরাধীদের সংস্পর্শে। কারাগারে অবস্থানরত এ শিশুরা কবে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবে এটা আমরা জানি না।

বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার অ্যাডভোকেট এলিনা খান জানান, হাইকোর্ট একটি রিট করা হয়েছে, কারাগারে কোনো শিশু থাকবে না। সরাসরি থানা অথবা আদালত থেকে সাজাপ্রাপ্ত মায়ের শিশুকে শিশুসদনে নিয়ে যাওয়া হবে। শিশুর আবাস কারাগার হতে পারে না।

কারাগারে দাগি আসামিরাও থাকে। এদের কেউ মহিলা রাইটার, মহিলা হাজতি, মহিলা কয়েদি। কারাগারে আটক মায়েদের অনেকেই দাগি আসামি বা কয়েদিদের সঙ্গে থাকে। তাদের নিজেরাও কেউ দাগি আসামি বা কয়েদি। তাদের আচরণগুলো কারাগারে অবস্থানরত কোমলমতি শিশুদের মনে প্রতিফলিত হয়। ফলে কারাগারের ওই পরিবেশের কারণে তাদের শিশুসুলভ আচরণগুলো লোপ পেতে থাকে। যেসব শিশু স্কুলে যাচ্ছে তারা স্কুলের পর আবার কারাগারের ওই পরিবেশেই ফিরে আসছে। অল্প সময়ের জন্য কারাগারের বাইরে থাকায় তাদের আচরণে তেমন পরিবর্তন হচ্ছে না। এসব শিশুর থাকার জন্য কারাগারের ভেতরে আলাদা শেল্টার হোম দরকার। মায়েরা শেল্টার হোমে এসে তাদের সন্তানের সঙ্গে দেখা করবে।

কারারুদ্ধ পরিবেশে তার শারীরিক আয়তন বৃদ্ধি পেলেও মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটছে না।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের হেড অব সাইকোথেরাপি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এমএ মোহিত বলেন, শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য নিরাপত্তাবোধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন মায়ের সঙ্গে তার শিশুটি কারাগারে থাকলে সে বুঝে যায় তার মা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। ধীরে ধীরে এটা তার মনের ভেতর গেঁথে যায়। পরবর্তী সময়ে তার আচরণে তা প্রকাশ পায়। শৈশবে তারা পরিবারের মধ্যে, স্বাভাবিক পরিবেশে বড় হচ্ছে না। যে পরিবেশে তারা বড় হচ্ছে সেখানে সহিংসতা দেখছে, ধমক দিয়ে কথা বলতে দেখছে। সহিংসতার বৈশিষ্ট্য নিয়ে বড় হওয়ায় অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাদের শিশুসুলভ প্রতিভা। তারা চুপচাপ হয়ে যায়। কারো সঙ্গে কথা বলে না। এর কারণ শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা ওই আচরণগুলো নিজেদের মধ্যে ধারণ করে বড় হচ্ছে। ফলে এ নেতিবাচক দিকগুলো তাদের মনে বিস্তার লাভ করে। এসব কারণে সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতাও এই শিশুদের বাধাগ্রস্ত হয়। মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আত্মবিশ্বাস লোপ পায়। জীবন সম্পর্কে তারা হতাশ হয়ে পড়ে।

মায়ের অপরাধে অপরাধী হয়ে অথবা না জেনে কোনো অপরাধ করে শিশুরা এভাবে কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করবে তা সুস্থ-সুন্দর সমাজ-পরিবেশে কাম্য হতে পারে না। কারাগারের এই বন্দি জীবন থেকে আমাদের শিশুরা কবে মুক্তি পাবে? এসব শিশু সুস্থ জীবন, সুন্দর পরিবেশে কীভাবে বড় করে তোলা যায় এটা নিয়ে ভাববার সময় এখনি।
শিশু অধিকারে নীতি ও আইনে

যা বলা হয়েছে

জাতীয় শিশু সুরক্ষা নীতি ২০১১ এবং শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী শিশুর সুরক্ষা ও আইনি সহায়তা প্রদানে সরকার বদ্ধ পরিকর ও অঙ্গীকারাবদ্ধ। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শিশুর প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধে অধিকার সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। জুভেনাইল জাস্টিসের ব্যাপারে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন। এ ক্ষেত্রে নিগৃহীত ও নির্যাতিত শিশুর সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- ‘শিশু নির্যাতনের ঘটনা যেখানেই ঘটুকনা কেন মামলা নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর তা না করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিশুর পরিবারকে হয়রানি করা যাবে না।’

কোনো শিশু বিভিন্ন অপরাধে পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হলে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা যাবে না। তাকে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রেরণ করতে হবে। শিশু আইন ২০১৩-এর ২৬। ‘(১) বিচারকালীন শিশুকে নিরাপদ হেফাজতে রাখার বিষয়টি সর্বশেষ পন্থা হিসেবে বিবেচনা করিতে হইবে, যাহার মেয়াদ হইবে যথাসম্ভব স্বল্পতম সময়ের জন্য। (৩) শিশুকে নিরাপদ হেফাজতে রাখা একান্ত প্রয়োজন হইলে শিশু আদালত, সংশ্লিষ্ট শিশুকে উক্ত আদালত হইতে যুক্তিসঙ্গত দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত কোন প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করিবার জন্য আদেশ প্রদান করিবে : তবে শর্ত থাকে যে, এই উপ-ধারার অধীনে কোন শিশুকে প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করা হইলে উক্ত প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকারী অধিক বয়স্ক শিশুদের হইতে প্রেরিত শিশুকে পৃথক করিয়া রাখিতে হইবে।’

ধারা ৫৯ । ‘(১) সরকার, বিচার প্রক্রিয়ায় আটকাদেশপ্রাপ্ত শিশু এবং বিচারের আওতাধীন শিশুর আবাসন, সংশোধন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে, লিঙ্গভেদে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণ করিবে।

(২) উপধারা (১)-এর প্রাসঙ্গিকতাকে ক্ষুন্ন না করিয়া সরকার, যে কোন সময়, উহার যে কোন ইন্সটিটিউট বা প্রতিষ্ঠানকে শিশু অপরাধীদেরকে অবস্থানের জন্য উপযুক্ত মর্মে প্রত্যয়ন করিতে পারিবে।

তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত রয়েছে- ধারা ৬৩। ‘(৩) দণ্ডবিধির ধারা ৮২-এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ৯ (নয়) বৎসর বয়সের কম বয়সী কোন শিশুকে কোন প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে রাখা যাইবে না :

তবে শর্ত থাকে যে, কোন কারণে ৯ (নয়) বৎসর বয়সের কম বয়সী অভিভাবকহীন কোন শিশুকে কোথাও পাওয়া গেলে তাহাকে অধিদফতর বা উহার নিকটস্থ কোন কার্যালয়ে প্রেরণ করিতে হইবে এবং অধিদফতর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বোর্ডের গোচরীভূত করতঃ সংশ্লিষ্ট শিশুকে সুবিধাবঞ্চিত শিশু গণ্যে, ক্ষেত্রমত, ধারা ৮৪ বা ধারা ৮৫-এর বিধান অনুযায়ী পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’