গাজার প্রথম নারী মৎস্যজীবী ম্যাডলিন কুলাবের নামেই নামকরণ করা হয়েছে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের (এফএফসি) পরিচালিত ত্রাণবাহী জাহাজ ‘ম্যাডলিন’। ইসরায়েলি অবরোধ আর সহিংসতার দীর্ঘ ছায়ায় থাকা গাজার মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে এই জাহাজের যাত্রা শুরু হয় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে।
তিন বছর আগে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা প্রথমবার ম্যাডলিন কুলাবের কথা বিশ্ববাসীর সামনে তোলে। তখন তিনি দুই সন্তানের মা এবং তৃতীয় সন্তানের অপেক্ষায় ছিলেন। স্বামী খাদির বাকারের সঙ্গে গাজা সিটির উপকূলে শান্তিপূর্ণভাবে দিন কাটাতেন। দুজনেই ছিলেন পেশাদার মৎস্যজীবী—যা গাজার মতো বিপর্যস্ত অঞ্চলে এক সাহসী জীবিকার নাম। সেই সাহস আর প্রতীকী লড়াইয়ের স্মারক হয়ে আজ বিশ্ব মানবতার বাণী বহন করছে ‘ম্যাডলিন’ জাহাজ। তিনি গাজা সিটিতে তার স্বামী খাদির বাকরের (৩২) সাথে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতেন। খাদিরও একজন মৎস্যজীবী।
ওই সময়ে ৩০ বছর বয়সী ম্যাডলিন ইসরায়েলের নৌ-অবরোধের মাঝে যতদূর অনুমতি দিত, ততদূর নির্ভয়ে মাছ ধরতে যেতেন এবং স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে পরিবারের ভরণপোষণ করতেন।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হলে পরিবারটি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে তাদের বাড়ির কাছে একটি বিমান হামলায় ম্যাডলিনের বাবা নিহত হলে তাদের হৃদয় ভেঙে যায়। প্রায় নয় মাস অন্তঃসত্ত্বা ম্যাডলিনকে নিয়ে তার স্বামী খান ইউনিসে, তারপর রাফাহ, দেইর আল-বালাহ এবং নুসাইরাতে পালিয়ে যান।
এখন তারা গাজা সিটিতে তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে ফিরে এসেছে, যা তারা জানুয়ারিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী উত্তর দিকে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলে পুনরায় দখল করে। ম্যাডলিন তার ক্ষতিগ্রস্ত বসার ঘরে একটি জীর্ণ সোফায় বসে আছেন, তার চার সন্তানের মধ্যে তিনজন তার সাথে রয়েছেন: এক বছরের শিশু ওয়াসিলা তার কোলে, পাঁচ বছরের সাফিনাজ পাশে এবং তিন বছরের জামাল—যে শিশুটিকে সে সময় গর্ভে ধারণ করেছিলেন যখন আল জাজিরা প্রথম তার সাথে দেখা করেছিল। জাহাজটির নাম তার নামে রাখা হয়েছে এমন খবর শুনে কি বললেন ম্যাডলিন?
‘আমি গভীরভাবে আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম। আমি এক বিশাল দায়িত্ববোধ এবং কিছুটা গর্ব অনুভব করেছি,’ তিনি হেসে বলেন।
জাহাজে ১২ জন কর্মীর দল সম্পর্কে ম্যাডলিন এও বলেন, ‘আমি এই কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞ, যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, তাদের জীবন ও সব সুবিধা পেছনে ফেলে গাজারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, সমস্ত ঝুঁকি সত্ত্বেও। এটি বিপদের মুখে মানবতা ও আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ প্রকাশ।’
১২ জন কর্মীর দল সম্পর্কে, যাদের মধ্যে রয়েছেন সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ফরাসি সদস্য রিমা হাসান।
ম্যাডলিন ১৫ বছর বয়স থেকে মাছ ধরছেন, তার বাবার নৌকায় চড়ে বের হওয়া এক পরিচিত মুখ, যিনি অন্যান্য সকল মৎস্যজীবীদের চিনতেন এবং আন্তর্জাতিক সংহতি কর্মীদের কাছেও পরিচিত হয়েছিলেন।
মাছ ধরার পাশাপাশি ম্যাডলিন একজন দক্ষ রন্ধনশিল্পী, যিনি মৌসুমি মাছের এমন সুস্বাদু পদ তৈরি করতেন যে তার কাছে ক্রেতাদের তালিকা জমে থাকত। বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিল গাজায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া সার্ডিন দিয়ে তৈরি খাবার।
কিন্তু এখন, তিনি আর মাছ ধরতে পারেন না, খাদিরও পারেন না, কারণ যুদ্ধের সময় ইসরায়েল তাদের নৌকা এবং মাছ ধরার সরঞ্জামে ভরা একটি গুদাম ধ্বংস করে দিয়েছে।
ম্যাডলিন যুদ্ধ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই যুদ্ধে আমরা সব হারিয়েছি।’
কিন্তু তার ক্ষতি শুধু আয়ের নয়। এটি তার পরিচয়—সমুদ্র ও মাছ ধরা নিয়ে তার গভীর সংযোগ—এমনকি মাছ খাওয়ার সাধারণ আনন্দেরও।
ম্যাডলিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, এখন মাছ খুব দামি, যদি পাওয়াই যায়! মাছ তো দূরের কথা, এক বেলা খাবার পাওয়াই অনেক কিছু!